মোস্তফা কামাল : ওরা সুযোগ খোঁজে। সুযোগটা পেলেই চলে যায় দেশ ছেড়ে। দেশ ছাড়তে পারলেই যেন বাঁচে। তাদের সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যাটিসটিকস এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য রাখে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী শিক্ষার্থী ৪৯ হাজার ১৫১ জন। যা ২০২১ সালের চেয়ে অন্তত ১০% বেশি। কেন স্বদেশটা তাদের কাছে এতো অসহ্যের? পড়াশোনা, কর্মসংস্থান সব কিছুর জন্য এতো অনুপোযুক্ত?
বিদেশ গমনেচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের প্রথম পছন্দ যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের হিসাবে গত বছর দেশটিতে গেছে বাংলাদেশের ১০ হাজার ৫৯৭ জন শিক্ষার্থী। এর বাইরে ৭৫৪৮ জন গেছে মালয়েশিয়ায়, অস্ট্রেলিয়াতে ৫৬৪৭, কানাডায় ৫১৩৬, জার্মানিতে ৩৯৩০, যুক্তরাজ্যে ৩১৯৪, ভারতে ২৭৫০, জাপানে ২৪৩৬, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১১৩৬, সৌদিতে ১১৬৮ জন। সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, সুইডেন, সাইপ্রাস, ফিনল্যান্ড, তুর্কি, কাতার, থাইল্যান্ড, রাশিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, হংকং ডেনমার্কেও চলে যাচ্ছে অনেকে। এই শিক্ষার্থীদের সবাই কি বিদেশ গিয়ে পড়াশোনা করে?
না। সবাই পড়াশোনা করে না। তাদের একটা অংশ নানা কাজে জড়িয়ে রুটি-রুজি খোঁজে। এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয়, উচ্চ শিক্ষা নিতে যাওয়া এসব শিক্ষার্থীর প্রায় ৯৫ ভাগই আর দেশে ফিরে আসে না। হয় যে দেশে গেছে সে দেশেই থেকে যায়। নইলে অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমায়। তবুও দেশে ফেরার কথা মুখে নেয় না। কতো উদ্বেগের তথ্য? এরা কারা?
বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের মাঝে গরিব ঘরের সন্তান কম। সিংহভাগই রাজনৈতিক নেতা, আমলা বা ব্যবসায়ীদের সন্তান। আন্ডার গ্রাজুয়েট করতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগেরই ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস থাকে না। স্কলারশিপও নয়। বাপের টাকার জোরে বিদেশে থাকা-খাওয়া চলে। মন চাইলে মাঝেমধ্যে দেশে আসে। কিন্তু, থেকে যেতে চায় না। প্রকৃত মেধাবীদের একটা বড় অংশেরও এই মানসিকতা। কেবল শিক্ষার্থী নয়, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে শিক্ষকদের অনেকেও দেশে ফিরতে চান না। বিদেশে থেকে যান নানা বাহানায়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন- ইউজিসির তথ্য মতে, ২০১২ থেকে ২০১৫ সালে ১১৮জন শিক্ষক উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাইরে গিয়ে ফিরেছেন মাত্র ৩৮ জন। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২ শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে দেশে ফিরে না আসার অপরাধে। দেশের ব্রেনগুলোর এভাবে ড্রেনে পড়ে যাওয়া কি মোটেই কোনো স্বাভাবিকতা?
এ অস্বাভাবিকতা বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মসহ গোটা জাতিকে মেধাশূন্য করে কোনদিকে নিচ্ছে? বিদেশ গিয়ে চিকিৎসক, স্থপতি, শিক্ষক, গবেষক হয়ে তাদের দেশে ফিরতে নারাজি নিয়ে কি ভাবনার দাবি রাখে না? দেশে কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ, নিরাপদ বসবাসের নিশ্চয়তা থাকলে কি এমন হতো? রাস্তার টোকাই রাজনৈতিক নেতা, প্রকৌশলী বেকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নকলবাজ গবেষক, চিকিৎসক দলবাজ-মাস্তান হতে থাকা আর কতো? শুধু কৃতি-মেধাবী নয়, সুযোগ পেলে অন্যদেরও বিদেশে নিরাপত্তার চিন্তা মাথায় চাপলে দেশে থাকবে কে, কারা?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন, ঢাকা।