মনে পড়ে বাবাকে

মোহাম্মদ সোহরাব আলী

বাবা ব্রেন স্ট্রোক করে বেডে ছিলেন প্রায় ১০ বছর। কেউ কাছে গেলে বা কাউকে কাছে পেলে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিতেন। বাবার অনেক বন্ধু প্রায়ই বাবাকে দেখতে আসতেন, বাবা তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে কেঁদে দিতেন। বাবার বন্ধুরা তাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিতেন। বাবা নিজের কোনো কাজই নিজে করতে পারতেন না। বাবার পাশে সব সময় ছায়ার মতো থাকতেন মা।

বাবা একা একা থাকলে আরও বেশি কান্না করতেন। তিনি প্রায় সময়ই আমাদের ডাকাডাকি করতেন। রাতে বাবা না ঘুমিয়ে জেগে থাকতেন। ব্রেন স্ট্রোক করার কারণে মাঝেমধ্যে বাবা কী বলতেন, তা নিজেও বুঝতে পারতেন না। বাবা আমাকে কাছে পেলে বাজান বাজান বলে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন। বাবা আমাকে কত যে ভালোবাসতেন, আমি যখন ছোট ছিলাম, বাবা হাটে গেলে আমার জন্য কত কিছু যে কিনে আনতেন। আমি বাবার সঙ্গে কোথাও গেলে কী যে আনন্দ পেতাম। বাবা কখনো কোনো অন্যায় করা দেখলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। ছোটবেলায় একবার একজনের খেত থেকে মটরশুটি তুলে আনতে গিয়েছিলাম, বাবা বলেছিলেন, এটা কখনো করা যাবে না। এটা অনেক বড় ধরনের অন্যায়। আর জমির মালিক যদি দেখে, তাহলে গালমন্দ করতে পারে।

বাবা ছিলেন একজন কৃষক। তিনি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ-কালাম পড়ে মাঠে গরু নিয়ে লাঙল দিয়ে জমি চাষ করতে যেতেন। মা সকাল সকাল রান্না করে বাবার জন্য খাবার রেডি করে দিতেন আর আমি মাঠে গিয়ে বাবার খাবার দিয়ে আসতাম। বাবার সঙ্গে মাঠে বসে কত খেয়েছি। বাবা চৈত্র মাসে প্রখর রোদেও মাঠে কাজ করতেন। মাঝেমধ্যে জগে করে পানি ভরে বাবাকে মাঠে দিয়ে আসতাম।

আমাদের ছিল গাভির বাতান। বাবা গাভি থেকে দুধ দোহন করতেন, সেই দুধ আমরা খেয়ে কী যে মজা পেতাম। বাবা ধোনায় করে দুধ দোহন করতেন এবং ধোনায় দুধের সর জমাট বেঁধে থাকত। আম্মা দুধের সর দিয়ে ঘি বানাতেন। সেই ঘি খিচুড়ি দিয়ে খেলে কী যে স্বাদ পাওয়া যেত। বাবা প্রচুর সবজি উৎপাদন করতেন। অনেক ব্যাপারী আমাদের খেত থেকে সবজি কিনে নিয়ে যেত। মাঝেমধ্যে বাবার সঙ্গে হাটে গিয়ে কত সবজি বিক্রি করেছি।

বাবা বাঙির চাষ করতেন। বাঙির খেত থেকে কত পাকা বাঙি বাবার সঙ্গে তুলে নিয়ে এসেছি। আমাদের খিরার খেত ছিল। খিরা যেন কেউ তুলে না নিয়ে যায়, সে জন্য বাবা খিরার খেতে নাড়া দিয়ে ছোট ঘর তৈরি করতেন, যাকে গ্রামের ভাষায় বাওর বলা হতো। বাবার সঙ্গে গিয়ে বাওরে বসে থেকেছি আর খেত থেকে খিরা তুলে বাওরে বসে খেয়েছি।

আমাদের বাড়ি ছিল পদ্মা নদীর ধারে। ইলিশ মৌসুমে বাবা সোবা, শাকলি ও সাদি জাল দিয়ে কত বড় বড় ইলিশ মাছ ধরতেন। নদীর কিনারে গিয়ে বসে থাকতাম। বাবার সঙ্গে মাছ নিয়ে বাসায় আসতাম। ইলিশ মাছগুলো দেখতে কী যে সুন্দর লাগত। বাবার সঙ্গে বসে কত ইলিশ মাছ খেয়েছি। বাবা মাঝেমধ্যে তার পাতের ইলিশ মাছ আমার পাতে তুলে দিতেন। বাবার কাঁধে উঠে কত যে নদীতে গোসল করতে গিয়েছি। নদীতে বাবার হাত ধরে গোসলে নেমেছি। বাবা গায়ে সাবান মেখে দিয়ে গোসল করিয়ে দিয়েছেন। বাবা আবার কাঁধে করে বাসায় নিয়ে এসেছেন। ছোটবেলায় বাবা পাটখড়ি দিয়ে নৌকা বানিয়ে দিয়েছেন, সেই নৌকা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কত প্রতিযোগিতা করেছি। বাবা নারকেলের পাতা দিয়ে চশমা, খেজুরের পাতা দিয়ে বুনবুনি, কলার পাতা দিয়ে বাঁশি বানিয়ে দিয়েছেন। বাসায় কোনো দোকানদার খেলনা নিয়ে এলে বাবার জামার পকেট থেকে টাকা নিয়ে কিনেছি।

বাবার সঙ্গে মেলায় গিয়ে কত লাটিম, বেলুন, মাটির টমটম গাড়ি কিনেছি। বাবা মেলা থেকে জিলাপি কিনেছেন। গরম গরম জিলাপি কত খেয়েছি। বাবার সঙ্গে নানাবাড়ি গিয়ে কী যে মজা পেয়েছি। বাবার সাইকেলের পেছনে বসে গিয়েছি।

বাবা আমাকে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কত যে উৎসাহ দিতেন। প্রায়ই বলতেন, বাজান, পড়ালেখা কিন্তু ভালো করে করিস। একবার মনে পড়ে, আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিই, বাবা আমার পরীক্ষার সেন্টারে গিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেছিলেন এবং অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে কেঁদে দিয়েছিলেন। পরীক্ষার ফলাফল ভালো হলে বাবা মিষ্টি কিনে এনে সবাইকে খেতে দিয়েছিলেন।
আমি আমেরিকায় চলে আসার সময় বাবা যে কীভাবে কান্নাকাটি করেছিলেন। বাবা কত যে আশীর্বাদ করেছিলেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে। বিদেশ থেকে কল দিয়ে কথা বললে বাবা যে কী খুশি হতেন। বাবা প্রায়ই বলতেন, বাবা, তোর সাথে কথা বললে আমার অনেক ভালো লাগে। বাবা আবার মাঝেমধ্যে কেঁদে দিতেন। বাবাকে আমেরিকা থেকে কল দিলে কীভাবে যে বাজান বাজান বলে ডাকতেন। বলতেন, বাজান, দেশে আয়, তোকে দেখলে আমার অনেক ভালো লাগবে। আমি আমেরিকা থেকে দেশে গেলে বাবা আমাকে দেখে কী যে খুশি হতেন। আমি কাছে গিয়ে বাবা বলে ডাক দিলে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিতেন।

বাবা তো বাবাই। বাসা থেকে কোথাও গেলে বাবার সঙ্গে দেখা করে যেতাম আবার বাসায় ফিরে এলে বাবার সঙ্গে দেখা করতাম। বাবা যে কী খুশি হতেন। বলতেন, আমার বাজান এসেছে। কষ্ট লাগে, অসুস্থ বাবাকে রেখে যখন বিদেশে চলে আসি। বাবা ছোট বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, তোকে মনে হয় আর দেখতে পারব নারে বাজান। আমার জন্য দোয়া করিস। বিদেশে গিয়ে কল দিস।

আমি আমেরিকায় আসার পরে বাবা স্ট্রোক করেন। কী যে কান্নাকাটি করি। বাবার মুখ আমার চোখে ভেসে ওঠে। তাকে প্রথমে রাজশাহী ও পরে ঢাকায় নেওয়া হয়। বাবা একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মা হঠাৎ ফোন করে বললেন, তোমার বাবা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

তুমি আবার এসে তোমার বাবাকে দেখে যাও। ভাবছি বাবাকে দেখতে যাব। হঠাৎ সংবাদ এল, বাবা না ফেরার দেশে চলে গেছেন। বাবার সঙ্গে আর শেষ দেখা হয়নি। মনে পড়ে বাবাকে। ভুলতে পারি না তার স্মৃতি। বাবা দিবসে আরও বেশি মনে পড়ছে। সৃষ্টিকর্তা তাকে জান্নাতে রাখেন যেন চিরসুখে। সব বাবার প্রতি আমার সালাম। যারা বেঁচে আছেন তাদের সুস্থতা কামনা করছি আর যারা প্রভুর ডাকে পরপারে চলে গেছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।