নিউইয়র্কে আমরা যারা প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করছি, তাদের জন্য অবশ্যই সুসংবাদ যে এবার ভোটার হওয়ার খাত থেকে বাংলাদেশ সোসাইটি নিউইয়র্কের আয় হয়েছে ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৪৬০ ডলার। ভোটারসংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। গত বছরও রেকর্ডসংখ্যক ভোটার ছিলেন। ১৮ হাজার ৫৫৪ জন। কিন্তু এবার সে সংখ্যা থেকেও প্রায় সাড়ে ৯ হাজার ভোটার বেশি হয়েছেন। এবার সোসাইটির মোট ভোটারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৫২৪। গত নির্বাচনে ১৮ হাজার ৫৫৪ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৫২ শতাংশ ভোটার, যাকে মাত্র অত্যুক্তি মনে হবে না।
এবার ২৭ হাজার ৫২৪ জন ভোটারের মধ্যে কত শতাংশ ভোট দিতে আসবেন, তা অনুমান করে বলাটা ঠিক হবে না। যশ শতাংশই ভোট দিতে আসুক, আমাদের আনন্দিত হওয়ার বিষয়ে কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। আনন্দের কারণ- এক. আমরা কমিউনিটি হিসেবে এই প্রবাসে ক্রমাগত বেড়েই চলেছি। দুই. আমরা ধন-যশেও বড় হচ্ছি। কয়েক দিনের মধ্যে নগদে ৫-৬ লাখ ডলার পকেট থেকে বের করা খুব চাট্টিখানি কথা বলে মনে হয় না! এবং ধন ও সংখ্যাÑএ দুই মিলে যে একটা বড় শক্তি, সে কথা আমরা এ শক্তিকে যথার্থভাবে ব্যবহার করতে পারি বা না পারি, কারো অস্বীকার করার জো নেই।
সোসাইটি নিয়ে আমরা সাধারণত নিগেটিভ কোনো কথা বলতে চাই না। বলতে চাই না, কারণ সেই ফেলে আসা স্বদেশ। সোসাইটির নামের সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত থাকায় যুক্তিসংগত অনেক কথাও অনেকে বলতে চান না। কেন যেন এক দুর্বলতায় পেয়ে বসে, বুঝিবা স্বদেশের বুকে ব্যথা লাগে। বাঙালি শুধু যে ধর্মে দুর্বল, তা নয়। স্বদেশ নিয়েও তারা অত্যন্ত দুর্বল। বারবার তার প্রমাণ দিয়েছে বাঙালিরা। ’৫২, ’৭১ তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এই যে প্রবাসে বাঙালিদের রাজনীতি, বনভোজন, ইফতার পার্টি, দেশের সংস্কৃতি নিয়ে মাতামাতি, বইমেলায় সকাল-সন্ধ্যা হাজির হওয়া সব কাজ ভুলে-এ সবই তো স্বদেশের অনুকরণ। তার মানে স্বদেশকে ভুলে থাকতে না পারা। সোসাইটি নিয়ে আমাদের মাতামাতি বলি কিংবা পাগলামি, সেও ওই দেশপ্রেমেরই অংশ।
বাংলাদেশ সোসাইটি নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় সংগঠন। কেউ বলেন মাদার সংগঠন। কেউ বা বলেন আমব্রেলা সংগঠন। আসলে চেতনাগতভাবে বাংলাদেশ সোসাইটির আমাদের অভিভাবক সংগঠনের মর্যাদা লাভ করার কথা ছিল। কার্যত তা হয়নি ৪২ বছরের এ সংগঠনটি বাংলাদেশ নাম নিয়েও। কেন বাংলাদেশ সোসাইটি নিউইয়র্ক ৪২ বছরেও অভিভাবক সংগঠনে পরিণত হতে পারেনি সব সম্ভাবনা নিয়েও, তা বোধগম্য নয়। ১৯৭৬ সালে এর জন্মও হয়েছিল সেই সম্ভাবনা এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে। একসময় দায়ী করা হতো এর জন্মকালের নেতাদের। তাদের অভিযুক্ত করা হতো তারা শিক্ষিত উচ্চবিত্ত মানুষ। কমিউনিটির সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই, ওঠাবসা নেই। সোসাইটিকে তারা শামুকের মতো করে রেখেছেন, সে কারণে সোসাইটির কোনো বিস্তৃতি নেই, কর্মকা- নেই। স্রেফ ভদ্রলোকদের পিকনিক-প্রধান ক্লাব যেন!
শুরু হয় সোসাইটিকে পাবলিকের মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ। সফলও হন এ আন্দোলনের রূপকাররা। তারই ফল আজকের এই সাড়ে ২৭ হাজার সদস্য। আয় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ ডলার! ব্যয়ের খাত আগে থেকে জানা যায় না। তবে অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যে পিকনিকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি বিশেষ দিবস পালন এবং উদ্্যাপন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, শোক দিবস, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস এবং রমজান মাসে ইফতার। আর এই ৪২ বছরে স্থায়ী সম্পদের মধ্যে হয়েছে একটি ভবন। সার্বিকভাবে কমিউনিটির উন্নয়ন হয়, তেমন কিছু চোখে পড়ে না।
প্রবাস-জীবনে আনন্দ-বিনোদনের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা, চেনাজানার প্রয়োজন আছে। কিন্তু আর কি কিছু করার নেই? আমরা তো জানি দেশের মতো এত সহজে আয়ের ব্যবস্থা এ দেশে নেই। আবার দেশে অর্থ ব্যয় করে একটা কিছু হলে তো আবার সে অর্থ কয়েক গুণে উশুল করার সুযোগের কথাও শোনা যায়। এখানে কি সে রকম কোনো সুযোগ আছে, লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে কিছু হওয়ার পর খরচ করা অর্থ তুলে আনার? তবে কী করে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে হাজার হাজার সদস্য করা হয়। আবার আরো কয়েক লাখ ডলার খরচ করে নির্বাচন করে নেতা হওয়া। দেখেশুনে অনেককেই মন্তব্য করতে শোনা যায়, এদের পকেটে আলাদিনের চেরাগ থাকে মনে হয়! অনেককে এও বলতে শোনা যায়, এখানে নির্বাচন নিয়ে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তা দিয়ে দেশে ৮-১০ জন এমপির ইলেকশন হয়ে যায়! এরা প্রকৃত অর্থে কমিউনিটির সেবা করতে চান, নাকি শুধু নেতা হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠা চানÑসিদ্ধান্তে আসা কঠিন।
অনেকেই আরো কঠিন মন্তব্য করতে চান, যা খুব একটা নৈতিক নয় বলে মনে হয়। আত্মপরিচয়ের সংকট ঘোচাতে অনেকে কাগজের মতো অর্থ ব্যয় করতে দ্বিধা করেন না। সেটা খুব ন্যায্য মন্তব্য বলা যায় না। কেননা আমরা যারা দেশের মাটি ত্যাগ করে বিদেশ বিভুঁইয়ে বসত গড়েছি, তাদের সবারই বড় পরিচয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। বিশেষ করে, আমেরিকার মতো দেশে কর্ম-মর্যাদায়, পদ-মর্যাদায় কিংবা আয়-বৈষম্যে কাউকে ছোট-বড় করে দেখার সুযোগ নেই। এখানে বিবেচ্য হওয়ার কথা কে কতটা কমিউনিটির সঙ্গে জড়িত। কমিউনিটিতে কার কতটা অবদান। কর্মদক্ষতা, সততা, আন্তরিকতা, দূরদর্শিতা এবং মেধা দিয়ে কে কমিউনিটিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম। কমিউনিটির মানুষের সেবায় কে কতটা সময় দিতে এবং অবদান রাখতে সক্ষম, সেটাই হওয়া উচিত নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য।
লক্ষ করা গেছে, সোসাইটির নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচ্য গুণাবলি মূলত কার্যকর হয় না ভোটার করার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ব্যবস্থার কারণে। বাংলাদেশে একটি স্লোগান আছেÑযার ভোট সে দেবে, যাকে খুশি তাকে দেবে। প্রকৃত প্রস্তাবে স্লোগানটি কখনোই বাস্তবায়িত হতে দেখা যায় না। এখানেও সবাই নিজের ভোট নিজে করবে, ভোটও যাকে খুশি তাকে দেবেÑএ নৈতিক বিষয়টি বাস্তবে দেখা যায় না। এখানে সোসাইটিতে নিজের ভোট নিজের যেমন করতে দেখা যায় না, প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে, তেমনি নিজের বিবেচনামতে ভোটও দিতে দেখা যায় না। এখানে যার ভোট তিনি তার পছন্দমতো প্রার্থীকে দিতে পারেন না। যার অর্থে ভোটার হন, ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে তার পছন্দই প্রাধান্য পায়।
বক্ষ্যমান সম্পাদকীয়টির শুরুতেই বলা হয়েছে, এবারের সোসাইটির ভোটারের সংখ্যা অবশ্যই একটি শক্তি এবং ভোটার বাবদ আয়ও একটি উল্লেখযোগ্য অর্থ। এ জনশক্তি এবং অর্থশক্তি পজিটিভলি নানাভাবে কাজে লাগানো যায়, যদি আমরা গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারি। তবে তা পারা যাচ্ছে না, মোটা দাগে বলতে গেলে স্বচ্ছতা, আন্তরিকতা এবং ঐক্য ও ভিশনের অভাবে। অবস্থাটা অনেকটাই এমন, ‘নেতা তো হয়েই গেছি, আর কী। যুদ্ধ করার চেয়ে যদি বন্দুকখানি ঘাড়ে নিয়েই বীরের মর্যাদা পাওয়া যায়, তবে আর যুদ্ধ করার দরকার কী! সেবার চেয়ে নাম ফোটানোর গৌরবও কম কিসে!’
কিন্তু এ ধারা আর কত দিন চলতে পারে? মেঘে মেঘে বেলা তো অনেকটাই হয়ে গেল। ৪২ বছর একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য খুব কম সময় বলা যাবে না। এখন প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন আশা করা যেতেই পারে। বিশেষ করে, আমেরিকার মতো দেশে থেকে অন্যের অর্থে ভোটার হওয়া, অন্যের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া খুব সম্মানজনক বা সময়োপযোগী ও উন্নয়ন-সহায়ক ধারা বলে গ্রহণ করা যায় না। আধুনিক, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ অন্যের চাপিয়ে দেওয়া পছন্দ কী করে মেনে নেন!
দেখা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে সোসাইটির আগামী নির্বাচনে আগ্রহী প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন পিকনিক স্পট এবং সভা-সমিতিতে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছেন। তাদের সমীপে সোসাইটির সাধারণ সদস্যদের হয়ে কিছু নিবেদন করা যায়। তারা এবার ভোটার হওয়া বাবদ আয়ের এ অর্থ নির্বাচিত হলে কীভাবে কোন কোন খাতে ব্যয় করবেন, তা আগেই জানালে মনে হয় সবাই খুশিই হবেন। এ কথা মনে হয় সোসাইটির সদস্যরা প্রত্যাশা করেন যে নির্বাচিত কর্মকর্তারা তাদের সম্পূর্ণ মেয়াদকালে সোসাইটির আয়-ব্যয়ের একটা তালিকা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে ধরবেন। ভোটাররা তার ভিত্তিতে ভোট দেওয়ার একটা সিদ্ধান্ত নিলেও নিতে পারেন। এবং সেই সঙ্গে আমরা এও প্রত্যাশা করি, আমাদের নেতাদের কর্মোদ্যোগ কেবল প্রবাস কমিউনিটিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, স্বদেশের কল্যাণেও তাদের ভূমিকা থাকবে। তাদের নেতৃত্বে আমাদের প্রবাস কমিউনিটি যেমন এগিয়ে যাবে, উন্নতি করবে, দেশমাতৃকাও তেমনি উপকৃত হবে। দেশ নিয়ে প্রবাসীদের ভাবনাও বিস্তৃত হবে। আমাদের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, ঐক্য দৃঢ় হবে তাদের কর্মতৎপরতা, মেধা এবং মননের গুণে।
আমরা আমাদের নেতাদের নির্বাচিত করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ বলে মনে করি না। আমাদের নেতাদের নিয়ে আমরা প্রবাসে-স্বদেশে গর্ব করতে চাই। অন্য কমিউনিটির মানুষও যেন আমাদের নেতাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘সত্যি নেতা বটে। কোনো প্রবাস কমিউনিটির নেতা হলে এমনই হতে হয়।’