ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতে দেশের রাজনীতি

নিজস্ব প্রতিনিধি : ভূরাজনৈতিক, সামরিক কারণে এবং অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক সম্পদ, বাণিজ্যিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশে বিশ্ব মোড়লসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর গোয়েন্দা তৎপরতা রয়েছে। আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ অনেক দেশে এই তৎপরতা ব্যাপক। এদের গোয়েন্দা কার্যক্রম কখনো এতটাই বিস্তৃত ও ভয়াবহ আকারে থাকে, যা ওই দেশটির স্বাধীন সত্ত্বার ওপর আঘাত হানে। আবার এদের ভূমিকার কারণে কোনো দেশের সরকারের টিকে থাকাও নির্ভর করে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে ইসরাইলের মোসাদ সর্বাধিক শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ পর্যন্ত অনেক বিষয়েই তাদের ওপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, চীন, মিয়ানমার, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক সামরিক অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে সিআইএ ও মোসাদ গভীরভাবে সক্রিয়। এই উপমহাদেশেও বেসামরিক, সামরিক আমলাতন্ত্র, শিল্প-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করে আসছে। এ উপমহাদেশের আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও এদের যোগাযোগ রয়েছে। তথ্য, উপাত্ত বিনিময় হয়।
পাকিস্তানের সঙ্গে সিআইএর সুদীর্ঘ দিনের এই সম্পর্কে দৃশ্যত ফাটল ধরেছে। পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় মদদে জঙ্গি উত্থান ও তাদের ভয়াবহ তৎপরতাই এর কারণ। অন্যদিকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং-‘র’ এর সঙ্গে সম্পর্ক অনেক বেশি উন্নত। নিজস্ব শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক থাকার পরও সিআইএ বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহে ‘র’ এর ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ও আস্থাশীল।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে বিদেশি কূটনীতিকদের ব্যাপক তৎপরতা দৃশ্যমান। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছেন। বিএনপির দিক থেকেই বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে অধিকতর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছে। বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত নির্বাচনে অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটেই বিদেশিদের ওপর দলটির নির্ভরশীলতা বেড়েছে। রাজনৈতিক সংকট সুরাহার লক্ষ্যে সরকারকে আলোচনায় বসার জন্য বিএনপির নেতারা অব্যাহতভাবে বলে আসছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যও সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ ছাড়া সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং বিএনপি তাতে অংশ না নিলেও বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী নির্বাচন হলে উল্লিখিত শক্তিসমূহ সেই নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারকে মেনে নেবে না এমন কথাও কেউ বলেনি। বিএনপি তার দেশীয় ও বিদেশি মিত্রদের দিয়ে সরকারের ওপর কার্যকর প্রভাব ও চাপ সৃষ্টির চেষ্টাও করছে। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কূটনৈতিক তৎপরতার সামনে বিএনপি ও তার মিত্রদের সফলতা নিয়ে বিএনপির একটি প্রভাবশালী অংশে সংশয় দানা বেঁধে উঠছে। অভ্যন্তরীণভাবে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে বিএনপি সরকারকে আলোচনা ও সমঝোতায় আসতে বাধ্য করতে পারলে পরিস্থিতি ভিন্নতর হবে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, বিএনপি সরকারবিরোধী সব শক্তিকে এক কাতারে শামিল করার জোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। ড. কামাল, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আ স ম রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বাসদসহ আরো কয়েকটি দলের সঙ্গে বিএনপির নেতারা কথা বলেছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম খান আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। এসব আলোচনায় দুই ধাপ অগ্রগতি হওয়ার পর ৭২ ঘণ্টা না যেতেই তিন ধাপ পিছিয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি শিবিরে এ নিয়ে সংশয়-সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। সরকারি দল ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখছে বলেই তাদের ধারণা। বাইরের একটি প্রভাবশালী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এ ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর বলে জানা যায়। ড. কামাল হোসেন ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মধ্যে নেতৃত্ব ও আগামীতে সম্ভাব্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এখনই প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। জামায়াতকে নিয়ে জোটবদ্ধ আন্দোলন, নির্বাচন সম্ভব নয় বলে দলগুলোর পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবেই বিএনপিকে জানিয়ে দেওয়া হয়। ২০ দলীয় জোটভুক্ত না হয়ে পৃথক জোটগত অবস্থান থেকে সমান্তরাল কর্মসূচি পালন ও সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব বিএনপি বিশেষ বিবেচনায় নিয়েছে। ঈদের পরই আলোচনায় বসে সমান্তরাল কর্মসূচি ও বৃহৎ সমঝোতায় নির্বাচন, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র, সরকারব্যবস্থা, ক্ষমতার অংশীদারত্বসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর ফয়সালা করার কথা। কিন্তু হঠাৎ করেই ড. কামাল হোসেন বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে পৃথক জোটগত বা দলগত অবস্থান থেকে কর্মসূচি পালন ও নির্বাচনে যাওয়াকে শর্তযুক্ত করেছেন। তার প্রথম শর্তই হচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য কোনো সম্পর্ক রাখা যাবে না। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক চুকাতে হবে। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহারের দাবি দলীয়ভাবে ছাড়া জোটগতভাবে না করার দাবি তাদের। কামাল হোসেনের এসব প্রকাশ্য ঘোষণা বিএনপির নেতাদের বিস্মিত ও বিব্রত করেছে।
নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ছাড়াও জামায়াত প্রসঙ্গ বিকল্পধারার পক্ষ থেকে প্রধান ইস্যু হিসেবে আনা হয়েছে। প্রথম দফা আলোচনায়ই বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও তার পুত্র মাহী বি চৌধুরীর পক্ষ থেকে জামায়াতকে ২০ দলীয় জোটের বাইরে রাখার কথা বলা হয়। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জোরালোভাবেই বলেছেন, জামায়াতকে নিয়ে কোনো ঐক্য, কোনো রকম সমঝোতা হবে না। আ স ম রবের অবস্থানও অভিন্ন।
ড. কামাল, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী ও রবের বিএনপির সঙ্গে কোনো রকম সমঝোতা গড়ে তোলার বিপক্ষে সরকারের তৎপরতা চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে এই সংস্থার সুগভীর আস্থাশীল সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ভারতের উন্নত সম্পর্ক রয়েছে। কাদের সিদ্দিকী রাজনৈতিক প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে ড. কামালকে প্রভাবিত করে আসছেন। বদরুদ্দোজা চৌধুরী ভারতঘেঁষা বলে শুরু থেকেই বিএনপি শিবিরে পরিচিত। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে জামায়াত পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করে তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। জামায়াতকে তারা প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। মৃত্যুদ-ে দ-িত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, প্রয়াত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন এবং দলগতভাবে জামায়াত বাংলাদেশে পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষাকারী ও কট্টর ভারতবিরোধী বলে পরিচিত ভারতীয়দের কাছে। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সব রকম প্রভাবমুক্ত রাখতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা পরিকল্পিত কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা সব প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে এরা গভীর সখ্য গড়ে তুলেছে। এরই অংশ হিসেবে অধিকাংশ দলের ও ব্যাপক সংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ও সরকারকে নানাভাবে পরামর্শ ও প্রকাশ্য, গোপন সহায়তা দিচ্ছে ভারত সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থা। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, ড. কামাল, বি চৌধুরী, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জাসদ (রব) জেপি, জাসদ (ইনু), এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়াও বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ অনেক দিনের। কারো সঙ্গে সম্পর্ক তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে। রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ হলেও ‘র’ এর সঙ্গে বিশ্বস্ত সম্পর্ক দুই পক্ষই বজায় রেখে চলছে। বিএনপির কোনো কোনো নেতার সঙ্গেও তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। কথিত আছে জাসদের জন্মই হয়েছিল ‘র’ এর হাতে। বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ সৃষ্টিই ছিল উদ্দেশ্য। এরশাদ ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে তাদের নেপথ্য ভূমিকা ছিল বলেই অধিকাংশ রাজনীতিসচেতন মানুষের বিশ্বাস। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় এরশাদের ভূমিকা এই সম্পর্কে ফাটল ধরালেও পরবর্তী সময়ে এরশাদ তা শুধরে নেন। ভারত সরকার এরশাদকে দাওয়াত দিয়ে কিছুদিন আগে ভারতে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের বিদ্যমান এবং আগামীর সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচনসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে এরশাদের সঙ্গে ভারতের নেতারা কথা বলেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। এরশাদ মূলত ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ‘র’ এর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আগামী ৬ সেপ্টেম্বর তিন দিনের সফরে ভারতে যাওয়ার কর্মসূচি ছিল। সড়ক পরিবহন-সংক্রান্ত আঞ্চলিক এক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য তার নয়াদিল্লি যাওয়ার কথা থাকলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে তিনি ৬ তারিখে যাচ্ছেন না। যাবেন সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে। ভারতের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিজেপির নেতার সঙ্গে বৈঠক করবেন। মূল বৈঠক হবে ‘র’ এর প্রধানের সঙ্গে।
রাজনীতিবিদ, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রীদের পাশাপাশি বাংলাদেশের সামাজিক, পেশাজীবী শক্তিগুলোর সঙ্গে ‘র’ এর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। নির্বাচন ও নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সম্ভাব্য গোলযোগময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে মতবিনিময় ও পরামর্শ দিচ্ছেন। সামাজিক শক্তিগুলোকে প্রভাবিত করতে তারা ভূমিকা রেখে চলেছেন। আঞ্চলিক স্বার্থে সিআইএ এবং ‘র’ সমন্বিত ও পারস্পরিক সমঝোতাপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলেই জানা যায়।