ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সঙ্গে সাক্ষাৎ

ড. নূরুন নবী :

৩ নভেম্বর সকালে ভারতীয় ১০১ কমিউনিকেশন ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার সানৎ সিংয়ের অফিসে দেখা করতে গেলাম। এটা আমাদের তৃতীয় সাক্ষাৎ। কাদের সিদ্দিকীর প্রতিনিধি হিসেবে যখন জুলাই মাসে প্রথমে ভারতে আসি, তখন ব্রিগেডিয়ার সানৎ সিংয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। আগস্ট মাসে তার সঙ্গে দ্বিতীয়বার আলোচনা করতে আসি। সেই থেকে আমাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি তৃতীয় দফায় আমাকে দেখে খুবই উৎসাহিত ও আনন্দবোধ করলেন। কাদের ভাইয়ের লেখা চিঠি দিয়ে আমরা টাঙ্গাইলে মুক্তিবাহিনী ও শত্রুবাহিনীর সকল কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করলাম। আলোচনা শেষে ব্রিগেডিয়ার সানৎ সিং জানালেন, তার পরের দিন আমি ভারতীয় বাহিনীর কমিউনিকেশন ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল গিল-এর সঙ্গে আলোচনায় বসব। আমি তখন তুরা থেকে ১০ মাইল দূরে পাহাড়ের ওপর মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান করছিলাম। গত দুবারও যখন এখানে আসি, তখনো দেখতে পাই, প্রায় এক হাজার মুক্তিযোদ্ধা এখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। ভারতীয় বাহিনীর কয়েকশ সদস্য এই ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু এবার মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা যেমন কম, ভারতীয় সৈন্যদের সংখ্যাও কম দেখলাম। ক্যাম্পটি আমার কাছে ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।

পরদিন সকালে ব্রিগেডিয়ার সানৎ সিং ক্যাম্পে এসে আমাকে তুলে নিলেন। তিনি ড্রাইভারকে পেছনে বসিয়ে নিজেই জিপ চালাচ্ছিলেন। আমি তার পাশে বসা। তুরা শহরের অদূরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমিউনিকেশন ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারে গিয়ে পৌঁছালাম। মেজর জেনারেল গিল তার অফিসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। জিপ থেকে নেমে তার অফিসে পৌঁছে স্যালুট করে দাঁড়িয়েছি মাত্র। তিনি তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ব্রিগেডিয়ার সানৎ সিংয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন : ‘এ কি সেই নূরুন নবী?’ একটু মুচকি হেসে এগিয়ে এসে আমাকে এক ঝটকায় দুহাতে উপরে তুলে নিলেন।

জেনারেল গিলের সঙ্গেও এটা আমার তৃতীয় দফা সাক্ষাৎকার। প্রথম দুবার যখন দেখা করতে আসি, তখন আমার মুখে ছিল দাড়ি। মাথায় লম্বা চুল, পরনে লুঙ্গি ও শার্ট এবং পায়ে স্যান্ডেল। এবার ক্লিন শেভ, চুল ছাঁটা, পরনে প্যান্ট ও সোয়েটার এবং পায়ে বুট। আমাকে নিচে নামিয়ে জেনারেল গিল বসতে বললেন এবং কুশল বিনিময়ের পর বললেন, ‘টাঙ্গাইলে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি নিশ্চয় তোমাদের অনুকূলে তা আমি তোমার পোশাকের পরিবর্তন দেখেই অনুমান করতে পারছি।’ আমি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়ে কাদের ভাইয়ের দেওয়া এনভেলাপের মধ্যে একটি চিঠি ও তার নিজস্ব বাণীসহ একটি ছোট টেপরেকর্ড জেনারেল গিলের হাতে তুলে দিলাম। তিনি এবারও হেসে বললেন, তার অনুমান নিশ্চয় ঠিক।

তিনি বললেন, তার স্পষ্ট মনে আছে, দ্বিতীয়বার আগস্ট মাসে যখন আমি দেখা করি, তখন কাদের ভাইয়ের একটি ছোট্ট চিরকুট আমি জেনারেল গিলকে আমার ডান হাতের কনুইয়ের কাছে রাখা শার্টের ভাঁজ থেকে খুলে দিই। তিনি চিঠিটা হাতে নিয়ে ব্রিগেডিয়ার সানৎ সিংয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, এভাবে সংবাদ পরিবহন করা নিরাপদ কি না। ঘটনাটি আমার মনে পড়ল। আমি পুনরায় টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে সম্মতি জানিয়ে কাদের সিদ্দিকীর দেওয়া বাংলায় লেখা চিঠিটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়ে শোনালাম।

কাদের সিদ্দিকীর টেপরেকর্ডের বাণী তিনি হিন্দিতে রেকর্ড করেছিলেন। চিঠিতে ও টেপে কাদের সিদ্দিকী মূলত তার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনার ব্যাপারে তিনি বলেছেন, আমার কথাই তার কথা।
কাদের সিদ্দিকীর নির্দেশমতো যুদ্ধসংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করলাম। প্রথমে বললাম, টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম আগের চেয়েও অনেক সুশৃঙ্খলিত ও সুবিন্যস্ত। সাংগঠনিক কাঠামো, আমাদের সম্ভাব্য প্রয়োজনীয়তা এবং শত্রুবাহিনীর গতিবিধি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো। কাদের সিদ্দিকীর পক্ষ থেকে আমি দুটি বিষয় জেনারেল গিলের কাছে তুলে ধরলাম : (১) যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না। (২) যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে হানাদার বাহিনী ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ মাইল দূরে ১৬ হাজার মুক্তিবাহিনীর ওপর মরণাঘাত হানতে পারে। এ অবস্থায় আমরা কী ধরনের সাহায্য পেতে পারি।
জেনারেল গিল আলোচনা শেষে জানালেন, এ বিষয়ে তিনি এখন কিছুই বলতে পারবেন না। বললেন, কয়েক দিন পর তিনি আমার সঙ্গে আবার আলোচনা করবেন। আলোচনা শেষে তিনি অফিসার মেসে দুপুরের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।

আমরা তিনজনে যখন খাচ্ছিলাম, জেনারেল গিল বারবার টাঙ্গাইলের প্রাকৃতিক দৃশ্য, গাছপালা, নদী, বিশেষ করে মধুপুর-টাঙ্গাইল সড়কের আশপাশে কেমন গাছপালা, কোনো বাঁশঝাড় বা বড় বড় গাছের বন আছে কি না-সেসব ব্যাপারে প্রশ্ন করছিলেন। বিশেষভাবে জানতে চাইছিলেন, মধুপুর-টাঙ্গাইল সড়কের আশপাশের অঞ্চল আমাদের দখলে কি না এবং ওইসব এলাকার লোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কি না। এসব প্রশ্নের উত্তরে আমি যখন আমাদের অবস্থার বিবরণ দিচ্ছিলাম, তখন এসব প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝতে পারিনি।

পরের তিন দিন আমি ক্যাম্পে কাটালাম। ভারতীয় বাহিনীর এক বাঙালি ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এক তাঁবুতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দিন তিনটি খুব অস্বস্তির মধ্যে কাটল। কারণ কাদের সিদ্দিকীর দুটি প্রশ্নের উত্তর প্রথম দিন জেনারেলের কাছে পেলাম না। অথচ এ দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের ২০০ মাইল অভ্যন্তরে ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ মাইল দূরে ১৬ হাজার মুক্তিবাহিনীর ও প্রায় ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর জীবন-মরণ। আমার মানসিক অবস্থা হালকা করার জন্য বাঙালি ক্যাপ্টেন কোনো চেষ্টার ত্রুটি করলেন না। আমি রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করি শুনে কয়েকটা রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেটের ব্যবস্থা করলেন। তিনি আমাকে তুরা শহরের বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় নিয়ে গেলেন। তার পূর্বপুরুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছে বলেও জানালেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার যথেষ্ট জ্ঞান ও জানার ইচ্ছা দেখতে পেলাম। তিনি নিজেকে ভারতীয় বাহিনীর সিগন্যাল কোরের অফিসার বলে দাবি করলেও স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইলে দেখা হলে জানতে পেরেছিলাম, তিনি ভারতীয় বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার ছিলেন।

৭ নভেম্বর আবার আমি ব্রিগেডিয়ার সানৎ সিংয়ের সঙ্গে জেনারেল গিলের অফিসে গেলাম। তিনি আমাদেরকে তার গাড়িতে নিয়ে অফিস থেকে বের হলেন এবং তাদের হেডকোয়ার্টারের হেলিপোর্টে পৌঁছালেন। আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা হেলিকপ্টারে অন্য কোথাও যাচ্ছি কি না এবং আমাদের মিটিং কখন এবং কোথায় হবে। জেনারেল গিল জানালেন, আমাদের মিটিং এখানেই হবে এবং সেখানে একজন বিশেষ ব্যক্তি উপস্থিত থাকবেন। আমাকে হেলিপ্যাডের কিছুদূরে একটি ওয়েটিং রুমে বসতে দিয়ে জেনারেল গিল ও ব্রিগেডিয়ার সানৎ সিং হেলিপ্যাডের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর একটি সামরিক হেলিকপ্টার এসে অবতরণ করল। একজন শিখ সামরিক অফিসার হেলিকপ্টার থেকে অবতরণ করলেন। জেনারেল গিল ও ব্রিগেডিয়ার সানৎ সিং সামরিক কায়দায় তাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং ওরা তিনজন সরাসরি ওয়েটিং রুমে আমি যেখানে বসে ছিলাম, সেখানে উপস্থিত হলেন।

আমি দাঁড়িয়ে স্যালুট করে নিজের পরিচয় দিয়ে করমর্দন করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমি পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দাড়ি ও পাগড়ি পরিহিত তিনজন শিখ অফিসার, ওদের উচ্চতা ছয় ফুটের বেশি। আমি অনেকটা আকাশের দিকে তাকানোর মতো মাথা উঁচু করে তৃতীয় শিখ অফিসারটির মুখের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, ‘আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।’ আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে করমর্দন করলেন। জেনারেল অরোরার নাম পূর্বেই জানতাম। কিন্তু ওইদিন এভাবে দেখা হবে, তা ভাবতে পারিনি।

ইতিমধ্যে আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি। আমি নিজেকে তখন ২২ বছরের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মনে না করে ১৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও কাদের সিদ্দিকীর প্রতিনিধি হিসেবে চিন্তা করে আলোচনা শুরু করলাম। আমি ধরে নিয়েছিলাম, জেনারেল গিল অবশ্যই আমাদের আগের বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু জেনারেল অরোরাকে অবহিত করেছেন। তাই সরাসরি কাদের ভাইয়ের সেই দুটি বিষয়ের উল্লেখ করে বক্তব্য রাখলাম। জেনারেল অরোরা আমার প্রশ্নের জবাব সরাসরি না দিলেও আমি আমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম। আমাদের আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো : (১) আমি অতিসত্বর টাঙ্গাইলে ফিরে গিয়ে জেনারেল গিলের সঙ্গে যোগাযোগ করব। (২) আমার খবর অনুযায়ী ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কয়েকজন অফিসার টাঙ্গাইলে মুক্তাঞ্চলে আসবেন এবং আমাদের সঙ্গে অবস্থান করবেন। তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের। (৩) নভেম্বর শেষে অথবা ডিসেম্বরের প্রথমে টাঙ্গাইলের কোনো স্থানে ১০-১২ মাইল নিরাপদ এলাকার ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে প্রয়োজনে ভারতীয় ছত্রীসেনা অবতরণ করতে পারে। (৪) ঢাকায় পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের ওপর গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
আলোচনা শেষে জেনারেল অরোরা বারবার আমাকে এই আলোচনার গুরুত্ব এবং গোপনীয়তা সম্পর্কে সতর্ক করে দিলেন এবং বললেন যে এসব বিষয় আমি ও কাদের সিদ্দিকী ছাড়া যেন আর কেউ না জানে। জেনারেল অরোরার উদ্বেগ দেখে একপর্যায়ে জেনারেল গিল আমার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করলেন, আমি কাদের সিদ্দিকীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা। তার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করলেন, কাদের সিদ্দিকী যখন আহত হয়ে আগস্ট মাসে ভারতে চিকিৎসার জন্য আসেন, তখন তার মা, ভাই ও বোনদের দেখাশোনার দায়িত্ব তিনি আমার ওপর দিয়েছিলেন। জেনারেল অরোরা তা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, তিনি আমার বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি, শুধু এই বিষয়টির গোপনীয়তা অনুধাবন করার জন্য আমাকে সতর্ক করে দিচ্ছেন।

আমাদের আলোচনা প্রায় আধঘণ্টা স্থায়ী ছিল। বিদায় নেওয়ার সময় তিনি আবার দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন, আবার আমাকে মাথা উঁচু করে তার চোখের দিকে তাকাতে হলো। তিনি বললেন, ‘এটা তোমার মাতৃভূমির মুক্তিযুদ্ধ, তুমি এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারবে বলে আমি মনে করি। তোমার সঙ্গে টাঙ্গাইলে দেখা হবে, এই আশা করি। (২২ ডিসেম্বর জেনারেল অরোরার সঙ্গে মুক্ত টাঙ্গাইলে দেখা হয়েছিল।)

আমার বুঝতে বাকি রইল না ডিসেম্বর মাসে টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রীসেনা অবতরণের মানে কী। এভাবে এই সাক্ষাতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার কাছ থেকে বিজয়ের সংকেত পেয়েছিলাম।