এস এম মোজাম্মেল হক :
শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন কোনো প্রতিযোগিতার বিষয় নয়, বরং ভালো কাজের মাধ্যমে জনসমর্থনে এগিয়ে থাকাই শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। ভালো থেকে অধিকতর ভালোকে বেছে নেওয়ার উত্তম পদ্ধতি উভয়ের প্রতি জনসমর্থনের তুলনামূলক পার্থক্য। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সেবক হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অন্যতম পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনে বিজয়ী মানে ক্ষমতাসীন হওয়া নয়, বরং দায়িত্বপ্রাপ্তি। তবে নৈতিক অবস্থান থেকে বিজয়কে কে কীভাবে গ্রহণ করে, তার ওপর নির্ভরশীল। একটা সময় ছিল নিজেকে যোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা ছিল লজ্জা ও অহংকারের বিষয়, সাধারণ মানুষের নিকট যা ভালো বিবেচিত হতো না। হয়তো সময়ের পরিবর্তনে সে পদ্ধতিরই পরিবর্তিত রূপ কোনো পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নিজ থেকে উদ্যোগী না হয়ে প্রস্তাব ও সমর্থন করার রেওয়াজ হিসেবে বিদ্যমান, যা উল্লিখিত সাবেক পদ্ধতির বহিঃপ্রকাশ বটে। যদিও অতি উৎসাহী অনেককে নিজ থেকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিতে দেখা যায়। নিজেকে যোগ্য মনে করলে এরূপ ঘোষণাও দোষের নয়।
জনসেবার দায়িত্বপ্রাপ্তিকে অনেকেই ক্ষমতাপ্রাপ্তি বিবেচনা করে থাকেন এবং এরূপ বিবেচনাকারীরা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অঢেল আর্থিক সম্পদের মালিক বনে যান। অপরপক্ষে একবার ক্ষমতায় আরোহণ করতে পারলে নানা কূটকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে তা স্থায়ী করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। কোনো খারাপ লোক ক্ষমতা গ্রহণ করে যাতে অপব্যবহারের মাধ্যমে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে না পারে, সে কারণেই সংবিধান ও দেশের স্থায়ী আইনি কাঠামো এমন হওয়া দরকার, ক্ষমতা গ্রহণ করে যাতে কেউ স্বেচ্ছাচারী হতে না পারে। এদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও স্থায়ী আইনি কাঠামো এমনভাবে বিন্যস্ত যে ইচ্ছে করলেই কেউ একক ক্ষমতাবলে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারে না।
আর সে কারণেই দুনিয়াজুড়ে আমেরিকার গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবিক মূল্যবোধ এত প্রসংশিত। যার বাস্তব প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল পাল্টে দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অপচেষ্টা করা সত্ত্বেও তা সম্ভব হয়নি। চূড়ান্ত ফল ঘোষণার প্রাক্কালে ফলাফল বিঘ্নিত করার জন্য ক্যাপিটাল ভবনে একদল উগ্রপন্থীর হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অনেকের প্রাণহানি ঘটে। শক্তিশালী তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে শুরু করে, যার নেপথ্যে ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের আশকারা ও পৃষ্ঠপোষকতা, যদিও বিষয়টির চূড়ান্ত আইনি ফয়সালা এখনো হয়নি।
সদ্য সমাপ্ত মধ্যবর্তী নির্বাচনের পূর্বেও বিভিন্ন জরিপ ও বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে উগ্রপন্থীদের ভোট চলাকালীন এবং ফলাফল ঘোষণার প্রাক্কালে অনুরূপ দাঙ্গা-হাঙ্গামার আশঙ্কা করা হলেও বাস্তবে তেমন কিছুই হয়নি, যা অত্যন্ত স্বস্তির। ভোটে না জিতলে সন্দেহবাদীদের ফলাফল মেনে নেওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট ঘোষণা না থাকায় বিশেষজ্ঞরা আমেরিকার গণতন্ত্র হুমকির মুখে বলে ভাবতে শুরু করেন এবং এতে রসদ জোগায় কিছু জরিপকারী প্রতিষ্ঠান। প্রায় প্রতিদিনই একাধিক প্রতিষ্ঠানের জরিপে লাল ঢেউয়ের সুনামির আভাস দেওয়া হয় কিন্তু নির্বিঘ্নে নির্বাচন ও ফল প্রকাশের পরে জরিপের নিরপেক্ষতা ও বাস্তবতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। বরং লাল-অধ্যুষিত অনেক সিটে নীল দলের অপ্রত্যাশিত ফল লাভ হয়। যদিও নীল হিসেবে খ্যাত নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ায় আশানুরূপ ফলাফল লাভ হয়নি। এ জন্য দলের নেতৃস্থানীয়দের কিছু অতি আশাবাদী মনোভাব এবং ভুল হিসাব দায়ী। নির্বাচন-পূর্ব ক্যাম্পেইনে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে দলের রেজিস্টার্ড লিডারদের অনেকের দলের বিপক্ষে অবস্থান ও প্রচার-প্রপাগান্ডা নীল দলের সিট হারানোর জন্য অনেকটা দায়ী বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তা সত্ত্বেও মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের হাউসের যে কয়েকটি সিট হারাতে হয়, জরিপের ফলাফলের তুলনায় তা তেমন কিছুই নয়। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রেখে হাউসের যে কটি সিট হারিয়েছে, তা আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম। ৬ ডিসেম্বর জর্জিয়ার রানঅফে ওয়ার্নক-ওয়াকারের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস সত্ত্বেও চূড়ান্ত ফলাফল ডেমোক্রেটদের পক্ষে যাবে বলেই অনেকের অভিমত।
বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে স্থানীয় ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু থাকায় নির্বাচনী প্রচারে কেন্দ্রীয় ইস্যুর পাশাপাশি স্থানীয় ইস্যুগুলোকে স্থানীয়ভাবে যতটা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা প্রয়োজন ছিল, ততটা সফলভাবে করা হয়েছিল কি না, এ নিয়েও বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমত রয়েছে। সিনেট আসনের জন্য যে পরিমাণ প্রচার চালানো হয়েছে, হাউসের জন্য অনুরূপ জোরালো প্রচার চালানো হলে নীল দলের পক্ষে হাউসও ধরে রাখা সম্ভব হতো বলে অনেকের ধারণা। নির্বাচন-পূর্ব একটি নিবন্ধে নারী ও যুবা ভোটারদের ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করার ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি ইতিবাচক হয়েছে বলেই মনে হয়।
প্রতিটি সমাজই কমবেশি সমস্যাসংকুল এবং তার প্রধান ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। রাজনীতিকদের দায়িত্ব সমস্যা চিহ্নিত করে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। এ ব্যাপারে এক পক্ষ উভয় বিষয়ে যতটা তৎপর, অন্যপক্ষ তার অর্ধেক নিয়ে ভাবে অর্থাৎ সমস্যা চিহ্নিত করেই তারা খালাস। সমাধানের ব্যাপারে তাদের তেমন উদ্যোগী হতে দেখা যায় না। যেমন যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন মহল থেকে প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র বহনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের আইনি বিধিনিষেধের দাবি ওঠা সত্ত্বেও এক পক্ষ বরাবরই তার বিরোধিতা করছে। ফলে প্রতিবছর আগ্নেয়াস্ত্রজনিত সহিংসতায় কয়েকশ লোকের প্রাণহানি ঘটছে এবং তার কয়েক গুণ বেশি পঙ্গুত্ব বরণ করছে। তাই সময় এসেছে রাজনীতিকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করে জনস্বার্থে ব্যবহার করার। অন্যথায় জনগণ যথাসময়ে জনবান্ধব নয় এমন লোকদের ঠিকই বিদায় জানাবে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফল সেই ইঙ্গিতই বহন করে। বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি তারা উপলব্ধি করতে পারবেন; দেশ, জনতা ও তাদের জন্য ততই মঙ্গল।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক, জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক।