ভোটের আগে সংবিধান নিয়ে বিতণ্ডা

নূরুল ইসলাম : ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। তাদের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি। এই দলটি ক্ষমতার বাইরে আছে ১৬ বছর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যেতে মরিয়া। তাদের অন্যতম অস্ত্র হলো বর্তমান সংবিধান।
এটি পবিত্র আমানত, বদলানো যাবে না। বিএনপি চায়, সংবিধানের সংশোধন। এতে করে এবার ভোটের আগেই উত্তেজনা শুরু হয়েছে। অতীতে অনেকে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তুলেছেন আকস্মিক। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় শিশুরা রাষ্ট্র মেরামতের দাবি তোলে। সড়কে তাদের শৃঙ্খলা দেশ-বিদেশে প্রশংসায় ভাসে। কিন্তু বেলা শেষে তাদের শৃঙ্খলিত বিষয় অধিকারে যুক্ত হয়নি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নাগরিক অধিকারের বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় কিন্তু সেটির অবস্থানও একপর্যায়ে এসে ম্লান হয়।
কিন্তু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩২টি রাজনৈতিক দল, দেশের কিছু নাগরিকও নানা ইঙ্গিত বহন করায় এবার সংবিধান বিতণ্ডা নিয়ে অজানা শঙ্কা কাজ করছে। পরিকল্পিতভাবে অনেকে বড় অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন। তাই ক্ষমতাসীন দলও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বলছে, আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। কেউ জল ঘোলার চেষ্টা করলেও লাভ হবে না। অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামপন্থী দলগুলো দাবি তুলেছে রাষ্ট্র সংস্কারের। তারা চায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও সরকারের পদত্যাগের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। প্রয়োজনে আবারও সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সংযুক্তের আহ্বান তাদের।
ভোটের এক বছর আগে এমন রাজনৈতিক বাগ্্যুদ্ধকে সূক্ষ্মভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ পর্যন্ত সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। তার কতটা জনগণের স্বার্থে আর কতটা শাসকদের স্বার্থে, সেই প্রশ্ন অতীতেও ছিল, এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। ভোটের আগে এবার নির্বাচন-ব্যবস্থা পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে আগাম দাবি তোলার উদ্দেশ্যের পেছনেও রহস্য রয়েছে। তা কতটা দেশের স্বার্থে, তা সময়ের সঙ্গে অবশ্যই দৃশ্যমান হবে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘিষ্ঠ ভোটারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করে। যারা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে, তারা প্রায়ই ৩১ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এতে ৬০ শতাংশ বা তদূর্ধ্ব মানুষ সরকারে তার প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত হয়, ভোটাররা এখানে গৌণ। ভোটের রাজনীতির এ এক অগ্নিপরীক্ষা। এবার ২০২৩ সালটি হবে খুবই অনিশ্চিত, স্পর্শকাতর ও আতঙ্কের।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘সংবিধানে যেভাবে নির্বাচনের কথা বলা আছে, সেভাবেই নির্বাচন হবে। ভোটাধিকার প্রয়োগে কেউ বাধা দিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল। ২০২৪ এর শুরুতে যে নির্বাচন হবে, তাতে সব দল অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করছি।’
সরকারের নীতিনির্ধারণী ফোরাম যেমন বলছেন আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান মেনে, তেমনি জাতীয় পার্টিও তা-ই বলছে। জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেছেন, ‘আমার দল কখনো ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। আগামী জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেবে। সংবিধান অনুযায়ীই হবে আগামী নির্বাচন। কেউ সংবিধান নিয়ে ষড়যন্ত্র করলেও লাভ হবে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘একটি দেশের সংবিধান হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। নাগরিকের জন্য আইনের শাসন ও সুবিচার নিশ্চিত করা হবে- সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা আছে। যার ফলে রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে বিএনপি ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে। গণতন্ত্রের প্রধান বাহন হলো নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে বাংলাদেশে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। বিরোধী দলের প্রার্থীকে ভোট করতে দেওয়া হয় না। প্রচারণা চালাতে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ ভোট-ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সরকার দলীয়করণের মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস ও নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে।’
ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধনের আবশ্যক রয়েছে। বর্তমান সংবিধান নিয়ে দেশের কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট নয়। বিরোধীরা এটিকে সংস্কার করতে চাইছে। সরকার পক্ষও বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরত যাওয়ার কথা বলে বর্তমান সংবিধানের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো এই সংবিধান রচনায় জনমতের তোয়াক্কা করা হয়নি। তাই ইসলামী আন্দোলন গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধনের প্রস্তাব করছে।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম বলেন, ‘আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীনদের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা না থাকা। সংবিধান অনুযায়ীই রাষ্ট্র, সরকার এবং সরকারি দল সবকিছু একাকার। সরকারপ্রধানের ক্ষমতার কোনো সীমারেখা নেই এবং তিনি সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা বদল বা সরকার বদলের পথ রুদ্ধ, অর্থাৎ নির্বাচন-ব্যবস্থা সংবিধান মোতাবেকই অকার্যকর। রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণের কাজ সরকারের ইচ্ছার অধীন। সংসদ, অর্থাৎ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাহী বিভাগের অধীন করে রাখা হয়েছে। তাই সংবিধান সংস্কারের যে দাবি এখন উঠেছে, সে দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয়।’