
বিশ্বচরাচর ডেস্ক : ইসলামাবাদের উপকণ্ঠে একটি মাদ্রাসার গেটে প্রহরী হিসেবে দÐায়মান ছিল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারী এক কঠোর দর্শন তরুণ। এর ভেতরে প্রবেশের পর মাদ্রাসা পরিচালনার সাথে জড়িত এক আওলানা স্বীকার করেন যে এটি জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম) পরিচালিত একটি মাদ্রাসা। এ গ্রæপটি সম্প্রতি ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে এক আত্মঘাতী বোমা চালানোর দায় স্বীকার করে, যাতে ৪৪ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। তবে ঐ ব্যক্তি বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। এ মাদ্রাসা একটি সাধারণ ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র।
পাকিস্তান সরকার সাম্প্রতিক দিনগুলোতে জঙ্গি দমন অভিযানের অংশ হিসেবে জইশ-ই-মোহাম্মদসহ অন্যান্য গ্রুপের শত শত মাদরাসা ও অন্যান্য ভবন নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
জেইএম-এর নেতা মাসুদ আজহারের ভাইকে আরেকজন আত্মীয় ও আরো কয়েকজনসহ নিরোধমূলক আটক করা হয়েছে। ইসলামাবাদের এই মাদ্রাসার সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর কেউ যোগাযোগ করেননি। আজহার নিজে ২০১৬ সাল থেকে নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন বলে মনে করা হয় যদিও সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি অডিও বার্তা প্রদান অব্যাহত রেখেছেন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী শেহরিয়ার খান আফ্রিদি এ সপ্তাহের গোড়ায় সাংবাদিকদের বলেন, কারো ক্ষতি করার জন্য আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দিতে আমরা দৃঢ়সংকল্প। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কোনো বাইরের শক্তির চাপে এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, কর্তৃপক্ষ আগেই এর পরিকল্পনা করে।
পাকিস্তানের গৃহীত সর্বশেষ ব্যবস্থা আসলেই ভারতবিরোধী জঙ্গিগ্রæপগুলোর কর্মকাণ্ডের অবসান ঘটাবে কি না সে বিষয়ে কিছু মানুষের সন্দেহ রয়েছে। কারণ, এসব গ্রুপ দীর্ঘকাল থেকেই দেশের গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর নিকট থেকে সমর্থন পেয়ে আসছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বিবিসিকে বলেন, এসব তারা আগেও দেখেছেন।
মাসুদ আজহার ভারতের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর ২০০০ সালে জেইএম প্রতিষ্ঠা করেন। তার সহযোগী জঙ্গিরা একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাই করার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৯০-এর দশকে তিনি ছিলেন একজন প্রভাবশালী জঙ্গি নেতা। আফগানিস্তান ও কাশ্মিরে বিভিন্ন ঘটনার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল।
পাকিস্তানের বিশ্লেষক আহমেদ রশিদ বলেন, প্রথম দিকে জেইএম-এর জিহাদিরা ছিল উচ্চ প্রশিক্ষিত ও অত্যন্ত অনুপ্রাণিত যোদ্ধা। যেহেতু পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে তাদের প্রকাশ্য সংযোগ ছিল না তাই ভারত তাদের হামলার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছিল না। পাকিস্তান তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার কথা অস্বীকার করে।
কাশ্মিরে আরেকটি সক্রিয় গ্রæপ ছিল লশকর-ই-তৈয়বা (এলইটি)। তারা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সমর্থন পায় বলে মনে করা হয়।
৯/১১-র পর জিহাদি গ্রæপগুলোর হুমকির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্রমবর্ধমানভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান জেইএম ও এলইটি উভয়কেই নিষিদ্ধ করে। তবে তাদের নেতাদের কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়নি। এ দিকে উভয় সংঠনই নতুন নাম গ্রহণ করে। লশকর-ই-তৈয়বা হয় জামায়াত-উদ-দাওয়া (জেইউডি) যদিও তারা নিজেদের পৃথক বলে দাবি করেইসলামাবাদে জঙ্গিদের সমর্থক ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ফলে জিহাদি গ্রæপগুলোর সাথে পাকিস্তান সরকারের অস্বস্তিকর সম্পর্কের ভাঙন চ‚ড়ান্ত হয়।
এরপর জিহাদিরা পাকিস্তানপন্থী বা পাকিস্তানবিরোধী এ দু শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। পাকিস্তানবিরোধীরা নিরাপত্তা বাহিনী, বেসামরিক নাগরিকসহ হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। পাকিস্তানপন্থীরা আফগানিস্তানে আমেরিকান বাহিনীর বিরুদ্ধে ও ভারত শাসিত কাশ্মিরে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়।
জেইউডি ও জেইএম পাকিস্তানের প্রতি অনুগত হলেও তাদের আনেক যোদ্ধাই, বিশেষ করে জেইএমের বহু যোদ্ধা পাকিস্তান বিরোধী শিবিরে যোগ দেয়।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সাথে লড়াইরত পাকিস্তানি তালেবানের এক জ্যেষ্ঠ কমান্ডার বিবিসিকে বলেন যে বহু জেইএম সদস্য সরকারের বিরুদ্ধে তাদের জিহাদে যোগ দিয়েছে। যদিও পরে অনেকে মত পরিবর্তন করেছে তার পরেও তালেবানের মধ্যে সাবেক জেইএম ও আল কায়েদার সদস্যরা রয়ে গেছে।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী রাষ্ট্রবিরোধী জঙ্গিদের ক্ষমতা খর্ব করতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডি জানায়, সন্ত্রাসী হামলায় ২০১৩ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৫০০। আর ২০১৮-তে তা হ্রাস পেয়ে ৫৯৫ জনে দাঁড়িয়েছে।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে পাকিস্তানের প্রতি অধিক অনুগত জেইএম এবং এলইটি/জেইউডির মতো যেসব সংগঠন ভারতে হামলা অব্যাহত রেখেছে, তাদের সাথে কী করা হবে। জেইএম ২০১৬ সালে কাশ্মিরে দুটি বড় রকমের হামলা চালায়। অন্য দিকে এলইটির প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাইদ ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার পরিকল্পনাকারী বলে ভারতের অভিযোগ। অবশ্য তিনি তা অস্বীকার করেন।এ সময় বলা হয় যে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ অপকর্মে সহায়তা দিচ্ছে। তবে তারা সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে ধীরগতির কথা তারা অস্বীকার করে।
এখন ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের উদ্দেশ্যের পথে এসব জঙ্গিগ্রæপের কার্যকলাপ একটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জঙ্গি সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন বন্ধে যথেষ্ট না করার জন্য পাকিস্তানকে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের ‘গ্রে লিস্ট’ভুক্ত করতেও জঙ্গিরা ভ‚মিকা রেখেছে।
‘গ্রে লিস্ট’ তালিকাভুক্ত কোনো দেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা দুবার চিন্তা করতে পারে। আর পাকিস্তানের অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে জেইএম বা জেইউডির সরাসরি বিরোধিতা সহিংসতার নতুন জোয়ার সৃষ্টি করতে পারে।
গত বছর পাকিস্তানের বিশ্লেষক ও সামরিক নেতারা এসব জঙ্গি গ্রæপের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু সংগঠনকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার ধারণা প্রকাশ করেন। এর অব্যবহিত পরই, নির্বাচনে ইমরান খানের জয়ের আগে, জেইউডির (এবং এলইটি) প্রতিষ্ঠাতা সাইদের সমর্থকরা একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে। তারা একটি আসনও পায়নি। জেইএমের চেয়ে তাদের সাথে কথা বলা সহজ।
কয়েক বছরে সাইদ অ্যাম্বুলেন্স ও মৌলিক স্বাস্থ্য সেবার এক বিরাট দাতব্য নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। সেগুলোর অনেক কিছুই সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। পাকিস্তান পিস স্টাডি ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক আমির রানা বলেন, তার সমর্থকদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ সামান্যই। জেইউডি ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা সরকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আদালতে যাবে।
রানা বিবিসিকে বলেন, পাকিস্তানের কর্মকর্তারা কাশ্মির হামলার জন্য দায়ী জেইএমের সম্ভাব্য সহিংসতার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। ২০০২ সালে সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর বিচ্ছিন্ন কিছু কর্মী পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে হত্যার চেষ্টা করেছিল।
একটি সূত্র বিবিসিকে জানায়, সম্প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান ও রাজনীতিকদের একটি গ্রুপের মধ্যে বৈঠকে সামরিক নেতারা আশ্বাস দিয়েছেন যে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে তারা সাবধান করে দেন যে তাদের সংখ্যা এত বেশি যে শুধু শক্তি প্রয়োগ করে তাদের নির্মূল করা যাবে না, তারা তাদেরকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন।
জানা গেছে, এ বিষয়ে সরকারের প্রাথমিক প্রস্তাবে আছে এসব গ্রæপের সদস্যদের জঙ্গি মনোভাবমুক্ত করার জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গঠন, চাকরি প্রদান যেমন আধা সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি।
একজন সিনিয়র রাজনীতিক বিবিসিকে বলেন, পাকিস্তানে এখন এই উপলব্ধি রয়েছে যে কাশ্মিরে ‘প্রক্সি’ বাহিনী ব্যবহার উল্টো ফল দিচ্ছে। তাদের কর্মকাÐ ভারতের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, সম্ভব হলে শান্তিপূর্ণ পন্থায় জঙ্গিদের সাথে আলোচনা করতে হবে।
জঙ্গিদের সাথে সম্পর্কিত মাদরাসা ও মসজিদগুলোর নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান সরকারকে কিছুটা সুবিধা এনে দিতে পারে; কিন্তু পরে তারা কী করবে সেটাই হচ্ছে বিষয়। জঙ্গিদের কী প্রকৃতই বিচার করা হবে? সীমান্তের ওপারে কার্যক্রম চালানো থেকে গ্রুপগুলোকে প্রকৃতই বাধা দেয়া হবে? মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য কী সহিংসতার কর্মকাÐ করা থেকে জিহাদিদের দুর্বল করে ফেলা? নাকি এসব পদক্ষেপ তাদের বৈধতার আবরণ দেয়ার সহজ চেষ্টা?
আমি ইসলামাবাদের আরেকটি দারিদ্র্র্য কবলিত শহরতলিতে একটি মাদরাসা পরিদর্শন করি। এটি গত বছর হাফিজ সাইদের দাতব্য সংস্থার কাছ থেকে সরকার নিয়ে নিয়েছে। সেখানে আগের স্টাফরাই রয়ে গেছে। তারা একমাত্র যে পরিবর্তনের কথা জানালেন তা হচ্ছে একজন সরকারি কর্মকর্তা নিয়মিত মাদরাসা পরিদর্শন করেন। আর দানের অর্থের পরিবর্তে সরকার তাদের অর্থায়ন করছে।