শামসাদ হুসাম
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলকে স্বাধীনতার সুতিকাগার হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকেন ইতিহাসবিদরা। আসলে ১৯৪৭-এর ভারত বিভক্তির সময়ে যে স্বপ্নপূরণের আশা নিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের তখমা গায়ে নিয়ে পথ চলার যে সূচনা করেছিল, অল্পদিনের মধ্যে সে স্বপ্নের অপমৃত্যুর ধাক্কা সহ্য করতে হলো সাত কোটি বাঙালিকে।
ভাষা বিতর্কে জড়িয়ে পড়া সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ, যার জন্মটাই হয়েছিল দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, একটা ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে। প্রাথমিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত একটি দেশ, যার নাম ছিল- পাকিস্তান; সেই দেশের দুই অংশের মাঝখানে ১৪শ’ মাইলব্যাপী ভারতবর্ষের সুবিশাল সীমানা। ভৌগলিকভাবে এই ধরনের সীমানা দেয়ালের অবস্থানটাই ছিল একটা ভীতিকর বিষয়। দুটি রাষ্ট্রের জন্যই। তাছাড়া বহুভাষী অধ্যুষিত তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিম অংশের জনমানুষের মধ্যে পাঞ্জাবি ভাষীর হার ছিল ২৮.৫৫ ভাগ, পশতুন ৩.৪৮, হিন্দি ভাষী ৫.৪৭ ভাগ, বেলুচ ১.২৯ ভাগ আর উর্দু ৩.২৭ ভাগ। অন্যদিকে পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে তখন বাঙালি জনসংখ্যার হার ছিল ৫৬.৪০ ভাগের মতো। মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিষয়টি উপেক্ষা করে যখন তৎকালীন পাকিস্তানের মূল ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তিন শতাংশ উর্দুর পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করলেন, তখনই পূর্ব পাকিস্তানের আপাময় জনগণের (কতিপয় মুসলিম লীগপন্থী ছাড়া) সামনে প্রতিবাদ করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ আর খোলা ছিল না। ৫৪ হাজার বর্গমাইলজুড়ে প্রতিবাদের সেই স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়লো একবারে প্রতিটি আনাচে-কানাচে। প্রাথমিকপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের ভূমিকা সবার কাছে একটি আবেদন নিয়ে আসলে দেখা গেলো সারা বাংলাদেশের জনগণ সেটাকে গ্রহণ করেছিলেন প্রশ্নাতীতভাবে। সেই জনগণের মধ্যে নারীদের ভূমিকা কোনো অংশেই কম ছিল না।
প্রাথমিকপর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণটা সবার চোখে পড়ে, যখন ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙার ক্ষেত্রে একটা সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সেদিন স্কুল-কলেজের মেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সেই আমতলার সভায় যোগ দিয়েছিলেন। আসলে এই আন্দোলনটা চলমান ছিল ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের সময়কালে। যদিও সময়টা খুব দীর্ঘ ছিল না কিন্তু দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পুরো বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের মনে একধরণের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়। মহিলাদের ভূমিকা সেই অংশে ব্যতিক্রমী বিষয় ছিল না। অনেকটা অস্তিত্বের লড়াই হিসেবেই বিবেচনা করেছেন তারা। এই ১৪৪ ধারা ভাঙার ক্ষেত্রে যেসব মহিলা বা ছাত্রীরা তখন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন- রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া খাতুন, সুফিয়া আহমেদ, শামসুন নাহার, নাদেরা চৌধুরী, কাজী আমিনা, সারা তৈফুর প্রমুখ। এরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন তখন।
এছাড়া ঢাকা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুনের নাম খুব সহজে সামনে আসে। কারণ ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবেও তার একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল সেই সময়ে। এছাড়া তমুদ্দুন মজলিশ নামের যে সংগঠনটি ভাষা সংগ্রামের সময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল, তার প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাশেমের স্ত্রী রাহেলা খানম, বোন রহিমা বেগম এবং আবুল কাশেমের ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া খানমও সেই সময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
প্রচুর পোস্টার ও ব্যানার লিখে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন ডা. সুফিয়া খাতুন। এছাড়াও ছিলেন ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন।
যশোরের এক নারী হামিদা রহমান, যিনি সংবাদপত্রে বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো দাবি জানিয়ে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি পরবর্তীতে সংগ্রাম পরিষদে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
চট্টগ্রামের নারীরাও এই আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- সৈয়দা হালিমা খাতুন, তোহফাতুন্নেসা আজিম, সুলতানা বেগম, নুরুন্নাহার জহুর, আইনুন নাহার, আনোয়ারা মাহফুজ, তালেয়া রহমান এবং প্রতিভা মুৎসুদ্দী।
খুলনায় যারা ভাষা আন্দোলনে শরিক ছিলেন, তাদের মধ্যে আনোয়ারা বেগম এবং সাজেদা আলীর নাম পাওয়া যায়।
রংপুরে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছেন নিলুফা আহমদ, বেগম মালেকা আশরাফ এবং আফতাবুন্নেসা খানম।
একইভাবে রাজশাহীতে আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন ড. জাহানারা বেগম, মনোয়ারা বেগম বেনু, ডা. মহসিনা বেগম, ফিরোজা বেগম, খুরশিদা বানু প্রমুখ।
ফেনী জেলার সন্তান অধ্যাপিকা শরিফা খাতুনের নাম উল্লেখযোগ্য। তার বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করেছে। এছাড়া একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন মমতাজ বেগম ২০১২ সালে। ২০০২ সালে সুফিয়া আহমদ ভাষা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করার একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। ভাস্কর নভেরা আহমদ আরেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের সাথে তার নামটি জড়িয়ে রয়েছে। অন্য দুই সহযোদ্ধার সাথে অক্লান্ত পরিশ্রম করে শহীদ মিনারকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছিলেন নভেরা। তার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৭ সালে একুশ পদকে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
এছাড়াও ২০১৯ সালে ভাষা আন্দোলনে স্মরণীয় ভূমিকা পালন করায় অধ্যাপিকা হালিমা খাতুন (মরণোত্তর) এবং অধ্যাপিকা মনোয়ারা ইসলাম একুশে পদক লাভ করেছিলেন।
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় অবস্থান করে যারা সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরও হলেন- নাদেরা বেগম, লিলি হক, নূর জাহান মুর্শিদ, লুলু বিলকিস বানু, আফসারী খানম, রানু মুখার্জি, কামরুন্নাহার লাইলি, জহরত আরা প্রমুখ।
গাইবান্ধায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেগম দৌলতুন্নেসা। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন শেষে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। প্রফেসর চেমন আরা ছিলেন আরেক ভাষা সৈনিক। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ‘জিবরাঈলের ডানা’-খ্যাত শাহেদ আলীর স্ত্রী ছিলেন তিনি। ৫২ সালে তিনি ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।
সেই সময় ছাত্রাবস্থাতেই ভাষার দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। বৃহত্তর সিলেটের কুলাউড়ার সন্তান রওশন আরা বাচ্চু ৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি আন্দোলনে নিজেকে এতটাই জড়িত করেছিলেন যে, পরবর্তীতে ‘ভাষা কন্যা’ অভিধায় ভূষিত করা হয়েছিল তাকে। মূলতঃ আন্দোলনে ছাত্রীদের সংগঠিত করা ছাড়াও ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম ছাত্রীদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইমেন স্টুডেন্টস রেসিডেন্সেরও সদস্য ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই বিপ্লবী কন্যার নামটি আজও একুশে পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় স্থান পায়নি।
এছাড়াও কবি সুফিয়া কামালের নাম উল্লেখযোগ্য। মূলত একজন কবি হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটলেও বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনসহ প্রতিটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম সারির যোদ্ধা ছিলেন তিনি। এছাড়া একুশে কেন্দ্রিক রচনা লেখার ক্ষেত্রেও ছিলেন অগ্রগণ্য এক কবি। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘একুশের সংকলন গ্রন্থপঞ্জি’তে তার লেখা একুশেভিত্তিক ৬৫টি কবিতার উল্লেখ আছে।
২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত প্রেক্ষাপটের প্রতিবাদ জানিয়ে ঐদিন অভয় দাস লেনে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। তাঁর সাথে ছিলেন বেগম নূরজাহান মুরশিদ। একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন ১৯৭৬ সালে।
আর এক বিপ্লবী কন্যার নাম মমতাজ বেগম। কলকাতার এক বনেদী পরিবারে জন্ম নেয়া কল্যাণী রায় চৌধুরী। পিতা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রায় বাহাদুর মহিম চন্দ্র রায় চৌধুরী। পড়াশোনার শুরুটা কলকাতায় হলেও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করেছিলেন। একসময়ে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আব্দুল মান্নাফকে। ভালোবাসার খেসারত দিতে গিয়ে পরিবার, ধর্ম সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন তিনি। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে নাম রেখেছিলেন মমতাজ বেগম। ১৯৫২ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে দায়িত্ব পালনের একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়লেন ভাষা আন্দোলনের সাথে। নেতৃত্ব দিয়েছেন বিক্ষোভ মিছিলসহ জনসভাতে। ফলস্বরূপ তার উপর নেমে আসে নানামুখী অত্যাচার। একপর্যায়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ দেড় বছরের মতো কারাগারে কাটে তার দিন। শুধু তাই নয়, তার এসব কাজের কারণে তার স্বামীও তাকে তালাক দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম নারী ভাষা সৈনিক ছিলেন, যাকে কারাগার রাজবন্দী হিসেবে বন্দীজীবন কাটাতে হয়েছিল। এসব ঘটনার ৬০ বছর পরে ২০১২ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মমতাজ বেগমকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, তখন তাঁর ছাত্রীদের মধ্যে ইলা বকশী, বেনু ধরসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। এবং ঐসব ছাত্রীকে স্কুল থেকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছিল। যারা হয়ত পরবর্তীতে আর স্কুলে ফিরতেই পারেননি।
কিন্তু সিলেটের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টা ছিল অন্য মাত্রার। তা অবশ্য সিলেটের রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক কারণে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত থেকে ৪ হাজার ৯১২ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গঠিত সিলেট অঞ্চলের তিন দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে ভারতীয় সীমানা দেয়াল। এক সময় সিলেট আঞ্চল ছিল ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা আসামের একটি প্রদেশ মাত্র। ১৭৬৫ সালে সিলেট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারভুক্ত হয়। তারপর বেনিয়া বৃটিশ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের দোহাই দিয়ে সিলেটকে খণ্ডিত করে আসাম প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত করে দেয়। সুদীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে আসামের এক অংশ হয়ে টিকে থাকতে গিয়ে জেরবার হয়েছেন সিলেটের আপাময় জনগণ। ছিল মারাত্মক ধরণের অস্তিত্বের লড়াই। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ যখন স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দোরগোড়ায়, সেই সময়েও সিলেট এক অমীমাংসিত অধ্যায়। সিলেট আসামের অংশ হয়ে থাকবে, নাকি পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে- এ নিয়ে এক গণভোটের আয়োজন করতে হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত সেই গণভোটের রায় নির্ধারণ করেছিল সিলেটবাসীর ভাগ্যকে। এবং এই গণভোট আয়োজন করতে গিয়ে মুসলিম লীগপন্থী রাজনীতিবিদদের প্রচুর সমস্যা এবং শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়েছিল। তারপর সদস্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশের সামনে ভাষা বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখন কার্যত সেসব নেতা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এর মধ্যে সিলেটের কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং পাকিস্তান সরকারের একজন মন্ত্রীকে পর্যন্ত উর্দুর পক্ষ নিয়ে বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবির বিরোধিতায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে দেখা গিয়েছিল! সিলেটের ঐ দুঃসময়ে কতিপয় মহিলাকে সাহসের সাথে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। যেমন, ১৯৪৮ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী আব্দুর রব নিশতার এক সংক্ষিপ্ত সফরে সিলেট এসেছিলেন। ঐ সময়ে সিলেটের নারী রাজনীতিবিদদের মধ্য থেকে বেগম জোবেদা রহিম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি মহিলা প্রতিনিধিদল মন্ত্রীর সাথে দেখা করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তির অবতারণা করেন। ঠিক এর পরের বছর মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের কাছে ঐ মহিলা দলের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চালুর দাবি জানিয়ে এক স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলেন। এতে যাঁরা স্বাক্ষর দিয়েছিলেন, তাঁরা হলেনÑ সৈয়দা শাহের বানু, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, জাহানারা মতিন, শামসী খানম চৌধুরী, রোকেয়া বেগম, সৈয়দা নজিবুন্নেসা খাতুন, মাহমুদা খাতুন, শামসুন্নেসা খাতুন এবং জোবেদা রহিম চৌধুরী।
মহিলাদের পক্ষ থেকে এই স্মারকলিপি পাঠানোর খবর পেয়ে স্থানীয় সংবাদপত্রে ঐসব মহিলার বিরুদ্ধে চরম ও অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছিল। এই খবর ঢাকায় তমুদ্দুন মজলিশের নেতৃবৃন্দের কাছে গিয়ে পৌঁছালে আব্দুল কাশেম জোবেদা রহিম চৌধুরীর কাছে এক চিঠি মারফত অভিনন্দন বার্তায় উল্লেখ করেন, ‘সিলেটের পুরুষরা যা করতে পারেননি, আপনারা তাই করে দেখালেন।’
পরবর্তীতে ৫২-এর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর ২২ ফেব্রুয়ারি ভোরে যখন সিলেটে এক বিক্ষুব্ধ মিছিল রাস্তায় বের হয়, সেই মিছিলের অগ্রভাগে নারীরাও সমান তালে এগিয়ে যান।
ইতিহাসের আলোকে নারীদের এই অংশগ্রহণ ইতিহাসেরই আরেক বিরল ও সম্মানজনক অধ্যায়।
লেখক : সাংবাদিক ও নারী নেত্রী