শেখ রোকন
গত সপ্তাহে এইচ এম এরশাদ তার ভোটব্যাংক রংপুরে গিয়ে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টিকে ৭০টি আসন ছেড়ে দিতে হবে। অন্যথায় তার দল এককভাবে নির্বাচন করে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। এ নিয়ে যথারীতি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হয়েছে। বিভিন্ন সময়েই একক নির্বাচনের প্রত্যয় এবং অবিলম্বে সেই অবস্থান থেকে অমলিন বদনে সরে আসার ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়েছেন সমালোচকরা।
জোটের বাইরে গিয়ে একক নির্বাচনের এই দাবির মধ্যে ইতিহাস পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, না নতুন কোনো ইঙ্গিত হাজির করছে? আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির পাশাপাশি যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক এলডিপির সর্বসাম্প্রতিক বক্তব্য আমলে নেওয়া যায়, তাহলে খানিকটা আঁচ করা যেতে পারে।
মার্চের গোড়ার দিকে এলডিপি (লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি) থেকে সংবাদমাধ্যমে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালনের পাশাপাশি দলটি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই প্রস্তুতি কেবল নীতিগত নয়। জোটের ভিত্তিতে ৩০টি আসনে প্রার্থীও প্রস্তুত রয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি তালিকাও পাঠানো হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি যে নিছক খবর দেওয়ার বিষয় ছিল না, পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করলে তা স্পষ্ট হয়। লক্ষণীয়, যে বৈঠককে উপজীব্য করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, তা জোটের বহুপক্ষীয় বা বিএনপি ও এলডিপির আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও ছিল না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্নেল (অব.) অলির মহাখালী ডিওএইচএসের বাসায় গিয়ে বৈঠক করেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি কি এরই ইঙ্গিত যে, ২০ দলীয় জোটের আর ১০টা দলের সঙ্গে এলডিপিকে মেলালে চলবে না?
বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় মাসখানেক পর। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এসে। এলডিপির ঢাকা মহানগর (উত্তর) শাখার সম্মেলনে উপস্থিত জোট নেতারা আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে এখনই ফয়সালা করার দাবি তোলেন। এলডিপির সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আহমেদ অনেকটা আলটিমেটাম দেওয়ার মতো করে বলেন, এপ্রিলের মধ্যেই আসন ভাগাভাগি হতে হবে। অন্যথায় ৩০০ আসনে ৬০০ প্রার্থী দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তার দল। এলডিপির জন্ম হয়েছিল বিএনপি ভেঙে। ক্ষমতায় থাকতেই বিএনপির কয়েকজন সংসদ সদস্য যেভাবে পদত্যাগ করে নতুন দল গঠন করেছিলেন, এমন নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল না। তারও আগে বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাটা ও ২০০১ সালে তাদরে মনোনীত রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরীর বিএনপি ত্যাগও ছিল ঘটনাবহুল। শেষ পর্যন্ত নানা হিসেবে এলডিপি ২০ দলীয় জোটে যোগ দিয়েছে বটে, পুরনো ক্ষত মুছে গেছে বলে মনে হয় না।
ভোটের বাজারে জোটগত অবস্থানে কেবল অতীতের ক্ষত নয়, ভবিষ্যতের ক্ষতি-বৃদ্ধিও হিসাব করতে হয় বৈকি। রাজনীতি তো শেষ পর্যন্ত ভোটের বাজারে দারও মারারই হিসাব-নিকাশ। এমনও নয় যে, ভোটের আগে জোটে নিজেদের হিসাব কষে নেওয়ার পরিকল্পনা শুধু এলডিপির। বিএনপির দুজন দায়িত্বশীল নেতা একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, তারা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন। এলডিপির সভায় আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে জোটের বেশির ভাগ শরিকের অবস্থান ছিল পূর্বপরিকল্পিত। অথচ ২০ মার্চ জোটের যে বৈঠক হয়েছিল, সেখানে খালেদা জিয়ার মুক্তির আগে আসন বণ্টন নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা না করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
২০ দলীয় জোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রেও নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে। দলটি ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারিয়েছে। হারিয়েছে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকও। যুদ্ধাপরাধের দায়ে প্রথম সারির সব নেতা হয় মৃত্যুদ-ে দ-িত, না হয় যাবজ্জীবন কারাভোগ করছেন। দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে যে ভোটব্যাংক ছিল, তাতেও চিড় ধরেছে মূলত নেতাকর্মীরা দৌড়ের ওপর থাকার কারণে। এক দিক থেকে দেখলে জামায়াতে ইসলামীর আর হারানোর কিছু নেই। আরেকটি নির্বাচন বর্জন কিংবা আরও বেশি চাপ নিয়ে তাদের অর্জন করারও কিছু নেই। রাজনৈতিকভাবে দেখলে এখন তাদের আরও শক্তিক্ষয় না করে, যতটুকু আছে ততটুকু সংহত করে নিতে হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন যখন জেলে, দলটি যখন প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে নাজুক সময় পার করছে, তখন বিএনপি থেকেও কিছু পাওয়ার নেই জামায়াতের। এমন পরিস্থিতিতে জোটের বাইরে গিয়ে স্বস্তি খুঁজতে চাইলেও চাইতে পারে। গত দুই সপ্তাহে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের বড় অংশ কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া নিয়ে বাজারে নানা কথা চালু আছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ২০ দলীয় জোট কি ভোট পর্যন্ত অটুট থাকবে? সাম্প্রতিক তৎপরতা ও বক্তব্য আমলে নিলে অন্তত এলডিপির ক্ষেত্রে সেই নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন। আমার ধারণা, জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান সামনের দিনগুলোতে আরও দ্রুত পরিষ্কার হবে। বিশেষত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর মধ্য দিয়ে। ২০ দলীয় জোটের বেশির ভাগ দলের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই। যাদের আছে, তারা নির্বাচনে যেতেই চাইবে। খালেদা জিয়া মুক্তি পান বা না পান।
মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিও কি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই জোটগত নির্বাচনে যাচ্ছে না? ক্ষমতাসীনরা যদি রাজনীতি থেকে দীর্ঘমেয়াদে সুফল পেতে চায়, তাহলে জাতীয় পার্টি জোটের বাইরে গিয়েই নির্বাচন করা ভালো হবে। সেটা জাতীয় পার্টির জন্যও ভালো। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে এটাই মোক্ষম সুযোগ। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ছোটখাটো ইসলামী দলগুলোর যে জোট প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা আরও এগিয়ে যেতে পারে বৈকি। সেখানে ২০ দলীয় জোটের কোনো কোনো শরিক যোগ দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ভোটের আগে জোটের ভাঙাগড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক ছিল জোট ভাঙাগড়ার অস্থিরতম সময়। আশির দশকে যে জোট ছিল আন্দোলনভিত্তিক, নব্বইয়ে এসে তা নির্বাচনকেন্দ্রিক হতে থাকে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোটামুটি জোটের মেরুকরণ ঘটে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সম্প্রসারিত হয়ে মহাজোট গঠিত হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সম্প্রসারিত হয় ২০ দলীয় জোট হিসেবে।
গত কয়েক বছরে আরও দুটি ছোট জোট তৈরি হয়েছে। একটি হচ্ছে সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। মূলত বামপন্থী দলগুলোর জোট। অপরটি যুক্তফ্রন্ট। আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা হওয়া কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিএনপি থেকে আলাদা হওয়া বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, বামপন্থীদের থেকে আলাদা হওয়া আ স ম আবদুর রবের জেএসডি এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য। লক্ষণীয়, চলাফেরা, বৈঠক চললেও শেষ পর্যন্ত এই জোটে যোগ দেয়নি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম।
সামনের দিনগুলোতে জোটের ভাঙাগড়া আরও গতি পেতে পারে বৈকি। জাতীয় পার্টি, এলডিপির মতো আরও কিছু জোট শরিক সামনের দিনগুলোতে মুখ খুলতে শুরু করতে পারে। বিভিন্ন জোটে বদল হাতে পারে কিছু মুখ।যদি পরিস্থিতি এখনকার মতো থাকে, তাহলে বিরোধী ২০ দলীয় জোটে যেমন, তেমনই ক্ষমতাসীন মহাজোটেও ভাঙাগড়া হতে পারে। পার্থক্য একটাই, ২০ দলীয় জোটে যে কোনো ভাঙন বিএনপিকে আরও দুর্বল করবে। অন্য দিকে মহাজোটে ভাঙন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী বাজারে বরং সুবিধা দিতে পারে। বাংলাদেশের ভোটের বাজার মূলত আওয়ামী লীগ ও অ্যান্টি আওয়ামী লীগে বিভক্ত। যখনই বিরোধী ভোট ভাগ হয়েছে, আওয়ামী লীগ লাভবান হয়েছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনো অর্থেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো হবে না। অন্তত নিবন্ধিত দলগুলোর, নির্বাচন বর্জনের সম্ভাবনা বা আশঙ্কা নেই। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বলছে, আগের মতো ওয়াক ওভার পেতেও যাচ্ছে না আওয়ামী লীগ। সে ক্ষেত্রে ভোটের বাজারে ভালো করতে হলে জোটের হিসাব-নিকাশ সাবধানে কষার বিকল্প নেই। একই কথা বিএনপির জন্যও সত্য।
লেখক ও গবেষক