ভার্চুয়ালই অ্যাকচুয়াল লাউই কদু

রম্য

মোস্তফা কামাল


আসল-নকল আপেক্ষিক। আসলই নকল, নকলই আসল। সত্যিই মিথ্যা, মিথ্যাই সত্য। মোটকথা যাহা বায়ান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন। আপনার লাউ, আমার কদু। তিনি পতি, আপনিও পতি। সভাপতি বা অন্য কোনো পতি। কারও না কারও পতি। সব পতিতেই গতি আছে। থাকছে গদির গ্যারান্টিও। কোনোটাই কথার কথা নয়, খাসকথা। এ তরিকায় অ্যাকচুয়াল-ভার্চুয়াল তফাত প্রায় শেষ। ভার্চুয়ালও এখন অ্যাকচুয়াল। বরং অ্যাকচুয়ালের চেয়ে ভার্চুয়াল কখনো আরও পোক্ত-শক্ত, টেকসই-লাগসই।
ভার্চুয়ালকে অপার্থিব, অস্তিত্বহীন, অবাস্তব, কৃত্রিম, ম্যাজিক বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবেন? পারলে দেন তো দেখি? দেশে দেশে এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ভার্চুয়াল বৈঠক হচ্ছে। ওসব বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের সঙ্গে হচ্ছে বিশাল অঙ্কের বরাদ্দও। আমাদের একনেকে ভার্চুয়াল বৈঠকে বিভিন্ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। কেউ বাধ সাধছে? বরাদ্দের টাকা আটকে দেওয়া হচ্ছে? কেউ বলছে, ভার্চুয়ালের টাকা অ্যাকচুয়ালে দেওয়া হবে না? প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়ালে বাটনের এক টিপে উদ্বোধন করে দেওয়া ১০০ সেতুর কাজ এগোচ্ছে। ভার্চুয়াল প্রতীকী হয়ে থাকলে এগুলো প্রতীক বা সিম্বল হয়েই থাকত।
মোবাইলে বিকাশ-নগদ নানান নামে ভার্চুয়ালে পাঠানো টাকা অ্যাকচুয়ালে পেয়ে যাচ্ছেন গ্রাহক। এ চিন্তা ও গতিধারায় সামনের দিনগুলোতে নির্বাচনও ভার্চুয়ালে করার তাগিদ আছে। ঘরে বসেই ভার্চুয়ালে ভোট দেওয়ার মজাই হবে আলাদা। ভার্চুয়াল মানে অকৃত্রিম, অবাস্তব, পরোক্ষ, ম্যাজিক, অপার্থিব; আর অ্যাকচুয়াল অর্থ আসল, কার্যত, কার্যসিদ্ধ, যথার্থ, ফলত ইত্যাদি অনুবাদ করার দিন শেষ। ভার্চুয়ালকে সোশ্যাল মিডিয়াভুক্ত করে বাকি মিডিয়াগুলোকে আনস্যোশালে ঠেলে ফেলার একটি চর্চাও হাল যাপিত জীবনে বেশ খাটছে। নইলে খাটানো হচ্ছে। লাইক, শেয়ার, কমেন্ট কিংবা টুইট-রিটুইটের ঘেরাটোপের রহস্য এখানেই। দেশে দেশে যাপিত জীবনের সিংহভাগ সময়েই তাই সবুজ আর নীল আলোর দুর্নিবার হাতছানি।
এ জগতের অধিবাসী হতে মধ্যম মানের একটি স্মার্টফোনই যথেষ্ট। ব্যক্তিগত, পারিবারিক এমনকি সামাজিক-রাষ্ট্রীয় তথ্য, হিসাব-নিকাশ সবই এসে যাচ্ছে কবজায়, হাতের মুঠোয়। সিংহভাগের কাছে এটি আশীর্বাদ। জনা কতেক একে অভিশাপ ভাবলেই-বা কী? এতে কার কী যায়-আসে? তবে মাঝেমধ্যে গোল পাকে। গন্ডগোল বাধে। তথ্য-বর্ণনা নিজের পক্ষে না গেলে ভার্চুয়াল খারাপ হয়ে যায়। এটি একটি ফালতু মিডিয়া, সময় নষ্ট, চরিত্র নষ্টসহ কত অভিব্যক্তি তখন। ফেসবুক ও ইউটিউবে নিরাপদ কনটেন্ট তৈরির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি মনে করা হয়। এর আগ পর্যন্ত একে ডিজিটাল-স্মার্টের প্রমাণ উল্লেখ করে নিজেদের কৃতিত্ব জাহিরে কোনো কমতি হয় না। নিজে বা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কৃতিত্ব থামিয়ে কেবল নিয়ন্ত্রণ নয়, বিশ্বের দেশে দেশে তা কীভাবে চালানো হয়, সেই সবকও দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে আরও কিছু ইন্টারেস্টিং বিষয় রয়েছে। এখানে টেলিভিশন, রেডিওসহ সম্প্রচার মাধ্যমগুলো তদারকির দায়িত্ব তথ্য মন্ত্রণালয়ের। সোশ্যাল মিডিয়াসহ ইন্টারনেটভিত্তিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মসহ অন্যান্য মাধ্যমের দায়িত্ব ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের। দুটি বিষয় ভিন্ন এখতিয়ারভুক্ত হওয়ায় দুই মন্ত্রণালয়কে আলাদা নীতিমালা বানাতে হচ্ছে।
এর মাঝে আবার ফেসবুকের বিকল্প তালাশের তাড়নাও ভর করেছে। বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের মধ্যে বাংলাদেশের সংখ্যা ৫ কোটি ২৮ লাখের ঘরে। সক্রিয় ব্যবহারকারীদের মাঝেমধ্যে বাগড়ায় পড়তে হয়। সার্ভার ডাউনের কারণে ফেসবুকে এন্ট্রি করা যায় না। ‘সরি, সামথিং ওয়েন্ট রং, উই আর ওয়ার্কিং অন ইট অ্যান্ড উই উইল গেট ইট ফিক্সড অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল’ ধরনের মেসেজে মেজাজ বিগড়ে যায়। মাথার চুল ছিঁড়তে হয়। গেল বছরের অক্টোবরে বিপর্যয় ঘটে হোয়াটসঅ্যাপেও। বিশ্বব্যাপী হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২০ কোটি। টানা ওই ছয় ঘণ্টা হোয়াটসঅ্যাপ অচল থাকার সময় এই বিশাল জনগোষ্ঠী হাড়ে হাড়ে কষ্টটা মালুম করেছেন অ্যাকচুয়ালে। এর আগে ২০০৮ সালে ফেসবুক একবার কয়েক ঘণ্টার বিপর্যয়ে পড়ে। তখন ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল আট কোটি। এরপর ২০১৯ সালে ফেসবুক এক ঘণ্টার জন্য এ রকম পরিস্থিতিতে পড়লে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সার্ভারের একটি কনফিগারেশনকে দায়ী করে দায় এড়িয়ে যায়। এই ঝক্কি এড়াতে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ফেসবুকের বিকল্প সোশ্যাল মিডিয়া তালাশ করছেন।
এই তালাশ সফলতার মুখ দেখতেও পারে। সেই সাফল্য না এলেও ভার্চুয়ালের অগ্রগতি থেমে থাকবে না। সেখানে বিশেষ করে ফেসবুক ভালো-মন্দের আপেক্ষিকতায় এগোতেই থাকবে। সেখানে সহি-শুদ্ধরা থাকবেন। দাপটের সঙ্গে থাকবে উজবুকেরাও। তাদের উভয়ের রসায়নে ফেসবুক আজ যেন কাজের দলিল।
ফেসবুকে না-থাকা যেন দম নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে সলিলে সমাধির মতো ঠেকছে কারও কারও কাছে। কেবল উপস্থিতি জানান দেওয়া নয়, ভাইরাল হওয়ারও কত সাধনা! পোস্টে বেডরুম, বাথরুম, কিচেন আর কর্মস্থল- সব ফেসবুকে একাকার করে ফেলছে উজবুক প্রজাতি। এখানে নতুন এক ট্রেন্ড। ছোট-বড়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সবাই ফ্রেন্ড। লাজ-শরমের মাথা খেয়ে চলে লাইক শেয়ার। কমেন্টে কোনো কেয়ারই করা লাগছে না। সবাই ডোন্ট মাইন্ড সোসাইটির সদস্য। অ্যাকচুয়ালে মলা-পুঁটি হলেও ফেসবুকে রুই-কাতলা সেলিব্রিটি হয়ে যাচ্ছে। এর মজাই আলাদা। সবই অ্যাকচুয়াল।
ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড-জগতে কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারে না মনে করলেও অ্যাকচুয়ালে আরও কত কিছুই হয়ে যাচ্ছে। পরিচয়ের পর বিয়ে-ব্যবসাসহ কত কিছুই হয়ে যাচ্ছে এই মিডিয়ার বদৌলতে। কেউ স্বভাব গুনে, কেউ রূপের মোহে পড়ে বিবাহিত নারীকে বিয়ে করে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। আবার অনেকে প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে ব্ল্যাকমেলের শিকার হচ্ছেন। আবেগী বা প্রবাসীদের টার্গেট করে এ ধরনের ফাঁদ বেশি পাতা হচ্ছে। ফেসবুকের রিলস ভিডিওতে এ ধরনের পাতা ফাঁদে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কিন্তু ভেজাল হলে দোষটা ফেসবুকের। আগে এ জন্য মিডিয়া সেন্টারে ধরনা দিতে হতো। কোরবানির পশু পর্যন্ত মিলছে। এখন পর্যন্ত বাকি আছে কেবল রান্না করে বাসায় পৌঁছে দেওয়া। অনলাইন নামের ভার্চুয়ালে গাড়ি, বাড়ি, সোনা-দানা সবই মিলছে অ্যাকচুয়ালে। শিশুদের পাঠ্যবইতে ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো পাঠ-পঠন পর্যন্ত মিলছে এখানে। ক্লাসে পড়ানোর মতো শুদ্ধ সুন্দর বই না থাকলেও, লেখক-চিত্রকর-সম্পাদকের আকাল পড়লেও, দেশে এত ছাপাখানা থাকতে বিদেশ থেকে বই ছেপে আনতে হলেও, কনটেন্ট নিয়ে বারবার হাস্যরসের ঢেউ উঠলেও তা আর গুরুতর ঘটনার মধ্যে থাকছে না। তাহলে কোন যুক্তিতে, কোন দুঃখে একে ভার্চুয়াল নামে ডাকা? এন্তার সুযোগ আছে বলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুন্দরী তরুণীরা একধরনের প্রতারণার ফাঁদ পাতছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এ ধরনের কয়েক নারী প্রতারককে আটক করেছে। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে মেলে চাঞ্চল্যকর তথ্য। আটক এক তরুণী পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, বিভিন্ন বিত্তশালী ব্যক্তিকে টার্গেট করে মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে পাশাপাশি তাদের ফেসবুক আইডি নিয়ে রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়। পরে তাদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে কৌশলে একটি সুনির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে ফাঁদে ফেলে। আর অন্তরঙ্গ মুহূর্তে এ চক্রের অন্য সদস্যরা রুমে প্রবেশ করে। তাদের এ চক্রে ভুয়া পুলিশ এমনকি ভুয়া সাংবাদিকও থাকে। তারা অন্তরঙ্গ সময়ে রুমে ঢুকে টার্গেট করা ব্যক্তির সঙ্গে জোরপূর্বক আপত্তিকর ছবি তোলে। আর ওই ছবি পত্রিকায় প্রকাশের ভয় দেখিয়ে মামলার হুমকি দেওয়া হয় ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে। পরে ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেন-দরবারের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়। এ ধরনের শিকার অনেক। কিন্তু এই শিকাররা কিন্তু শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত দমেন না।
হালে শুরু হওয়া ফেসবুক রিলস ভিডিওর বাজারও। রিলস ভিডিওতে আপলোড করা হচ্ছে মেয়েকণ্ঠে ‘যারা আমার সঙ্গে কথা বলতে চান তারা কমেন্টস বক্সে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেখানে গিয়ে কল করুন’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে যে ভিডিওর সঙ্গে মেয়ের ছবি দেওয়া হচ্ছে, সেটি তার প্রকৃত ছবি নয়। বিভিন্ন স্থান থেকে ছবি সংগ্রহ করে সেটিকে মোন গ্রাফিক্সে কণ্ঠ জুড়ে দেওয়া ফাঁদে পা দিয়ে ধন্য হচ্ছেন কতজন। এসব সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যবহৃত শব্দগুলোও যাপিত জীবনে ব্যবহার হচ্ছে। ছেলে তার মাকে সম্মানের সঙ্গেই বলে দিচ্ছে, মা, তোমার হাতের স্পিড স্লো কেন? তাড়াতাড়ি খাবার ডাউনলোড করো। পাকস্থলী আপডেট দেব। জবাবে মা বলছেন, নোটিফিকেশন চেক করো। টেবিলে অনেক আগেই খাবার শেয়ার করে ফেলছি। বাবা যে কবে তার মেয়ের প্রেমিককে বলবেন, তোমার মতো কম ফলোয়ারওয়ালা ছেলের সঙ্গে আমি আমার মেয়ে বিয়ে দেব না। জবাবে মেয়ের প্রেমিক বলবে, ফলোয়ার দিয়ে কখনো ভালোবাসা মাপা যায় না। আমার ফলোয়ার কম হতে পারে কিন্তু ফ্রেন্ডলিস্টের ফ্রেন্ড পাঁচ হাজার, যা দিয়ে আপনার মেয়ের ছবিতে অনেক লাইক দিয়ে সুখে রাখতে পারব।
টুইটার, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন ব্রিটিশ এক লেখক। বুকার পুরস্কার বিজয়ী লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকবসনের উদ্ধৃতিতে জানা যায়, স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং প্রচুর পরিমাণে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কারণে নাটকীয়ভাবে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। তারা হারাচ্ছে বইপড়ার অভ্যাস। এ ক্ষেত্রে তিনি শুধু তরুণ প্রজন্মের কথাই বলেননি, বরং সেই সঙ্গে নিজের অবস্থাও তুলে ধরেছেন। তিনি নিজেও বইয়ের প্রতি আর তেমন মনোযোগ দিতে পারেন না। তার মনোযোগের একটা অংশও চলে যায় মোবাইল কম্পিউটারের স্ক্রিনের পেছনে। তার আশঙ্কা, আগামী ২০ বছরের মধ্যে এমন সব শিশু পাওয়া যাবে, যারা পড়তে পারবে না। চোখ ও মনে তাদের পঠনের সক্ষমতাই থাকবে না। সেই শঙ্কা বাস্তব বা অ্যাকচুয়াল হলে কোন দশায় যাবে বাছাধনেরা? লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন