ড সা’দত হুসাইন
আমার মূল লেখাটি একটি কল্পিত দেশের ওপর রচিত হলেও শিরোনামের ‘দেড় নম্বরি’ শব্দবন্ধটি এবং এতদ্সংক্রান্ত ধারণা () বাস্তব অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। এর জন্মস্থান মক্কা-মদিনা এবং জন্মকাহিনি পবিত্র ওমরাহ হজকে ঘিরে।
বছর তিনেক আগে আমার বন্ধু প্রকৌশলী দেলোয়ার ও আমি সস্ত্রীক ওমরাহ ব্রত পালন করব মনস্থির করি। আমি তখন একটি বড় ব্যাংকের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করি। সে ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য আলাদা ডিভিশন রয়েছে। এ ডিভিশনের সঙ্গে হজ এজেন্সিগুলোর ভালো যোগাযোগ রয়েছে। ডিভিশনের কর্তাব্যক্তি তাঁর বিবেচনায় একটি সুখ্যাত এজেন্সির প্রধানকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন যে আমরা নিঃসংকোচে তাদের ওপর নির্ভর করতে পারি; তারা খুবই বিশ্বাসযোগ্য। এজেন্সিপ্রধান একজন চৌকস ভদ্রলোক। কথাবার্তায় মসৃণ, আমাদের প্রায় সব প্রস্তাবে ইতিবাচক সায় দিলেন। আমরা তাঁর চাহিদামতো টাকা-পয়সা দিতে রাজি হলাম। ঠিক হলো যে মক্কা-মদিনায় তাঁর এজেন্সির লোকজন আমাদের সেবার গ্রাহক হিসেবে অভ্যর্থনা জানিয়ে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে যাবে।জেদ্দায় আমরা এজেন্সির সাহায্য গ্রহণ করব না, বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা আমাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবেন। ফিরতি যাত্রায় মদিনা থেকে জেদ্দা পর্যন্ত আমাদের ভ্রমণের সমুদয় ব্যবস্থা হজ এজেন্সি সম্পন্ন করবে। এজেন্সিপ্রধান আমাদের আশ্বস্ত করলেন যে কোনো জায়গায় বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবে না; সব জায়গায় তার লোকজন সম্পূর্ণ অবহিত ও প্রস্তুত রয়েছে।
যথাসময়ে সাউদিয়া বিমানের ফ্লাইটে আমরা জেদ্দা পৌঁছালাম। বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা আমাদের এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা জানালেন। রাতে একটি হোটেলে কাটিয়ে সকালে মিশনের গাড়িতে আমরা মক্কায় হোটেল হিলটনে পৌঁছালাম। সেখানে হজ এজেন্সির কাউকে পেলাম না। রিসিপশনের বাংলাদেশি কর্মচারী আমাদের জানাল যে রুম বুকিং করা আছে। আমরা অভ্যর্থনা কক্ষে অপেক্ষা করতে পারি; এরই মধ্যে তারা হজ এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করবে। কিছুক্ষণ পর কর্মচারীটি আমাদের জানাল যে একজন গাইডজাতীয় লোক তাদের ফোনে জানিয়েছেন, তিনি শিগগিরই এসে আমাদের তাওয়াফে নিয়ে যাবেন। আমরা যেন অপেক্ষা করি। গাইড ভদ্রলোক আসার পর হোটেল কর্মচারী আমাদের পরামর্শ দিল যে আমরা ইচ্ছা করলে গাইডের সঙ্গে গিয়ে তাওয়াফ সেরে ফেলতে পারি। হজ এজেন্সির লোক এরই মধ্যে এসে পড়বে। ফিরে এসে আমরা আনুষ্ঠিকতা সেরে রুমে উঠে যেতে পারব। তাই হলো। আমরা গাইডের সঙ্গে গিয়ে ওমরাহের মূল কাজ অর্থাৎ তাওয়াফ সেরে ফেললাম। ফিরে এসে দেখি, স্থানীয় এক বাঙালি আমাদের সেবা দিতে উপস্থিত হয়েছে। সে আমাদের হোটেলে আবাসনের ব্যবস্থা করে দিল। মক্কায় অবস্থানকালের অন্যান্য কর্মসূচি সম্পর্কে আমাদের অবহিত করল। বর্ণিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণযোগ্য মনে হলো। অবশেষে সে জানাল যে ভিন্ন একটি এজেন্সি থেকে সে এসেছে। যে এজেন্সি ঢাকা থেকে আমাদের ওমরাহর দায়িত্ব নিয়েছে মক্কায় তাদের কোনো অফিস বা জনবল নেই। সে কারণে তার এজেন্সি আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। অনেকটা সৌজন্যের খাতিরে তারা আমাদের জন্য এ কাজ করছে। ঢাকায় হজ এজেন্সিতে ফোনে যোগাযোগ করে জানা গেল এই ব্যক্তির কথা একবারে মিথ্যা নয়, তবে পুরোপুরি সত্য নয়। আমাদের হজ এজেন্সির আসলেই মক্কা-মদিনায় কোনো অফিস বা লোকবল নেই। স্থানীয় বড় এজেন্সিগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ও লোকজন দিয়ে আমাদের মতো সেবার গ্রাহকদের ওমরাহসংক্রান্ত কার্যাদি তারা সম্পন্ন করে থাকে। এ কাজ নিশ্চয়ই ব্যবসায়িক ভিত্তিতে করা হয়, সৌজন্যের খাতিরে বিনা পয়সায় নয়।
এখানে আমার একটি নতুন অভিজ্ঞতা হলো। ভাবনার রসদও পেলাম। আমাদের হজ এজেন্সিকে সম্পূর্ণ ভুয়া বা দুই নম্বরি বলা যাবে না। আবার সন্তোষজনক মানের এক নম্বরি প্রতিষ্ঠানও বলা যাবে না। তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। মক্কা-মদিনা দুই জায়গায় জোড়াতালি দিয়ে আমাদের ওমরাহসংক্রান্ত কাজগুলো অর্ধ সন্তোষজনকভাবে একে-ওকে ধরে তারা সম্পন্ন করাতে পেরেছে। কিন্তু এজেন্সির মালিক ঢাকায় বসে যেসব প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস দিয়েছেন তা কোনোভাবেই পূরণ করতে পারেননি। এর বেশির ভাগ ফাঁপা () বুলিতে পর্যবসিত হয়েছে। মক্কায় তাদের কোনো লোক নেই। অন্য এজেন্সির সহায়তা নিয়ে তারা কাজ সম্পাদন করে। তাদের তাই খাঁটি এক নম্বরি প্রতিষ্ঠান বলা যায় না, আবার অস্তিত্বহীন দুনম্বরি জালিয়াত প্রতিষ্ঠানও বলা যায় না। আমি তাদের ‘দেড় নম্বরি’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করছি। আমাদের দেশে এ ধরনের বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের নিয়েই আমাদের বাঁচতে হচ্ছে।
জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তিক পর্যায়ে নিত্যদিনের কর্মকা-ে () যেসব আশ্বাস দেওয়া হয়, যেসব অঙ্গীকার শোনা যায়, যে সমঝোতা ও চুক্তিতে বিভিন্ন পক্ষ আবদ্ধ হয় তার বেশির ভাগের বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় না। মুখের কথায় বিশ্বাস করে এগোলে পরিণামে ঠকতে হয়। প্রতি ক্ষেত্রে, দুঃখজনক হলেও সন্দেহ ও অবিশ্বাস নিয়ে লোকজনকে কাজ করতে হয়।
দেড় নম্বরি কল্পদেশ এ ধরনের একটি রাষ্ট্রের নাম। সে দেশে সম্পূর্ণ সত্য কথা, শুদ্ধ () তথ্য, বিশ্বাসযোগ্য আশ্বাস কিংবা বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনার সন্ধান মেলে না। এ দেশের উঁচু স্তর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত প্রায় সবাই নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বাড়িয়ে-কমিয়ে তথ্য সরবরাহ করে। তথ্যটি পুরো সত্য নয় এটি নিঃসংকোচে বলা যায়, এটি আবার একেবারে মিথ্যা নয় যে একজন নাগরিক তা সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করে উড়িয়ে দেবে অসুবিধা হচ্ছে, সত্য-মিথ্যার জগতে পরিবেশিত তথ্যের অবস্থান কোথায় তা আন্দাজ করা মুশকিল।
কল্পদেশের ভূমি উর্বর। প্রাচীনকাল থেকে অল্প শ্রমে ফসল ফলে। এ রকম উর্বর জমি পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। কল্পদেশের সাধারণ মানুষ তো বটে, বুদ্ধিজীবীরাও বলে বেড়ান যে তাঁদের দেশের মাটি পৃথিবীর সব দেশের মাটির চেয়ে বেশি উর্বর। এ মাটিতে সোনা ফলে। পৃথিবীখ্যাত মৃত্তিকাবিদরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছেন, আসলে কল্পদেশের মাটি মধ্যম মানের। উপযুক্ত সার ও সেচ প্রয়োগ করলে এ মাটির উৎপাদিকা শক্তি বাড়ানো যেতে পারে। তার ফলে যে খাদ্যশস্য উৎপন্ন হবে তাতে কল্পদেশের লোক আমদানি ছাড়া খেয়ে-পরে ভালোভাবে কালাতিপাত করতে পারবে। কল্পদেশের লোকজন হাল ছাড়তে রাজি নয়। তারা এর পরও জোর গলায় বলবে যে তাদের মাটিই সর্বেসর্বা। এর ওপরে আর কোনো মাটি নেই। একইভাবে তারা বিশ্বাস করে এবং প্রচার করে বেড়ায় যে কল্পদেশের নাগরিকরা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ধীশক্তিসম্পন্ন। জ্ঞান-গরিমায় তারা বিশ্বসেরা, যদিও এ বক্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। আবিষ্কার-উদ্ভাবনের দিক থেকে তাদের অবস্থান নিচের দিকে বলা যায়। রেকর্ড থাকার দরকার নেই, তাদের মুখবাজি থাকলেই চলবে। তাদের বক্তব্য শতভাগ মিথ্যা নয়। তবে এর মধ্যে সত্যের ঘাটতি রয়েছে।
কল্পদেশের আর্থিক অবস্থা ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। দেশটি একসময় ভয়ানক অনুন্নত ছিল। বিশ্বসভায় দেশটিকে নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রƒপ করা হতো। সবচেয়ে অনুন্নত দেশের কাতারে দেশটি শামিল ছিল। এখন অবস্থা বদলেছে। দেশের লোকগুলো অনেক খাটাখাটনি করেছে। নতুন প্রযুক্তি সোৎসাহে গ্রহণ করেছে। স্ত্রী-সন্তান দেশে রেখে একলা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশে কঠোর পরিশ্রম করে টাকা-পয়সা জমিয়েছে। সে টাকায় পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। জমিজমা কেনা হয়েছে। ঘরদোর বানানো হয়েছে। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায় বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। ঘটা করে বলা হয়, প্রবাসীদের পাঠানো টাকা বা রেমিট্যান্স দিয়ে বাংলাদেশ চলছে। এটিও একটি বাড়তি কথা। প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় দেশের উপকার হয়, তাই বলে এ টাকায় দেশ চলে বা এ অর্থ না হলে দেশ অচল হয়ে যাবেএমন কথা ঠিক নয়। এটি একটি দেড় নম্বরি কথা; পুরো মিথ্যা নয়, আবার এটি সত্য কথা এমন বলা যাবে না।
কল্পদেশের লোকের আয় বাড়ছে। এটি সুখবর। এ দেশের নাগরিকরা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের আশা করতে পারে। তবে যে হারে তাদের আয় বাড়ছে তাতে উন্নত দেশ হতে বেশ সময় লাগবে। এটি স্বাভাবিক। কোনো ঐন্দ্রজালিক ঝাড়ফুঁক দিয়ে রাতারাতি উন্নত দেশ হওয়া যায় না। ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় একটানা এগিয়ে গেলে যেভাবে সীমারেখা অতিক্রম করে উন্নত দেশগুলো বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে, কল্পদেশও তেমনিভাবে যথাসময়ে সে অবস্থানে পৌঁছতে পারবে। প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এটাই বড় কথা। কল্পদেশকে মনে রাখতে হবে, তারা যেন হোঁচট না খায় অথবা তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার ভাগ্য বরণ না করে। অসুবিধা হলো কল্পদেশের লোকেরা হিসাব-নিকাশ না করে বাড়তি কথা বলতে পছন্দ করে। তাদের অনেকেই বলে থাকে, শিগগিরই তারা উন্নত দেশের নাগরিক হয়ে যাবে। সে দেশের শিক্ষিত লোক, এমনকি অর্থনীতির কতিপয় ছাত্রও এ ধরনের বিভ্রান্তিতে ভোগেন। তাদের বাড়তি বক্তব্য আস্থাহীনতার সৃষ্টি করে। অর্থনীতি পেশায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা তাঁদের দেড় নম্বরি হিসেবে বিবেচনা করে।
কল্পদেশে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে এসব প্রকল্প দেশের মর্যাদা বাড়াবে। কয়েকটি প্রকল্পকে উন্নত দেশের বৃহৎ প্রকল্পের সঙ্গে তুলনা করা যায়। পার্থক্য হচ্ছে, উন্নত দেশে এ ধরনের প্রকল্পের সংখ্যা অনেক বেশি। কল্পদেশের নাগরিকরা অবশ্য বলে বেড়াতে পছন্দ করে যে তাদের প্রকল্পগুলো পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম। তা না হলে এসব প্রকল্প সুয়েজের পূর্বে, নিদেনপক্ষে তাদের ভৌগোলিক অঞ্চলে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। কোনো রকমইে তারা দ্বিতীয় হতে রাজি নয়। এমন স্ফীত দাবি তাদের খাটো করে। বিদেশিরা তাদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চায় না। তাদের দুনম্বরি মনে না করলেও ‘দেড় নম্বির’ মনে করে। কথাবার্তায় সাবধান না হলে এ ধরনের দাবি পরিণামে দেশের মর্যাদা ক্ষুণœ করে। কল্পদেশের প্রকল্পকে সর্ববৃহৎ কিংবা এক নম্বরে অবস্থান করতে হবেএমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
যেকোনো পরিস্থিতিতে ওয়াদা রক্ষা করা, মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া থেকে বিরত থাকা, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশন করা একজন সভ্য মানুষকে সংজ্ঞায়িত করে। কল্পদেশের লোকজন যদি দেড় নম্বরি কাজকর্ম চালিয়ে যায়, তবে বিশ্ববাসী তাদের বিশ্বাস করবে না। কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কল্পদেশের নাগরিকদের ব্যবসার অংশীদার () বানাতে চাইবে না। ফলে কল্পদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। দেশের মধ্যেও একে অপরকে বিশ্বাস না করায় যৌথ ব্যবসা বা বিনিয়োগের প্রসার হবে না। পারস্পরিক আস্থা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পুঁজি তথা আর্থিক সম্পদের শক্তিবর্ধক অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। দেড় নম্বরি আচরণের মাধ্যমে এ সম্পদ বিনষ্ট হলে কল্পদেশের বিরাট সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়বে। তখন উচ্চ মর্যাদার সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের কাতারে শামিল হওয়া কল্পদেশের জন্য অলীক স্বপ্নই থেকে যাবে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান