সালেম সুলেরী
উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে বাংলাদেশ। এমন প্রচারণায় সদাব্যস্ত সরকারপক্ষ। কিন্তু সরকারের খুঁটি- ‘১৪ দলীয় জোটে’ই বিশাল অন্ধকার। অধিকাংশ শরিক দলেরই তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। ক্ষমতার সঙ্গে থাকলেও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অধিকাংশ দলই সাইনবোর্ড সর্বস্ব। কয়েকটি দলের রাজনৈতিক কার্যালয়ও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আ’লীগের নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোটে’ চলছে ‘মহাকান্ড’। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটেও তুমুল ভোট-বিতর্ক। নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে সংখ্যা ও পদবদলের খেলা। উভয় জোটেই ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’-এর খেলা চলছে বলে অভিযোগ। তবে প্রধান অভিযোগটি ‘জোট রাজনীতি’কে অবরুদ্ধ রাখা নিয়ে। তৃণমূলে বা প্রবাসে বিকশিত হয়নি এই সম্মিলিত উদ্যোগ। কেন্দ্রে কেন্দ্রিভূত রাখার নেপথ্যে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেও শ্লোগান উঠেছে।
বাংলাদেশ শাসন করছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। যুগপৎভাবে এটি ১৪ দলীয় বা মহাজোট সরকার। কিন্তু সরকারে বা জোটে ১৪ টি দল দৃশ্যমান নেই। সরকারে প্রতিনিধিত্ব করছে ৫টি দল। আ’লীগ জাতীয় পার্টি, জাসদ (একাংশ), ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপি। সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে আরও দুটি। কিন্তু অর্ধেকসংখ্যক দলই কার্যকরী কোন ভূমিকায় নেই। নির্বাচন কমিশনে দলগুলোর নিবন্ধনও নেই। মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করে বিস্মিত হয়েছেন এই প্রতিবেদক। একাধিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা আছেন। কিন্তু তৃণমূলে সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। অধিকাংশের জেলা-উপজেলা কার্যালয়তো দূরের কথা। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে জোটের অনিয়মিত বৈঠক হয়ে থাকে। সরকারের ব্যাপক উন্নয়নের ফিরিস্তিও প্রকাশ পায়। কিন্তু অপ্রকাশিত থাকে শরিক দলগুলোর দরিদ্রসম হাল-হকিকত।
জোটে আছে, ভোটে নেই : একদা জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন দিলীপ বড়ুয়া। সাম্যবাদী দলের এই শীর্ষ নেতা এখনো জোটের বৈঠকে অংশ নেন। তবে গাড়ি দিয়ে নয়। অধিকাংশ সময় রিকশায় বা পায়ে হেঁটে। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে বঙ্গবন্ধুর পরেই উচ্চারিত নাম অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। ন্যাপ (মোজাফফর) নামক দলটির খ্যাতিমান সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। ন্যাপ-এর অধীনস্থ ছাত্র ইউনিয়নের প্রধান ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। ‘অগ্নিকন্যা’খ্যাত মতিয়া পরে দলবদল করেন। আ’লীগে যোগ দিয়ে আলোচিত মন্ত্রীও হন। অন্যদিকে অধ্যাপক মোজাফফর-এর ন্যাপ যোগ দেয় জোটে-মহাজোটে। তবে তালিকায় নাম থাকা ছাড়া কপালে আর কিছুই জোটেনি। স্বাধীনতা পদক প্রদানের ঘোষণা করেছিলো জোট সরকার। কিন্তু অধ্যাপক মোজাফফর তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, এই স্বাধীনতার জন্ম দিয়েছি আমরা। আজ স্বাধীনতার ফসল তুলতে পারছি না। ঘরে স্বাধীনতার পদক তুলবো কী করে?
উল্লেখ্য, ন্যাপ (মোজাফফর)-এর নির্বাচনী মার্কা ছিলো ‘কুঁড়েঘর’। ১৪ দলীয় জোটে অবস্থান ২০০৪ থেকে। এই জোট সম্মিলিতভাবে নির্বাচন করে ২০০৮ ও ২০১৪ সালে। কিন্তু ন্যাপ (মোজাফফর) থেকে কেউ এমপি মনোনয়ন পাননি। দিলীপ বড়ুয়া’র সাম্যবাদী দল থেকেও কেউ এমপিত্ব পাননি। না পাওয়ার এমন নিয়তি জোটের অধিকাংশ দলের ভাগ্যেই ঘটেছে।
উল্লেখ্য, কমরেড মোজাফফরের কাকরাইলস্থ বাড়িটিতে এখন রাজনীতি নেই। একসময়ের সাংগঠনিক কর্মচাঞ্চল্য পুরোপুরিই স্থবির। সেখানে এখন আবাসিক হোটেলের নিদ্রা-ব্যবস্থাপনা। অন্যদিকে অসুস্থ শরীর নিয়ে অধ্যাপক মোজাফফর এখন গুলশানে। তবে জোট-মহাজোটের তত্ত্বাবধানে নয়। নিজ কন্যার বাসভবনে যাপন করছেন অনুগ্রহের জীবন।
এক নজরে ১৪ দলীয় জোট-মহাজোট : ০১. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (নৌকা); ০২. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ (কুঁড়েঘর); ০৩. জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ-ইনু (মশাল); ০৪. ওয়ার্কার্স পার্টি ( হাতুড়ি); ০৫. সাম্যবাদী দল (চাকা); ০৬. গণতন্ত্রী পার্টি (কবুতর); ০৭. জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ (একাংশ, প্রতীক-নিবন্ধন নেই); ০৮. গণ আজাদী লীগ (নিবন্ধনহীন); ০৯. বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বা বাসদ (একাংশ, নিবন্ধনহীন); ১০. গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি (নিবন্ধনহীন); ১১. জাতীয় পার্টি বা জেপি (বাই সাইকেল); ১২. তরিকত ফেডারেশন (ফুলের মালা); ১৩. শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল (নিবন্ধনহীন)।
১৪ দলীয় জোটে এখন দৃশ্যমান ১৩টি দল। এরমধ্যে জোড়া-তালিও রয়েছে। তোড়জোড় চলছে ‘ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট’কে ঢোকানোর। কিন্তু বাম ঘরানার দলগুলো বাঁধা দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ২৩ দফার আদর্শ নিয়ে বিতর্ক তুলেছে। তাদের মতে আ’লীগ শুধু ক্ষমতা ও নির্বাচন দেখছে। আদর্শ, মূল্যবোধ, স্বাধীনতা, ধর্মান্ধতা দেখছে না।
মহাজোটে এরশাদ-ইনু অসম সমঝোতা : ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে রয়েছে মহাজোটের অস্তিত্ব। তাতে অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি। স্বৈরাচার হিসেবে খ্যাত সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ- নেতৃত্বে। সিনিয়র মন্ত্রি পদমর্যাদায় সরকারের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত তিনি। দলের তিন নেতাও সরকারের মন্ত্রী। স্ত্রী রওশন এরশাদ আবার সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী। ফলে দলটি সরকারে, আবার বিরোধী দলেও। বিষয়টি সুস্থ ধারার রাজনীতির বিপক্ষে বলে সচেতনমহলের অভিমত। গত ৩ মার্চ সংসদে একই কথা বলেন স্বয়ং রওশন এরশাদ। এই দোদুল্যমান জাতীয় পার্টিকে নিয়েই সকোরের ‘মহাজোট’।
বিএনপি সরকারের নির্বাচিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার। ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ সামরিক কায়দায় ক্ষমতা নেন জেনারেল এরশাদ। ঐ ক্ষমতা গ্রহণকে আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়। মামলা করেছিলেন জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু। জোট-মহাজোটের রাজনীতিতে ঐক্য হলে মামলা প্রত্যাহার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সমালোচনাকারী ইনু জোট সরকারের মুখপাত্র তথা তথ্যমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনেকেই জোটের মন্ত্রিসভায় উজ্জ্বল তারকা। আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘দে আর নাউ মোর দ্যান আওয়ামী লীগার। এটাই জোট-মহাজোটের মজা ও পরিণতি’।
শরিক দলগুলোর স্থবিরতা বিষয়ে নানাজনের নানা মত : শরিক দলগুলোর সাংগঠনিক গরিবানা বিষয়েও মন্তব্য উচ্চারিত হয়। আ’লীগ নেতা বলেন, আমি জোটের একটি দলের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু জোটের সমন্বয়কারী বা মুখপাত্র নই। অতএব জোটের বৃহত্তর উন্মোচন বা নির্বাচনী সমবন্টন বিষয়ে ভাবনা আছে। তবে এতো সাততাড়তাড়ি কোন জবাব বা মন্তব্য দিতে পারিনা। তিনি আরো বলেন, জোটের অনেকেই আ’লীগের রাজনীতিতে লীন হতে আগ্রহী। অতএব, তাদের দলীয় বিকাশ হয়তো তাদের কারণেই স্থবির।
আ’লীগের শীর্ষ নেতার মন্তব্য অনেকে মানতে চাননা। তাদের মতে, জোটের ব্যানারে নাম থাকলেও কার্যক্রমে তারা গুরুত্বহীন। মাত্র ৩/৪ টি দলের শীর্ষ নেতারা মন্ত্রী হয়েছেন। বাকি দলগুলোর কার্যক্রম দিবসভিত্তিক বৈঠকে সীমাবদ্ধ। জোটের শরিক নেতারা বলেন, এমনটা আমরা চাইনি।। ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দলীয় জোট হয়েছে। প্রধান লক্ষ্য ছিলো নির্বাচন ও কর্মসূচিভিত্তিক ঐক্য। কিন্তু সারাদেশে জেলা-উপজেলায় জোটের কার্যক্রম তেমন নেই। প্রবাসেও জোট-মহাজোটের সম্মিলিত কার্যক্রম অনুপস্থিত। ধানমন্ডিতে ১৪ দলের নিয়মরক্ষার বৈঠক হয়। আ’লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় মৌ মৌ করে। ক্ষমতাসীন নেতারা আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। কিন্তু জোটের ছোট দলগুলোর হতাশার কথা জানতে চান না।
ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন গণতন্ত্রী পার্টির নূরুর রহমান সেলিম। এই প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, অঙ্গীকার ভঙ্গ হয়েছে। একসঙ্গে আন্দোলন-নির্বাচন, সরকার গঠনের অঙ্গীকার ছিলো। কিন্তু ভোটের পর ছোট দলগুলোকে মূল্যায়ন করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধানে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা কোথায়? অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশা ফিকে হয়ে আসছে। ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, হিসাব মেলাতে পারছি না। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক রয়েছে। জোটের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-সফলতা নিয়ে জনগণ একদিন বিচারে বসবে।
জোটে জোটে ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ ॥ সমন্বয়কারী-মন্ত্রী নাসিমের সতর্কবার্তা : আবার নড়াচড়া শুরু হয়েছে জোটে জোটে। ২০১৮-এর ডিসেম্বরে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন। ২০০১-এর অক্টোবরের নির্বাচনে বিজয় পায় ৪ দলীয় জোট। বিএনপি ছিলো সেই জোটের নেতৃত্বে। এখন এই নির্বাচনী মোর্চা ২০ দলীয় জোট হিসেবে পরিচিত। জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি। জোটের সমন্বয়কারী ছিলেন দলের মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আকস্মিকভাবে তাতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সমন্বয়কারী হয়েছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য নজরুল ইসলাম খান। যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, মির্জা ফখরুল দলীয় কর্মকান্ডে অতীব ব্যস্ত। সমালোচনাকারীরা বলছেন ভিন্ন কথা। বলছেন, জোটে জোটে চলছে ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’-এর খেলা।
আ’লীগ নেতৃত্বের জোট-মহাজোট নিয়ে কৌতুহল সর্ব্বোচ্চ। ২০০৪ সালে গঠনকালে ১৪ দলীয় জোট ১১ দলীয় হয়। কমিউনিস্ট পার্টি, গণফোরামসহ ৪টি দল সরে যায়। পরে দ্বিখন্ডিত জাসদ, গণফোরাম-এর একাংশ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু’র জেপি যোগ দেয়। এতে সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩। ‘ইসলামিক ঐক্য ফ্রন্ট’ শুন্যস্থান পুরণে এগিয়ে আছে। অন্যদিকে বিএনপি-ত্যাগী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও লাইনে দাঁড়িয়ে গেছেন। চলছে মিটিং, সিটিং, লবিং। জোটের সমন্বয়কারীর দায়িত্বে রয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। জোটের দুঃসময়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু জোটের শরিক দলগুলোর গরিবানা দূরিকরণে দিতে পারেননি সুসংবাদ। নিকটজনদের নিকট অপারগতাও প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, বাইরে মনে হয় আমি বিশাল সমন্বয়কারী। কিন্তু প্রধান দল আওয়ামী লীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে নেই। সংসদীয় প্রার্থী বাছাই কমিটিতে সদস্যও নই। অতএব জোটের শরিকদের পক্ষে মতামত দিতে পারি না। তাদের ভালোমন্দ দেখতে না পারলে দলের জন্যে তা অশুভ হবে। বিএনপি-জামাত-জঙ্গিবাদ ঠেকাতে জোট সারাদেশে ভূমিকা রেখেছে। এখন স্থবিরতা আনলে ‘কোটা আন্দোলনে’র মতো নতুন চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। এবারের নির্বাচন বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। অতএব ভোট বিষয়ে জোটকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
নিউইয়র্ক, ২৫ এপ্রিল, ২০১৮