ভাষা আন্দোলন ও একুশের চেতনা

শামসুল হুদা
প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৪৭ সালে। এটি বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হলো উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি হিসেবে। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ- পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব বাংলা গঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে। অন্যদিকে কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান। জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু শুরু থেকেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা থেকে গেল অন্যায়ভাবে সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানিরা শুরু থেকেই সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিমাতাসুলভ আচরণে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে লাগল। শাসকগোষ্ঠী প্রথমে সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের মুখের ভাষা বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাঙালিদের মৌলিক ও বৈধ অধিকার বাংলা ভাষাকে ন্যায্য মর্যাদা না দিয়ে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের মূল রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইংরেজিকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়ে। পূর্ব বাংলার ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-সাধারণ মানুষ এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নীরবে মেনে না নিয়ে অধিকার আদায়ের জন্য তুমুল প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করে এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য ছাত্রনেতাদের সহযোগিতায় সংগ্রাম কমিটি গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন জোরদার করে।
তীব্র আন্দোলনের মধ্যেই পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ওইদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জোরালো ভাষায় তিনি ঘোষণা করেন, ‘Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan.’ অর্থাৎ উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আমরা উপস্থিত ছাত্ররা সঙ্গে সঙ্গে না, না বলে জিন্নাহর মুখের ওপর প্রতিবাদমুখর হয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি এবং পরে বাংলার জাগ্রত জনতা লাখো কণ্ঠে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ শুরু করে। ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১ -এই বছরগুলোতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে এবং অনবরত ধর্মঘট, হরতাল, বিক্ষোভের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার জোরালো প্রতিবাদ চলতে থাকে। এদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও ব্যাপক দমননীতি চালাতে থাকে। ছাত্রনেতা ও কর্মীদের পুলিশ বাহিনী দ্বারা অকথ্য নির্যাতন, গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করে। এরই মধ্যে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি (মতান্তরে ২৭ জানুয়ারি) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন করাচি থেকে ঢাকায় এসে পল্টনের জনসভায় জিন্নাহর কথা পুনরাবৃত্তি করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তার এই ঘোষণা ছিল জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো। ছাত্রদের মধ্যে শুরু হয় কঠোর উত্তেজনা। আমরা ৩১ জানুয়ারি এক সমাবেশ করি এবং ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালন করি। ধর্মঘট শেষে আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন) সারা পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ও সর্বাত্মক ধর্মঘট এবং বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই ধর্মঘট ও আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য শাসকগোষ্ঠীর নুরুল আমিন সরকার সভা-সমিতি ও মিছিল নিষিদ্ধ করে একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৪৪ ধারা অমান্য করার ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। এই বিভক্তি ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভ্রুক্ষেপ না করে ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে এবং হাবিবুর রহমান শেলীর সত্যাগ্রহী দলের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্র সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির নেতা আব্দুল মতিন, অলি আহাদসহ আমাদের মধ্যস্থতায় সাধারণ ছাত্রদের অভিমত প্রকাশের ভিত্তিতে ১৪৪ ধারা অমান্যের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখন আমরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গোলাগুলির প্রস্তুতি উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয় গেট অতিক্রম করে বেরিয়ে পড়তেই পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হই। আর রফিক, শফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, সালাউদ্দিনসহ নাম না-জানা অনেক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে নিহত হয়। ১৯৪৮ সালে শুরু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের চূড়ান্ত পর্যায়ে ও একুশে ফেব্রুয়ারির চরম মুহূর্তে ভাষাশহীদদের বুকের তাজা রক্তে আত্মবিসর্জনের কারণে এবং ভাষাসংগ্রামীদের নিঃস্বার্থ ত্যাগের ফলে পরবর্তী সময়ে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। পাকিস্তানি শাসকগেষ্ঠী বাধ্য হয় এই মর্যাদা দিতে ১৯৫৪ সালের স্বীকৃতির মাধ্যমে, যা পাকিস্তানের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৫৬ সালে।
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি মাসের চরম মুহূর্তের রক্তভেজা অমর একুশে শহীদ দিবস সংগত কারণে যথোপযুক্ত বিবেচনায় জাতিসংঘের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা একুশেরই সুবর্ণ ফসল। একুশে ফেব্রুয়ারির চরম মুহূর্তে ভাষাশহীদদের তাজা রক্তে যে বীজ বপন করা হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ প্রাণ উৎসর্গের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন ও ভাষাভিত্তিক সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।
ভাষা আন্দোলনের চেতনা ছিল মাতৃভাষা বাংলার সুরক্ষা ও সর্বস্তরে মায়ের ভাষার প্রচলন ও বাস্তবায়ন এবং সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার মধ্য দিয়ে জাতীয় আত্মপরিচয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার রক্ষা করে শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। স্বাধীনতার চেতনার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনা মিলেমিশে একাকার। এই চেতনার সারকথা জাতীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা, স্বাধীন জাতিসত্তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সমতা, বৈষম্যহীনতা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ।

লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত। বাফেলো, নিউইয়র্ক।