ভূমিকম্পে লন্ডভন্ড ১০ প্রদেশ : তুরস্কের বাতাসে লাশের গন্ধ

শিপন হাবীব, তুরস্ক থেকে : ভূমিকম্পে লন্ডভন্ড ১০টি প্রদেশের মধ্যে একটি আদিয়ামান। প্রতিটি শহরেই লাশের গন্ধ। ছোটখাটো ভূমিকম্পও ধাক্কা দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। ফলে শোকাহত মানুষের পিছু ছাড়ছে না আতঙ্ক। বৈরী আবহাওয়া, তীব্র ঠান্ডার মধ্যে গলিত লাশ উদ্ধার হচ্ছে ধ্বংসস্তূপ থেকে। স্থানীয় সূত্র বলছে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৭ হাজারের বেশি লাশ উদ্ধার হয়েছে। সব হারানো মানুষের আর্তনাদ ক্রমেই বাড়ছে। উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশসহ ৩২টি দেশ থেকে আগত উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসকরা। আদিয়ামান শহরে ইতোমধ্যে সাড়ে ছয় হাজার লাশ উদ্ধার হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন আরও প্রায় ছাব্বিশ হাজার মানুষ নিখোঁজ। এদিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে একের পর এক মৃতদেহ উদ্ধার হচ্ছে। উদ্ধারকৃত দেহগুলো এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তুপ ঘিরে শোকাহতদের আর্তনাদ চলছে। চারদিকে মৃত্যুর মিছিল। শুধুই হাহাকার। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্ধার অভিযানে আসা সৈন্যদের উদ্ধার তৎপরতার কমতি নেই।
শহরের কোনো ভবনেই সাধারণ মানুষ থাকছে না। অক্ষত কিছু ঘর থাকলেও ফাটল ধরার কারণে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যারা স্বজন হারিয়েছেন, তারা ধ্বংসস্তুপ এলাকা ছাড়ছে না। দিনরাত প্রিয়জনের মৃত কিংবা জীবিত দেখবেন, এমন আশায় বুক বেঁধে আছেন। একেকটি লাশ উদ্ধার হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন স্বজনেরা।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, যে পরিমাণ লাশ উদ্ধার হয়েছে, তার দ্বিগুণেরও বেশি নিখোঁজ আছে। শহরের প্রধান সড়ক, শাখা সড়ক ধরে সারি সারি ভবন ধসে পড়ে আছে। ধ্বংসস্তূপ ঘিরে জড়ো হওয়া মানুষের প্রত্যাশা একটিই, দ্রুত আটকেপড়া স্বজনদের দেহ বের করা হোক।
এদিকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ উদ্ধার হওয়া লাশগুলোকে দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করছে। দেশের পতাকা গায়ে জড়িয়ে সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়ে বিভিন্ন স্থানে সমাহিত করা হচ্ছে।
ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে পাশের শহর গাজী আনতেপে। সেখান থেকে ছুটে আসা আকিফ ওযতুর্ক এবং ফাতমা ওযগুল কামালপাশা সড়কের কাছে একটি ধ্বংসস্তুপের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। আকিফ ওযতুর্ক নিজ ভাষায় জানালেন তাদের শহরে নিজেরা বেঁচে গেলেও এই শহরে থাকা ভাইবোন ও তাদের দুই সন্তান এখনো নিখোঁজ। এই সড়কের পাশে কোন ভবনটিতে তারা থাকতেন, সেটিও চিহ্নিত করতে পারছেন না। সাতদিন ধরে অপেক্ষা করছেন। যেসব দেহ উদ্ধার হচ্ছে সেখানে যদি প্রিয় মানুষের খোঁজ মেলে। বলতেই, কান্না ভেঙে পড়েন এ ভাইবোন।
উদ্ধারকারীরা বলছেন, শোকাহত ও অপেক্ষমাণ লোকদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন অনেকে। রাস্তার পাশে নিজ উদ্যোগেই রান্না করা খাবার তুলে দিচ্ছেন। উদ্ধারকারী কিংবা স্বজনদের খোঁজে অপেক্ষমাণ কাউকে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে না। ধ্বংসস্তূপ এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন সড়কের পাশে খাবার নিয়ে বসেছেন সাধারণ মানুষ।
দোয়ান নামের এক ব্যক্তি এই শহরের পাশে খাবার নিয়ে বসেছেন। জানালেন তার একটি তিনতলা ভবন ছিল, ভাড়া দিয়েছিলেন। বাসিন্দারা কেমন আছে জানেন না। সাতদিন ধরে মানুষদের খাবার খাওয়াচ্ছেন। এ রকম দৃশ্য পুরো শহর জুড়ে।
বাংলাদেশ থেকে আসা ফায়ার ব্রিগেড ও সেনাবাহিনীর একটি টিমে ৩৬ জন দিনরাত উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। টিম লিডার লে. কর্নেল মোহাম্মদ রুহুল আমিন জানান, তার দলের সদস্যদের নিয়ে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সোমবার পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপ কেটে ১৩ জনের মৃত দেহ ও ১ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উদ্ধারকারী দল সর্বোচ্চ ইকুইপমেন্ট নিয়ে এলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী উদ্ধার কাজ চালাতে পারছে না। অধিকাংশ ভবন মাটি থেকে দুই তিনতলা পর্যন্ত নিচে দেবে গেছে। আবার উপরের তলাগুলো একের পর এক চেপে বসেছে। ফাঁকা অংশ কম থাকায় বাইরে থেকে ভেতরে গিয়ে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে বেগ পেতে হচ্ছে। উপর থেকে ছাদ রড, কেটে কেটে নিচের দিকে যেতে হচ্ছে। কাজ করতে গেলে প্রায় ধ্বংসস্তূপ আরও নিচের দিকে দেবে যাচ্ছে। প্রতিটি ভবনের অবস্থা এমন। গভর্নর ভবনের ঠিক পেছনেই চার-চারটি বহুতল ভবন ছিল। সবকটিই দেবে গেছে। ভূমিকম্পের পর থেকে উদ্ধার কাজ শুরু হলেও ধ্বংসস্তূপের চারভাগের একভাগ পর্যন্তও পৌঁছানো যায়নি। আদিয়ামান শহরের সবচেয়ে শক্তিশালী ভবন গভর্নর হাউস, যার পুরো দেয়ালে ছোটবড় চিড় ধরেছে। আর পুরো শহরে যেসব ভবন হেলে কিংবা দেবে যায়নি, সেগুলোর সব কয়টিতেই ফাটল ধরেছে। ফলে পুরো শহরের বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তুরস্কের ১০টি প্রদেশে ভূমিকম্প হানা দিয়েছে। আদিয়ামান ছাড়াও কাহরামান মারাশ, হাতাই, আদানা, গাজী আনতেপ, শানলি উরফা, উসমানিয়ে, দিয়ার বাকের, মালাতিয়া ও আন্তাকিয়াতে শত শত মানুষ নিখোঁজ রয়েছে।