ভয়ংকর ঝুঁকিতে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারসহ ভিভিআইপিরা

বিশেষ প্রতিনিধি : সরকারের নানা পলিসি, দলের জন্য মঙ্গলজনক বিভিন্ন পরিকল্পনা, বিএনপিসহ বিরোধীদের দমনের নানামাত্রিক কৌশল, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের নানা স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তসহ সরকারের নেওয়া অতি গোপনীয় কোনো সিদ্ধান্তই আর গোপন থাকছে না। শুধু তা-ই নয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন অধিদপ্তর বা সরকারি সংস্থার অনেক গোপনীয় তথ্যও গোপন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সতর্কতা, আইনি কঠোরতার পরও সরকারের স্পর্শকাতর অনেক তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। গোপন থাকছে না গোয়েন্দা তথ্যও। বিষয়টি একদিকে যেমন রহস্যজনক, আরেকদিকে উদ্বেগজনক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথ্যফাঁসের ন্যূনতম ক্লু-ও মিলছে না। এতে সরকারের অভ্যন্তরে অবিশ্বাস ও সন্দেহ বাড়ছে। গড়পড়তা এর জন্য বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়ী করা হলেও সঠিক প্রমাণ মিলছে না। এছাড়া ফাঁস হওয়া তথ্যাদি বিএনপি-জামায়াতের কাছে যাচ্ছেও না। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা রয়েছেন চরম ঝুঁকিতে। প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যসহ ভিভিআইপিরা সর্বক্ষণ অজানা ভয়ংকর বিপদ মাথায় নিয়ে প্রতিটা দিন অতিক্রম করছেন।
পদ্মা সেতুর ব্যয়-বাজেট, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্পসহ অতি গোপনীয় কিছু তথ্য মহলবিশেষের কাছে চলে যাওয়ার ঘটনা সরকারকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর তথ্যও বাদ যায়নি। ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্নীতির বিস্তর তথ্য ফাঁস হয়েছে আরো আগেই। অর্থ, যোগাযোগ ও সেতু, শিক্ষা, আইসিটি মন্ত্রণালয় ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যয়-বরাদ্দের কিছু তথ্য বরাবর গোপনীয়ই রাখা হয়। কিন্তু সম্প্রতি এতে ছেদ পড়েছে। নির্বাচনের আগে প্রশাসনে এ ধরনের তথ্যফাঁসের ঘটনা সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিএনপি-জামায়াত ঘরানার আমলা-কর্মচারীদের পক্ষে তা সম্ভব নয় বলে মনে করছে সরকারের শীর্ষ মহল। ফাঁস হওয়া তথ্যাদি বিএনপির কাছেও যায়নি। এগুলোর গ্রহীতা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শক্তি। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কূলকিনারা করতে পারছেন না এসব তথ্য কারা ফাঁস করছে। কোন কারণে, কী উদ্দেশ্যে তারা সরকারের অভ্যন্তরীণ এসব তথ্যসাবুদ হাত করছে, তা-ও অজানা। বিষয়টি সরকারের জন্য চরম উদ্বেগের।
সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোপনীয় তথ্য ফাঁস ও পাচারের ঘটনাও বাদ যায়নি। কাউকে শনাক্ত করতে না পেরে দুদকের চেয়ারম্যান সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গড়পড়তা সতর্ক করেছেন। তা দুদকের অভ্যন্তরে পারস্পরিক সন্দেহের সঙ্গে অসন্তোষও তৈরি করেছে। এর বিপরীতে দুদকের লোগো ও সিল ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভুয়া নোটিশ দিয়ে আর্থিক সুবিধা হাতানোর চক্রও গজিয়েছে। এরা দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোন, টেলিফোন, ই-মেইল ব্যবহার করে; এমনকি কমিশনের লোগো-সংবলিত ভুয়া নোটিশ বা পত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি বা পেশার ব্যক্তিদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা দাবি করছে। এ ধরনের ঘটনা এড়াতে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সাক্ষী ও আসামিদের সঙ্গে অনুসন্ধানকারী বা তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সকল প্রকার যোগাযোগ লিখিত পত্রের মাধ্যমে করার নির্দেশনা দিয়েছে কমিশন।
বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ এর মালিকানা-বিষয়ক কিছু তথ্যও চলে গেছে নানা জায়গায়। তা উৎক্ষেপণের আগেই এর ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ ও সিগন্যাল বিকিকিনি নিয়ে সৃষ্টি হয় বিতর্ক। কয়েক মাস আগে নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আয়োজিত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এক সংবাদ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এ বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে সেখানে জানানো হয়, স্যাটেলাইট সিগন্যাল ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দের দায়িত্বে থাকবে দুটি প্রতিষ্ঠান। বেক্সিমকো গ্রুপ ও বায়ার মিডিয়া টিভি চ্যানেল ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ ও সিগন্যাল বিকিকিনির পুরো ব্যবসায়িক দিকটি উপভোগ করবে। এদের ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানি এখানে ডিটিএস প্রযুক্তির ব্যবসায় নামতে পারবে না। তাদের এ বক্তব্যের পর জটিলতার সঙ্গে গোপনীয় নানা তথ্যও ছড়াতে থাকে, যা ভবিষ্যতে সরকারের জন্য ভয়ানক বিপজ্জনক হতে পারে। ফেঁসে যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য ছাড়াও দলের বাঘা বাঘা নেতারা। এ অবস্থায় তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, সরকারকে বিপদে ফেলতেই কোনো একটি চক্র এই মিশনে নেমেছে। এরা সরকারের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে সরকারের গুণগান গেয়ে এসব অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, নেপথ্যে ওয়ান ইলেভেনের নায়কেরা আবার কলকাঠি নাড়া শুরু করেছেন। চারপাশের গুঞ্জন আর পরিস্থিতি আঁচ করে তাদের আশঙ্কা, আগামী জুলাই মাসে সরকার বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে। আর এই ধাক্কা সামাল দেওয়া সরকারের পক্ষে ভীষণ কঠিন হবে।
এদিকে মাঠ প্রশাসনে তথ্যফাঁসে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, পাতি নেতাদেরই দায়ী করেছেন জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় আমলারা। এডিসি, ইউএনও এবং এসিল্যান্ডরা সরকারের কাছে সুরক্ষা চেয়ে রেখেছেন আগেভাগেই। তারা বলেছেন, জনপ্রতিনিধি ছাড়াও স্থানীয় নেতাদের চাপে সরকারি বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারে তাদের হিমশিম খেতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নও ব্যাহত হয়। এসডিজি বাস্তবায়নে সরকারের টার্গেট পূরণও দুরূহ হয়ে পড়ে। তার ওপর ক্ষতিগ্রস্ত বা বঞ্চিতরা তখন যাবতীয় তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছেন, তা কোনোভাবেই রোখা যাচ্ছে না। স্থানীয় সরকার বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্থানীয় দলীয় চাপ বেশি। দাবিমতো, সুবিধা না পেলেই তারা বিগড়ে যায়। ফাঁস করে দেয় নানা হিডেন তথ্য।
তথ্যফাঁসের ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও চরম বিরক্ত। দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের কাছে তাদের পাঠানো গোপন তথ্য এভাবে ফাঁস হওয়ার ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে সেসব তথ্য পৌঁছানোর আগেই তা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে বিরোধ ও সন্দেহ বাড়ছে। কেবিনেট সচিব নিজস্ব প্যাডে সকল সচিবকে এ নিয়ে চিঠি দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, ডিজিএফআই, এনএসআইসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার অতি গোপনীয় সিলগালাকৃত খামের তথ্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ ছাড়া অন্য কেউ জেনে যাওয়া দুঃখজনক। শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্রের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।