মনসুরের শপথের পর বিএনপির নির্বাচিতরা নজরদারিতে তারেকের নির্দেশে এ কৌশল

রাজনৈতিক ডেস্ক : দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সুলতান মনসুর শপথ নিয়ে জাতীয় সংসদে যোগ দেয়ায় বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয়জনকে কঠোর নজরদারিতে রাখছে দলীয় হাইকমান্ড। লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ পেয়ে তার ক’জন অনুসারী এ ছয়জনের গতিবিধি সর্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তারা যেন শপথ নিয়ে সংসদে গিয়ে বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতে না পারে সে জন্যই এ কৌশল নেয়া হয়েছে।
সূত্র মতে, গত ৭ মার্চ স্পিকারের কাছে শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেয়ায় সুলতান মনসুরকে গণফোরাম ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বহিষ্কার করলেও সংবিধান অনুসারে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হচ্ছে না বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গণফোরাম থেকে নির্বাচিত মোকাব্বির খানও যেকোনো দিন শপথ নিতে সংসদে যেতে পারেন। একইভাবে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয়জনও শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেয় কি না বিএনপি হাইকমান্ডের মধ্যে এমন সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ জন্য তারা এই ছয়জনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। জানা যায়, লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশনা পেয়ে দেশে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার ক’জন অনুসারী দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত ছয়জনকে সার্বক্ষণিকভাবে নজরদারিতে রাখছেন। তারা কখন কোথায় যান, কি করেন, কার সঙ্গে কথা বলেন তার খোঁজখবর রাখেন। আর এ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয়জনও অস্বস্তিতে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর দল থেকে নির্বাচিতরা যাতে সংসদে না যান এ জন্য তাদের প্রতি কঠোর নির্দেশ জারি করে বিএনপি হাইকমান্ড। শপথ নিয়ে সংসদে গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ারও হুমকি দিয়ে রাখা হয়। কিন্তু নির্বাচিতদের মধ্যে কেউ কেউ দলের এ নির্দেশনায় নাখোশ হন। সুলতান মনসুরের শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার পর গণফোরামের পক্ষ থেকে স্পিকারকে বিষয়টি অবহিত করার পরও তার সদস্য পদ বাতিল না হওয়ায় বিএনপির নির্বাচিতরাও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দেয় কি না এমন সন্দেহ সৃষ্টি হয় হাইকমান্ডের। কারণ সংবিধানে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দিলে সদস্য পদ বাতিলের বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই। তাই বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয়জনও যদি পদত্যাগ না করে সংসদে যোগ দেন এবং পরে দল থেকে বহিষ্কার হন তাহলে সংবিধান অনুসারে তাদের সদস্য পদ বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
নবম জাতীয় সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এইচ এম গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সদস্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বহাল ছিল। তার আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে অষ্টম জাতীয় সংসদের (২০০১-২০০৬) শেষের দিকে বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। সে ক্ষেত্রেও তার সদস্য পদ বহাল ছিল।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দল থেকে পদত্যাগ করলে জাতীয় সংসদের সদস্য পদ থাকে না। কিন্তু কেউ দল থেকে বহিষ্কার হলে তার সদস্য পদ বাতিল হবে কি না সে বিষয়ে কিছু নেই। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ওই রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ করলে বা দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার আসন শূন্য হবে।’ তবে কোনো দল থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর ওই দল থেকে কাউকে বহিষ্কার করলে সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে কি না সংবিধানে এমন কোনো বিধান নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. বশির আহমেদ বলেন, কোনো দল জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে নির্বাচিত হয়ে সংসদে না গেলে সে দলই সংবিধান লঙ্ঘন করে। ওই দলের নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি সংসদে যোগ দিলে সংবিধান লঙ্ঘন হয় না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ওই রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ করলে বা দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার আসন শূন্য হবে। তাই সুলতান মনসুরের কিংবা বিএনপির কেউ পদত্যাগ না করে সংসদে যোগ দিলে সদস্য পদ বাতিলের সম্ভাবনা নেই।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম মনোনীত সুলতান মনসুর জোটের শরিক দল বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন। আর গণফোরামের আরেক মনোনীত প্রার্থী মোকাব্বির খান নিজ দলের প্রতীক উদীয়মান সূর্য নিয়ে সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এর বাইরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিএনপির মনোনয়নে নিজ দলের প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে বিজয়ী হন আরও ছয়জন। সব মিলিয়ে বিএনপির ছয়জন ও গণফোরামের দুইজনসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বিজয়ী হন ৮ জন।

দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগ দেয়ার বিষয়ে সুলতান মনসুরই প্রথম নজির সৃষ্টি করলেন। এর আগে দেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সংসদ সদস্যদের দল বদলের ঘটনা থাকলেও সুলতান মনসুরের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, এর আগে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। এ ছাড়া নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদ সদস্য দলত্যাগ করেছেন এমন ঘটনা দুয়েকটি রয়েছে। তবে নির্বাচিত হয়ে শপথ না নেয়া ও সংসদে যোগ না দেয়ার ঘটনাটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নির্বাচিত ছয়জন সংসদে না গেলে এটি হবে এমন ঘটনা প্রথম। সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচিত কোনো সদস্য সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠক থেকে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে শপথগ্রহণ না করলে, তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত আটজনের মধ্য থেকে মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে নির্বাচিত সুলতান মনসুর শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেয়ায় আর বাকি রয়েছেন সাতজন। এর মধ্যে সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচিত মোকাব্বির খান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। যেকোনো দিন তিনি শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দিতে পারেন। এ ছাড়া বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচিত ছয়জনও সংসদে যোগ দিতে পারেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে যে ছয়জন নির্বাচিত হয়েছেন তারা হলেনÑ বগুড়া-৬ আসন থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বগুড়া-৪ থেকে মোশাররফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ থেকে মো. আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ থেকে মো. হারুন উর রশিদ, ঠাকুরগাঁও-৩ থেকে জাহিদুর রহমান জাহিদ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তাই বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয়জনের শপথ কিংবা সংসদে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যেন সংসদে যাওয়ার চেষ্টা না করে তা অনেক আগেই বলে দেয়া হয়েছে। নির্বাচিত ছয় বিএনপি নেতাকর্মীদের পর্যবেক্ষণে আছে। যদি কেউ দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাহলে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।