মারুফ খান
শরৎ বাংলাদেশের কোমল ও স্নিগ্ধ এক ঋতু। শরৎঋতুর রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের ছয়টি ঋতু ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন রূপের পসরা নিয়ে হাজির হয়। এক-এক ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ফুলে ও ফলে, ফসলে ও সৌন্দর্যে সেজে ওঠে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর আর কোন দেশের প্রকৃতিতে ঋতুবৈচিত্র্যের এমন রূপ বোধ হয় নেই।
বর্ষাকন্যা অশ্রুসজল চোখে বিদায় নেয় শ্রাবণে। ভাদ্রের চোখে সূর্য মিষ্টি আলোর স্পর্শ নিয়ে প্রকৃতির কানে কানে ঘোষণা করে শরতের আগমন বার্তা; থেমে যায় বর্ষামেয়ের বুকের ভেতর দুঃখ মেঘের গুরুগুরু। ঝকঝকে নীল আকাশে শুভ্র মেঘ, ফুলের শোভা আর শস্যের শ্যামলতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে শরৎ। প্রকৃতির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে কবি গেয়ে ওঠেন:
‘আজি ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা ’
শরৎ যে এত সুন্দর আগে হয়ত বাঙালি জানতোও না। রবীন্দ্রনাথই তাঁর গান, কবিতার মাধ্যমে সবাইকে শরৎকাল উপভোগ করতে শিখিয়েছেন। তাঁর গানগুলো শুনলেই শরতের সমস্ত সৌন্দর্য ধরা পড়ে। শরৎ হচ্ছে চমৎকার মেঘের ঋতু, স্পষ্টতার ঋতু। কেননা শরতের আকাশ থাকে ঝকঝকে পরিষ্কার। নীল আকাশের মাঝে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ যেন ভেসে বেড়ায়। গ্রামের বধূ যেমন মাটি লেপন করে নিজ গৃহকে নিপুণ করে তোলে, তেমনি শরৎকাল প্রকৃতিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। বর্ষার পরে গাছগুলো সজীব হয়ে ওঠে। আকাশে হাল্কা মেঘগুলো উড়ে উড়ে যায়।
ভাদ্র-আশ্বিন এ দু মাস বাংলাদেশে শরৎকাল। শরতের সৌন্দর্য বাংলার প্রকৃতিকে করে রূপময়। গাছপালার পত্রপল্লবে গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার ফিকে হয়ে আসতেই পাখপাখালির দল মহাকলরবে ডানা মেলে উড়ে যায় নীল আকাশে। আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মত উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। শিমুল তুলোর মতো ভেসে চলে সাদা মেঘের খেয়া। চারদিকে সজীব গাছপালার ওপর বয়ে যায় শেফালিফুলের মদির গন্ধভরা ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়া। শিউলি তলায় হাল্কা শিশিরে ভেজা দুর্বাঘাসের ওপর চাদরের মত বিছিয়ে থাকে সাদা আর জাফরন রঙ মেশানো রাশি রাশি শিউলিফুল। শরতের ভোরের এই সুরভিত বাতাস মনে জাগায় আনন্দের বন্যা। তাই খুব ভোরে কিশোর- কিশোরীরা ছুটে যায় শিউলিতলায় ।
সূর্য ওঠে সোনার বরণ রূপ নিয়ে। নির্মল আলোয় ভরে যায় চারদিক। আমন ধানের সবুজ চারার ওপর ঢেউ খেলে যায় উদাসী হাওয়া। আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। ফসলের মাঠের একপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর রূপালী ধারায় সূর্যের আলো ঝলমল করে। নদীর তীরে কাঁশবনের সাদা কাশফুল কখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে। মনে পড়ে কবির লেখা চরণ-
‘পুচ্ছ তোলা পাখির মতো কাশবনে এক কন্যে,
তুলছে কাশের মযূর- চূড়া কালো খোঁপার জন্যে।’
কাঁশফুলের মনোরম দৃশ্য থেকে সত্যিই চোখ ফেরানো যায় না। ভরা নদীর বুকে পাল তুলে মালবোঝাই নৌকা চলে যায়। ডিঙি নাও বইতে বইতে কোনো মাঝি হয়তো বা গেয়ে ওঠে ভাটিয়ালি গান। পুকুরপাড়ে আমগাছের ডালে মাছরাঙা ধ্যান করে। স্বচ্ছ জলে পুঁটি, চান্দা বা খলসে মাছের রূপালী শরীর ভেসে উঠলে সে ছোঁ মেরে তুলে নেবে তার লম্বা ঠোঁটে। নদীর চরে চখাচখি , পানকৌড়ি, বালিহাঁস বা খঞ্জনা পাখির ডাক। কলসি কাঁথে মেঠো পথে হেঁটে চলে গাঁয়ের বধূ। ফসলের খেতে অমিত সম্ভাবনা কৃষকের চোখে স্বপ্নে ছাওয়া সবুজ ধানখেতটা একবার চেয়ে দেখে কৃষক।
শরৎ মানেই নদীর তীরে কাঁশফুল। শরৎ মানেই পূজোমন্ডপে ঢোলের বাদ্যি, গাছে গাছে হা¯œুহানা আর বিলে শাপলার সমারোহ। শরৎ মানেই বাতাসে গাছের পাকা তালের গন্ধ। সেই তাল দিয়ে তৈরি পিঠা, পায়েস। আর ক্ষেতে ক্ষেতে আমন ধানের বেড়ে ওঠা চারা। বিলের জলে নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে সাদা ও লাল শাপলা। সকালের হাল্কা কুয়াশায় সেই শাপলা এক স্বপ্নিল দৃশ্যের আভাস আনে। আলো চিকচিক বিলের জলে ফুটে ওঠে প্রকৃতির অপর লীলা ।
শরতের এই স্নিগ্ধ মনোরম প্রকৃতি মানবজীবনেও এক প্রশান্তির আমেজ বুলিয়ে দেয়। কৃষকদের হাতে এ সময় তেমন কোনো কাজ থাকে না। অফুরন্ত অবসর তাদের। মাঠভরা সোনার ধান দেখে কৃষকের মনে দাদা বেঁধে ওঠে আসন্ন সুখের স্বপ্ন। শহরের মানুষ ও অবকাশ পেলে শরতের মনোরম প্রকৃতি উপভোগ করার জন্য গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায়। নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা আর নদীতীরে সাদা কাশফুল, ভোরে হাল্কা শিউলিভেজা শিউলিফুল সব মিলিয়ে শরৎ যেন শুভ্রতার ঋতু। শরৎকালে রাতের বেলায় জ্যোৎস্নার রূপ অপরূপ। মেঘমুক্ত আকাশ থেকে কল্প কথার পরীরা ডানা মেলে নেমে আসে পৃথিবীতে। শরতের জ্যোৎস্নার মোহিত রূপ নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। বলা যায়, শরৎ বাংলার ঋতু – পরিক্রমায় সবচেয়ে মোহনীয় ঋতু। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে গ্রামে-গঞ্জে কাঁশফুলের আধিক্য কমে গেছে। তাই মনে বড় কষ্ট নিয়ে বলতে চাই, আমরা মানুষরা শুধু লোভীর মতো প্রকৃতির কাছ থেকে খাদ্যশস্য ও নানাকিছু চাই। কিন্তু প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিছুই করি না। যেমন আগে প্রায় প্রতিটি গ্রামে বটগাছ দেখা গেলেও এখন তেমনটা চোখে পড়ে না। আমরা লোভী মানুষেরা নিজের প্রয়োজনে সেগুলো কেটে ফেলেছি। অথচ আগে এই বটগাছকে কেন্দ্র করে কত উৎসব হয়েছে। বটগাছের ছায়ায় মানুষ বিশ্রাম নিয়েছে, আশ্রয় নিয়েছে কতরকম পাখি আর পতঙ্গ; কিন্তু এখন আর সে সব নেই। একমাত্র ভালবাসাই পারে সব কিছুকে বাঁচিয়ে রাখতে। তাই ‘আমাদের প্রকৃতির প্রতি ‘আমাদের ভালবাসা’ যেন ফুঁরিয়ে বা হারিয়ে না যায়।
সংগঠক ও সংস্কৃতিকর্মী, লস এঞ্জেলেস।