ভাতঘুম

কমলকলি : দুই ভাইবোনের মধ্যে খুনসুটি লেগেই থাকে। সেই কবে থেকে, ছোট থেকে বড় হয়ে গেল! দিনগুলো যেন লাফ দিয়ে দিয়ে চলে গেছে। কবে থেকে ফ্রক পরা দিলারা সালোয়ার-কামিজ ছেড়ে শাড়ি ধরেছে, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে! তারপর কখন যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দেউড়ীতে এসে দাঁড়িয়েছে। আর শাহেদ, ছোট ভাইটা, সেও তো বুবুর সাথে সাথে মাথায় লম্বা হয়ে গেছে! কলেজে ঢুকেছে। দিনরাত মাথার ভেতরে ভাবনা, পড়াশোনা আরো ভালো করব, বুবুকে টপকাতে পারব।

বুবু বলে, কখনো পারবি না। এই দেখ, আমি পাস করেই ইডেন কলেজে চাকরি পাব! মাস্টারি করার চাকরি।

শাহেদ ফোড়ন কাটেÑইডেনে? আর আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে বড় ডাক্তার হব।

Ñবেশ তো হবি, ডাক্তারই হবি। কিন্তু তা কবে? ডাক্তারি পাস করতে সময় লাগে অনেক।

Ñকী আর এমন সময়। সব মিলিয়ে পাঁচ-ছটা বছর আরো লাগবে। তার মধ্যে বাবা-মা তোমার বিয়েও দিয়ে দেবে। সেদিন আমি শুনেছি।

Ñকী শুনেছিস?

Ñবাবা মাকে বলেছে, তোমার জন্য বর দেখতে।

Ñকখনো না। বিয়ে আমি করবই না! চাকরি করব।

এ নিয়ে খুনসুটি লেগেই আছে দুই ভাইবোনের মধ্যে। মা বলেন, এদের দুজনাকে নিয়ে আর পারি না। দুজনার তর্কের আর শেষ নেই।

জহুরুল ইসলামের ছোট সুন্দর বাড়িটা ঢাকা শহরেইÑনীলক্ষেতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেই। সুবিধাই তাতে। তার তো অফিসও কাছাকাছি। মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে হেঁটেই। শাহেদের কলেজও খুব বেশি দূরে নয়। ঢাকা কলেজে পড়ছে ছেলেটা।

সেদিন রাতে খেতে বসে ছেলেকে বলেন, তোমরা পড়াশোনা ঠিকমতো কোরো। পড়াশোনা ঠিকমতো না করলে কিন্তু ভালো চাকরি নেই।

বড় মেয়ে দিলারা হাসে। বাবা, অত চিন্তা কোরো না। আমি তো এখন অনার্স ফোর্থ ইয়ারে। আর দু-এক বছর পরই পাস করে বেরোব। তখন ইনশা আল্লাহ চাকরিও পেয়ে যাব।

মা সবার ভাতের থালায় মাছ-তরকারি বেড়ে দিয়েছে। নিজেও নেয়। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে, মেয়ের চাকরির চিন্তা করলে হবে? তোদের সামনেই বলছি। মেয়ের বিয়ের চিন্তাটা মাথায় রাখো। মেয়েদের বয়স বেড়ে গেলে পরে বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে কিন্তু।

Ñওই দেখ, তোর মায়ের ভাবনা দেখ!

শাহেদ নির্বিকার। মা, ঠিকই বলেছে। বুবুর অত পড়ে কী লাভ! বিয়ের পরে সেই তো শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সবাইকে রান্না করে খাওয়াতে হবে। নতুন দুলাভাইকে, তার বাবা-মাকে, তাই না বুবু? বলেই আড় চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ওঠে শাহেদ।

Ñদেখছ মা, শাহেদ কী সব বলছে। আমি কিন্তু বিয়ের মধ্যেই নেই। আচ্ছা, আমি বাড়ি থেকে চলে গেলেই শাহেদের তো একার রাজত্ব এখানে, তাই না!

ভাইটার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। হাত ধুয়ে এসে বুবুর পাশে বসে আদুরে ভঙ্গিতে বললÑনা বুবু। তুমি শ্বশুরবাড়িতে চলে গেলে আমি বড্ড একা হয়ে যাব। দিনরাত কার সাথে ঝগড়া করব?

দিলারা হাসে। কেন যেন চোখ দুটি তার ভিজে ওঠে।

Ñতাহলে বোকা, ওভাবে বলবি না। সে কী, তোর কখন খাওয়া হয়ে গেল! এই নে, এই ভাতটুকু খা। নিজের হাতের মাছ-ঝোলমাখা ভাতটুকু ভাইয়ের মুখে তুলে দেয়। আর চোখ দুটি বন্ধ করে ভাতটুকু খেতে খেতে শাহেদ বলল, বুবু, খুব মজা তোমার হাতের এই মুঠো ভাতটুকু! আরেকটু দাও না।

জহুরুল ইসলাম স্ত্রীকে ইশারা করেন, দেখেছ, কী মায়া দুজনের অথচ কথায় কথায় তর্ক, ঝগড়া।

মা একমুখ হাসে।

Ñঝগড়া নয় গো, দুই ভাইবোনের বন্ধুত্ব। ¯েœহ ও আদর।

বাবা-মা দুজনেই তাকিয়ে দেখে ও হাসে।

পরদিন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ফিরল দিলারা খানিকটা উদ্বিগ্নচিত্তেই। এসে খোঁজ করে, শাহেদ কই, মা?

Ñকেন রে, সে তো কলেজে। এখনো ফেরেনি।

Ñঅবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। পরের দিন একুশে ফেব্রæয়ারি, এই দিনটাকে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দিন হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। তা ছাড়া এর মধ্যে হরতালের প্রচারপত্রও বিলি শুরু হয়ে গেছে। সেদিন আবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিলও বের করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

Ñকেন?

Ñরাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। পাকিস্তান সরকার বলছে উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু আমরা তা মানব না। মানতে রাজি নই কোনোমতেই। বাংলাই হবে পূর্ব বাংলার মানুষের মুখের ভাষা। জনগণ, বিশেষ করে ছাত্রসমাজ খেপে উঠেছে।

Ñসেকি কথা! রান্নাঘরে মা টুকিটাকি কাজে ব্যস্ত ছিল। মেয়ের কথা শুনে সে কাজ আর এগোয় না।

Ñএ আবার কেমন ধারার কথা? উর্দুকে করতে চাইছে দেশের ভাষা? ও আল্লাহ, নিজের ভাষা ছেড়ে উর্দুতে কথা কইব?

Ñশুধু কি কথা? লেখাপড়া, স্কুলের পড়া, অফিসের কাজকর্ম সবই উর্দুতে করতে হবে মা।

মা হাতের কাজ ফেলে রেখে ঝটিতে ঘুরে দাঁড়ায়। কখন যেন মাথার আঁচল খসে পড়েছে তার কাঁধের ওপর। শ্যামলা অবয়ব তপ্ত হয়ে উঠেছে। বড় বড় দুটি চোখ দপদপ করছে! না, তা কখনোই হবে না।

Ñমা তাহলেই বোঝ! এখন শান্ত হও। আমার মাথা ধরে গেছে। ভার্সিটিতে মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়, আমার জ্বরও এসে গেছে, মা।

দ্রæত এগিয়ে এসে মেয়ের কপালে, মুখে, গলায় হাত রাখে মা।

Ñতাই তো, জ্বরই তো, গা তো অনেক গরম! চল, মাথাটা ধুয়ে দিই।

Ñমা, ব্যস্ত হয়ো না।

Ñব্যস্ত হবো না কিরে, ফাল্গুন মাস পড়েছে। বাতাসে টান আছে। এই সময়ই তো জ্বরজ্বারি হয়। চল মা চল, ঘরে চল। আমি বালতিতে করে পানি নিয়ে আসি, মাথায় ঢালতে হবে।

রাত ১০টার দিকেই জ্বরটা ছেড়ে গেল। শাহেদ বোনের পাশে এসে বসে।

Ñবুবু, তোমার অসুখ হলে আমার ভালো লাগে না। হঠাৎ করে জ্বর এল কেন?

Ñদেখছিস, সবে মাঘ মাস গিয়ে ফাল্গুন পড়েছে। গত দুই দিন গায়ে চাদর না দিয়েই ভার্সিটিতে গেছি। ঠান্ডা লেগেছিল তখনই। চুপ, চুপ, বাবা-মা যেন শুনতে না পায়!

Ñআচ্ছা! নিজের অসুখ নিজেই বাঁধিয়েছ!

রাতে দুধ-বার্লি খেয়ে থাকতে হলো। বাবা ওষুধ এনে দিয়েছেন। একসময় ঘুমিয়ে পড়ে দিলারা। পরদিন আর ভার্সিটিতে যেতে পারেনি। বাবা অফিসে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, আজ আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। এই সময়ের জ্বর খুব খারাপ হয়।

শাহেদ কলেজে গেছে। মায়ের কাছেই বসে থাকে দিলারা। অনেক বিষয় নিয়ে মা-মেয়ে আলোচনাও করে।

Ñমা, কাল তো ভার্সিটিতে মিটিং। তারপর মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার কথা আমাদের। যেতে পারব কি না, মাথাটাÑ।

Ñনা রে মা, এই শরীরে যাসনে।

Ñতাই মা।

বিকেল চারটার দিকে শাহেদ কলেজ থেকে ফেরে। বুবু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগামীকাল তো মিছিল বের হবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে।

Ñজানি তো, কিন্তু আমি কাল যেতে পারব না।

Ñতাই তো মনে হচ্ছে। আমি বরং দুটো ক্লাস করে ওদিকে যেতে পারি।

Ñযাবি, কিন্তু যদি, গন্ডগোল হয়!

Ñকী গন্ডগোল?

Ñজানি না। মনে হলো, তাই বললাম।

Ñও তা-ই! যেহেতু আমি যেতে চেয়েছি, তাই তোমার এই মনগড়া কথা। নিজে যেতে পারছ না তো!

বিছানায় শুয়ে ছিল দিলারা। পাশ ফিরে বলল, যা তো, শুধু প্যাঁচাল পাড়িস।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে চলে যায় শাহেদ। পরদিন একুশে ফেব্রæয়ারি। আজ সকাল সকালই শাহেদ কলেজে গিয়েছে।

দুপুর গড়িয়ে গেল। মাথাটা ধুয়ে, গা মুছে পরিষ্কার সালোয়ার-কামিজ পরেছে দিলারা। মা তাকিয়ে দেখে মেয়েকে।

Ñএক দিনের জ্বরেই মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে তোর!

Ñও কিছু না, মা! দেখো, বারান্দায় কী সুন্দর রোদ এসেছে। মাদুর পেতে ওখানে বসেই ভাত খাই।

Ñবেশ তো, আমরা মা-মেয়ে দুজনই বসে খাই। শাহেদ যে কখন ফেরে?

Ñবিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাবে বলেছিল। গেলেও আর কতক্ষণ, ফিরলে খাবারটা আমি গরম করে দেব। দুজনাই খেয়ে উঠেছে। ঘি আর আলুভর্তা দিয়েই অনেকখানি ভাত তৃপ্তির সাথে খেয়েছে দিলারা।

Ñমা, মাছ দিয়ো না। খেতে ইচ্ছে করছে না।

Ñবেশ তো, তোর যেটা ভালো লাগে তা-ই খা, মা।

Ñএকটু ডাল দাও।

ফাল্গুনের মধুর ঈষদুষ্ণ দুপুরটা একসময় মিইয়ে আসে। ভাতঘুমে জড়িয়ে এসেছিল দিলারার দুটি চোখের পাতা। ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙেছে সন্ধ্যার আগে। বাড়ির দরজায় জোরে কড়া নাড়ার শব্দে। বাবা দরজা খুলে দিয়েছেন। একদল ছাত্র বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় তাদের উদ্্ভ্রান্তের চিহ্ন! হাতের ওপর রাখা শাহেদের রক্তমাখা গুলিবিদ্ধ লাশ!

মিছিলে গিয়েছিল শাহেদ। প্রায় সামনের দিকেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সবার সাথে সেও ¯েøাগান দিয়েছিল চিৎকার করেÑরাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

দুপুরের ভাতঘুমের জড়তাটুকু যেন তখনো কাটেনি দিলারার। বাবা দরজা খুলে পাথরের মতোই দাঁড়িয়ে আছেন। মাথাটা যেন এখনো ভার হয়ে আছে তার। স্বপ্নাচ্ছন্নের মতোই বাবার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল মাও। কখন যেন এসে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে।

হিউস্টন।