ভোটে জোটে দফারফা

ঢাকায় বিশ্ব চাপ-তাপের গোলকধাঁধা

বিশেষ প্রতিনিধি : কেবল অতি বাম, অতি ডান নয়; মধ্যপন্থী কয়েকটি মহলও এখন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে মিলেমিশে একাকার। তারা বিএনপির প্রতি সন্তুষ্ট বা দলটির ঘোরতর পক্ষ নিয়েছে এমনও নয়, তাদের ভূমিকা ও অবস্থান আপনাআপনি চলে যাচ্ছে বিএনপির দিকে। সরকার তা বুঝতে অক্ষম নয়। গোটা পরিস্থিতি সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল। কিন্তু তাদের রুখতে আপাতত সরকারের করণীয় কিছু নেই। কারণ অপজিশনের ডালপালা ছড়িয়ে গেছে নানা দিকে। পানি গড়িয়েছে অনেক দূর।
বিশ্বময় স্নায়ুচাপ ও তাপ দুটোরই এক রসায়ন এখন বাংলাদেশে। আগামী নির্বাচন সম্পর্কে সবার মতিগতি কাছাকাছি। আওয়ামী লীগ সরকারের একতরফা রক্ষক ভারতও আগের অবস্থানে নেই। নিজেদের এ সরকারের হিতাকাক্সক্ষী উল্লেখ করে হাতে ধরে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ভারত আর নেবে না, তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। সরকার এতে কাবু না হয়ে দেখিয়ে দেওয়ার গোঁ ধরেছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের কথার কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। গত কদিন ধরে চলা পরিস্থিতি বেশি দিন থাকবে না বলে নিশ্চিত সরকার। তখন বিশ্ব পরিস্থিতিদৃষ্টে নতুন পথ বের করে নেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী সরকার।
পরাশক্তিগুলোর স্নায়ুচাপের তাপ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ার তথ্য এখন আর গুঞ্জন-গুজবের পর্যায়ে নেই। বড় বড়দের কাছেও ছোট বাংলাদেশ একটি বিষয়। অ্যাজেন্ডাভুক্তও। বাংলাদেশকে বিশ্বের সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের পেয়ে বসা কূটনীতি না জানা মানুষেরও জানা হয়ে গেছে। বুঝেও গেছে। রাশিয়ার চাতুরীও ফাঁস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পণ্য নিয়ে আসা রাশিয়ার ‘স্পার্টা-৩’ জাহাজের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, রাশিয়া চালাকি করে জাহাজটির নাম পাল্টে ‘উরসা মেজর’ রাখা, রাশিয়ার চাপ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে জাহাজটিকে বাংলাদেশে ভিড়তে না দেওয়ার ঘটনা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের বোধগম্য।
এর পূর্বাপর ও রহস্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সাদা-কালোর মতো পরিষ্কার। সে অনুযায়ী তারা যার যার সক্ষমতা এবং ফরেন কানেকশন বাড়াচ্ছে। দিচ্ছে একের পর এক কর্মসূচি। সঙ্গে দফার পর দফা। এসব দফায় রফা খোঁজার দেন-দরবার চলছে নানান উইংয়ে। বিএনপি আন্দোলনের মাঠে ১০ দফায়। দলে আছে ১৯ দফা। রাষ্ট্র সংস্কারে যোগ করেছে ২৭ দফা। মোট এই ৫৬ দফার অন্তরালে আসলে এক দফায় এগোচ্ছে তারা। কিন্তু কেবল সরকার পতনের এক দফার কথা পরিষ্কার করছে না। সহযাত্রী বা মিত্র বাড়াতে তাদের বলতে হচ্ছেÑশুধু ক্ষমতা বদল নয়, ক্ষমতায় এলে কী পরিবর্তন আনবে সেই ওয়াদাও দিতে হচ্ছে। এর ফল মিলছে। কেবল জামায়াতসহ ডান নয়, বাম কট্টরসহ মধ্য ঘরানার অনেকেও যুগপতের নামে এখন অনুসরণ করছে বিএনপিকে। তবে এখনই প্রকাশ্যে মিতালি পাতছে না। দূরে দূরে, টুকরা টুকরা জট পাকাচ্ছে নানা সংখ্যার জোটে। এতে তারা সংখ্যায় যা-ই হোক, রাজনীতির ফয়সালা রাজপথে হওয়ার লক্ষণের পাশাপাশি নতুন রূপ পেতে যাচ্ছে জোট সংস্কৃতির পুরোনো ধারা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বিলুপ্তির পর নতুন দুটি জোট হয়েছে। জোটভুক্তরা সংখ্যায় ৩২/৩৩-এর মতো। বিএনপির সঙ্গে তাদের গাঁটছড়া বেশ পোক্ত। বিএনপির ১০ দফার সঙ্গে এককাট্টা তারা। জেনারেল (অব.) ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টিসহ সাবেক ২০ দলীয় মিত্রদের গড়া ১২ দলীয় জোট ঘোষণা দিয়েছে, বিজয়ের মাসে শুরু হওয়া যুগপৎ আন্দোলন চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত চলবে। রব, মান্না, নুরদের সাত-আট দল মিলে গড়া গণতন্ত্র মঞ্চের ঘোষণাও তা-ই। বাম ঘরানার আরো কয়েকটি দলও তা-ই বলছে। জামায়াতও নেমে পড়ছে। গণফোরামের একাংশও আছে এ কাতারে। অভিন্ন তারিখে গণমিছিল, গণ-অবস্থান, গণসমাবেশ ধরনের নানা কর্মসূচি চলছে তাদের।
বিএনপির সঙ্গে এসব দলের যুগপৎ আন্দোলনকে সাপের খোলস পাল্টানোর সঙ্গে তুলনা করছে সরকার। ৩২-৩৩টা অশ্বডিম্ব বলে তাচ্ছিল্যও করছে। আবার এসব দলকে মোকাবিলায় সরকারের যারপরনাই তৎপরতাও লক্ষণীয়। পুলিশ নিয়ে মাঠে নামছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীসহ চৌকস ক্যাডাররা, যা আগামী দিনে রাজপথের উত্তপ্ততার সংকেত। আর তা জোটগতভাবে হওয়ার আলামত স্পষ্ট। সরকারকে কাবু করতে বিরোধীদের জোটচর্চা। তা সরকারের টিকে থাকার চেষ্টার মাঝেও। এর মাঝে অনেক রহস্য ও তথ্য ভরা। যেখানে সামনে চলে আসে এ অঞ্চলে জোটের পুরোনো ইতিহাসের সঙ্গে নতুন প্রেক্ষিত। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের রাজনীতিতে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে জোটের রাজনীতি সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায় হয়েছে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে। তা ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর গঠিত হলেও ফল আসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে হটাতে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক দল, নেজামে ইসলামীর সম্মিলনে গঠিত হয়েছিল ‘যুক্তফ্রন্ট’। পরে খেলাফতে রব্বানী, গণতান্ত্রিক দল যুক্তফ্রন্টে শরিক হয়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানও জোট রাজনীতির ফল। আর সেটা আবর্তিত হয় ছাত্রদের ঘিরে। পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাস্তবায়ন ও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে হটাতে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান ছাত্রসংগঠনগুলোকে নিয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) আটজন ছাত্রনেতা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।
পরে তখনকার সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন এনএসএফ ভেঙে তাদের সদস্য মাহবুবুল হক দুলন, ইব্রাহিম খলিল, নাজিম কামরান সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেন। পর্যায়ক্রমে সংগঠনের বিস্তৃতি হয় এবং ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি এ সংগঠনটি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে এগারো দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে, যা ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি হিসেবে পরিচিত। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রায় সব রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জোট হয় ম‌ওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে। ওই জোট সরাসরি সফল হয়নি। তবে ফল চলে গেছে অন্য হাতে। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন সফল করে আওয়ামী লীগের আট দল, বিএনপির সাত দল ও বামপন্থীদের পাঁচ দল। সঙ্গে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। এরশাদের পতনের পরে জোট আনুষ্ঠানিক বহাল না থাকলেও নির্বাচন ও সরকার গঠনে ছিল জোটের আমেজ। তা ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের মধ্যেও। তবে জোট না বলে ঐকমত্যের সরকার নামে। পরে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের ব্যানারে আওয়ামী লীগ বিরোধিতা এবং ২০০১ সালে চারদলীয় জোট নিয়ে বিএনপির ক্ষমতারোহণ। চারদলীয় জোটকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আওয়ামী লীগ ১৮-১৯টি ছোট-বড় দল নিয়ে সংখ্যা ঊহ্য রেখে করে মহাজোট। এই জোট নিয়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় যায় ২৬৩টি আসন নিয়ে। এরপর বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে এখনো ক্ষমতাসীন তারা। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবি নিয়ে বিএনপি আন্দোলনে আছে গত ১৪ বছর। কিন্তু প্রতিটি আন্দোলন ব্যর্থ করে দিয়েছে সরকার। ড. কামালের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট করেও মার খেয়েছে বিএনপি। জামায়াতসহ কিছু দলকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে এখন জোট রাজনীতির ভিন্ন ফরম্যাট। সরকারি মহল থেকে তাদেরকে নিধিরাম সর্দার, বাম-ডানের কারবারি ইত্যাদি বলে তাচ্ছিল্য করছে। আবার ভয়ও পাচ্ছে। কারণ ১৯৬৯ সালে, একাত্তরে বা ১৯৯০ সালেও ‘অতি বাম, অতি ডান মিলেমিশে একাকার’ হওয়ার ঘটনা তাদের জানার বাইরে নয়। প্রকারান্তরে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের রাজপথের মীমাংসার বার্তা।