
ডা. নেভেল ডি. রোজারিও : ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভবে রাষ্ট্রের বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের প্রত্যাশা ছিল, তা সাতচল্লিশ উত্তরকালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানা টানাপোড়েনে আশাভঙ্গের কারণে পর্যবসিত হয়। পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা ও পাকিস্তানি তত্ত¡ মুসলিম জাতীয়তাবাদের তুমুল বিতর্ক, যা পরে রাজনৈতিক কার্যক্রমের ফসল হয়ে দাঁড়ায়। বঞ্চিত ও শোষিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য ১৯৪৭ সাল থেকে যে সংগ্রাম শুরু করে, তা বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চ‚ড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির সংস্কৃতিকে অনৈসলামিক ও হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানি ভাষা হিসেবে অভিহিত করে পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে ‘পাকিস্তানাইজ’, অর্থাৎ উর্দুসহ ইসলামিক করার চেষ্টা চালায়। ফলে সাতচল্লিশ-উত্তর পূর্ব বাংলায় প্রথম সংঘটিত হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও পরে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের হাত ধরে আসে একাত্তরের স্বাধীনতার সংগ্রাম। মূলত ভাষা আন্দোলনই ছিল মহান স্বাধীনতাসংগ্রামের সূতিকাগার বা আঁতুড়ঘর। বাংলাদেশের অন্য সব আন্দোলনের মতো ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগারও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পঞ্চাশের দশকে ঢাকা মেডিকেলের একাংশে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ষাট দশকের শেষে এসে পরিপূর্ণতা পায় সকল জনগণের মাঝে-আর একাত্তরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একুশে পরিণত হয়েছে উৎসবে এবং ইউনিসেফ কর্তৃক স্বীকৃতি পায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। প্রতিবছর দেশে-বিদেশে যারা আমরা একুশে উদযাপন করি, তারা অনেকে এবং বিশেষ করে, নতুন প্রজন্ম ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিকেই শুধু চেনে কিন্তু ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’র পেছনের ও পরের ধারাবাহিক আন্দোলনকে জানে না। আর এই না জানার সূত্র ধরেই অনেকেই মূলধারার ভাষা আন্দোলনের সাথে থাকেন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাঙ্গণ থেকেই যে আন্দোলন শুরু, তা একদিন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আর এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত বাঙালি গণপরিষদের সদস্য শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বাধীনতাসংগ্রামের উষালগ্নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ, বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মহিলা সাংসদ ড. অরোমা দত্তের দাদু) পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রথমবারের মতো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য একটি বিল আনেন। মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ বাঙালি পার্লামেন্ট সদস্যদের একাংশ এর পক্ষে সমর্থন দিলেও পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম লীগের সাংসদদের বিরোধিতায় তা বাতিল হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দমে না গিয়ে তিনবার বিভিন্ন সংশোধনীসহ বিলটি পুনরায় উত্থাপন করলেও প্রতিবারই তা একই ভাগ্যবরণ করে।
ভাষা আন্দোলনের অব্যাহত ধারাবাহিকতার পরিপ্রেক্ষিতে খাজা নাজিমুদ্দীনের উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে আরবি হরফে প্রচলন করার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুয়ানি বাংলা হরফ (?) থেকে বাংলাকে মুক্ত করে ইসলামি ভাবাদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচলন করা। ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে আরবি হরফে বাংলা লেখার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সাংসদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ তার তীব্র প্রতিবাদ করে।
প্রথম শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়নকারী ও রূপকার ঢাকা মেডিকেলের অষ্টম ব্যাচের ছাত্র বদরুল আলমের সঙ্গী ভাষাসৈনিক সাঈদ হায়দার (পরবর্তীকালে ওহাইও অঙ্গরাজ্যে রেডিওলজি স্পেশালিস্ট হিসেবে কর্ম শেষে ফ্লোরিডায় অবসর জীবন যাপনকারী)-এর কাছ থেকে ক্রনোলজিক্যালি যা জানা যায় :
১. ১৯৪৭ সালের শেষে দেশব্যাপী ভাষার প্রশ্নে বিক্ষোভ চলাকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী পলাশীর ছাত্রাবাসের বাসিন্দারা পুরান ঢাকার উর্দু ভাষাভাষীদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডযুদ্ধ হয়, ভাষার প্রশ্নে সেটিই প্রথম প্রতিরোধ সংগ্রাম।
২. ১৯৪৮ সালের আন্দোলনে ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবসে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। সেদিন অন্য অনেকের সাথে ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র আলী আসগর, এম আই চৌধুরী, জসীমউদ্দিন, এস এ বারী ও ফরিদুল হুদা গ্রেপ্তার হন।
৩. ২১ মার্চ ১৯৪৮ : রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তান সফর উপলক্ষে আয়োজিত এক বিশাল জনসমাবেশে জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্রনেতা ও জনতার একাংশ সাথে সাথে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে।
৪. ২৪ মার্চ ১৯৪৮ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয়কে তুলে ধরে।’ জিন্নাহর এ বক্তব্য সমাবর্তনস্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির সদস্যরা দাঁড়িয়ে ‘নো’ ‘নো’ বলে প্রতিবাদ করেন। জিন্নাহর এই বাংলাবিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।
৫. ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারির সমাবেশে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নাজিমুদ্দীনের এই ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে বার কাউন্সিল লাইব্রেরিতে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে যে বৈঠক হয়, তাতে অন্যদের মধ্যে সালাম, আসগর, মান্নাফ, মোজাম্মেল প্রমুখ মেডিকেল ছাত্র উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় যে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি গোলাম মওলা অন্তর্ভুক্ত হন।
৬. ২১ শে ফেব্রুয়ারি হরতাল ও অন্যান্য কর্মসূচি বানচালের উদ্দেশ্যে সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যে ১৪৪ ধারা জারির আদেশ প্রদান করে, সাথে সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে এক সমাবেশে তার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। সভায় মেডিকেলের ছাত্র আবুল হাশেম, মঞ্জুর হোসেন ও আলীম চৌধুরী জোরালো প্রতিবাদী বক্তব্য রেখে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তব্য রাখার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি গোলাম মওলাকে জোর তাগিদ দেওয়া হয়।
৭. সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ভিন্নমত পোষণ করলেও যুবলীগের নেতা অলি আহাদ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি গোলাম মওলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। সভায় ১১-৩ ভোটে ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এই ৩ জনের বিরোধিতাতেই আসলে সারা দেশের ছাত্রসমাজের মতামত প্রতিফলিত হয়। এ কথা প্রায় নিশ্চিত, সেদিন এই ৩ জনের তীব্র প্রতিবাদ না হলে পরদিন আমতলায় সেই ঐতিহাসিক মিটিং এবং ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করার চ‚ড়ান্ত বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল।
৮. আমতলায় ছাত্র জমায়েতের সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রশ্নে নেতাদের মাঝে বিভক্তি দেখা দেয় এবং এটা নিয়ে চলে দীর্ঘ সময় তর্ক-বিতর্ক। সিদ্ধান্তের ভার সভার ওপর ন্যস্ত করলে সবাই ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে মত দেয়। ১০ জন ১০ জন করে গ্রুপ হয়ে মিছিল করে ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভাঙার পরিকল্পনা করে। ভাগ হয়ে প্রথম দিকে ছাত্রীদের মিছিল মেডিকেলের গেট দিয়ে বেরিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জ এবং গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হতে থাকে। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে দুপুর ১২টা নাগাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে জমায়েত হয় (যেহেতু এটা ছিল পরিষদ ভবনের, বর্তমান জগন্নাথ হলের কাছাকাছি)। ছাত্রদের চেষ্টা ছিল পরিষদ ভবনের সামনে যাওয়া ও ঘেরাও করা। কিন্তু সে পর্যন্ত যাওয়া গেল না, পুলিশের শক্ত ব্যারিকেড, প্রবল লাঠিচার্জ এবং টিয়ার গ্যাসের কারণে।
৯. ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস আর কলেজ সভাস্থল আমতলার লাগোয়া হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ছিল যেমন অধিক, তেমনি ছিল স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ। আমতলার সভা শেষে বের হওয়া মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা প্রথমেই গ্রেপ্তার হন তাদের অনেকের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের আলী আজমল।
ভাষা আন্দোলনের সেই অবিস্মরণীয় দিনের ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী ও ভাষাসৈনিক ঢাকা মেডিকেলের দশম ব্যাচের ছাত্রী এবং পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ডা. আফজালুন নেসা তার স্মৃতিচারণামূলক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘১৯৫২ সালে আমি ছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আমাদের ব্যাচে তখন মাত্র দুজন মেয়ে শিক্ষার্থী পড়ত। একজন আমি, আরেকজন ডা. জাহানারা রাব্বী (শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীর স্ত্রী)। একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আমাদের মেয়েদের হল থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম পুলিশের সাথে ছাত্রদের ইটপাটকেল ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ।’ সেই গুলিবর্ষণের স্মৃতিচারণায় তিনি জানান, ‘বিকেল ৩টার সময় হঠাৎ গুলির শব্দ পেয়ে দৌড়ে বারান্দায় আসি। দেখি মানুষজন ছত্রভঙ্গ হয়ে চারদিকে পালাচ্ছে। এতক্ষণ আন্দোলনকারীদের যেই উত্তাল গর্জনে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হচ্ছিল, হঠাৎ করেই যেন তা শ্মশানের মতো নীরব হয়ে গেল।’
১০. মেডিকেল ব্যারাকের সামনের রাস্তায় এবং ব্যারাক প্রাঙ্গণে গুলিবর্ষণের পর ঊরুতে (ফিমোরাল আর্টারিতে) গুলিবিদ্ধ আহত বরকতকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যান সফিকুর রহমান, তলপেটে গুলিবিদ্ধ জব্বারকে বহন করেন ২০-৯ নং কক্ষের সিরাজুল ইসলাম এবং ১৮-৭ নম্বরের ফজলে রাব্বী, মাথায় গুলিবিদ্ধ রফিককে ভর্তি করান ১৮-১০ এর হুমায়ূন হাই ও ১৮-৯ এর মোশাররফুর রহমান। সালামের গুলি লেগেছিল পায়ের গোড়ালিতে, হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, মারা গেলেন এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে।
১১. ব্যারাক চত্বর ও তার আশপাশে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক, বরকত, জব্বার। বরকতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে জরুরি অস্ত্রোপচারের চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি।
প্রফেসর ডা. আফজালুন নেসার স্মৃতিচারণায় পাই, ‘বিকেল চারটায় দেখলাম, এক সাদা শাড়ি পরা বিধবা বৃদ্ধা আর একজন অল্পবয়সী মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ডিসেকশন হলের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। হল থেকে কয়েকজন মেয়ে মিলে গেলাম ডিসেকশন হলের পেছনে। সেখানে দেখলাম, স্ট্রেচারে তিনটি মৃতদেহ রাখা। তখন লাশগুলোর পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি, পরে শুনেছিলাম, সেখানে শহীদ সালাম আর শহীদ বরকতের লাশ ছিল।’
১২. ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা শহীদদের লাশগুলো বর্তমান ডিসেকশন হলের পেছন দিকে লুকিয়ে রেখেছিল পরদিন জানাজার জন্য। জানাজা শেষে তাদের লাশ নিয়ে মিছিল করার পরিকল্পনা ছিল আলমগীর ও আরো কতিপয় ছাত্রের। একা লাশের পাহারায় থাকলেও কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে পুলিশ লাশ সরিয়ে নিয়ে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করে দেয়। রাতের শেষে আলমগীর ও আমীর হোসেন গোরস্থানে গিয়ে কবর চিহ্নিত করে ও শহীদদের রক্তমাখা কাপড়চোপড় সঙ্গে করে নিয়ে আসে। পরবর্তী দিন গায়েবানা জানাজা আর মিছিলে সেই রক্তমাখা কাপড় এক চরম আবেগঘন মাত্রা যোগ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ঢাকা পরিণত হয় এক মিছিলের নগরীতে।
ভাষাসৈনিক বদরুল আলমের সঙ্গী ভাষাসৈনিক সাঈদ হায়দারের বর্ণনা অনুযায়ী : ‘২৩ ফেব্রæয়ারি সারা দিনের ক্লান্তি শেষে ভাষা আন্দোলনের অনলস কর্মী বদরুল আলম ঘুমিয়ে পড়েছিল। মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়ে পোস্টার লিখনে পারদর্শী ২৪ বছর বয়সী মেডিকেল ছাত্র বদরুল আলমকে ঘুম থেকে তুলে ভাষাশহীদদের স্মৃতির স্মরণে “স্মৃতিস্তম্ভ” নকশার ডিজাইন করতে বলা হয়। তার প্রথম ডিজাইনটি কিছুটা জটিল হওয়ায় সহজ করে করা দ্বিতীয়টি গ্রহণ করা হলো।’
প্রথম শহীদ মিনারের নকশা প্রণেতা ও তার সহধর্মিণী : ভাষাসৈনিক প্রফেসর ডা. আফজালুন নেসার স্মৃতিচারণায়, ‘২২ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরো দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ২৩ তারিখে মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিল, শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। স্তম্ভটির নকশার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমার স্বামী ডা. বদরুল আলমের ওপর, তিনি তখন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটি নকশা তৈরি করে দিলেন। ২৩ তারিখ রাতেই ডিএমসির প্রায় ৩০০ ছাত্রছাত্রী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজে লেগে গেল। কারফিউয়ের মাঝেও সবকিছু তুচ্ছ করে আমরা নেমে পড়েছিলাম। নির্মাণাধীন কলেজ বিল্ডিংয়ের গুদাম থেকে ইট, বালু, সিমেন্ট জোগাড় করা হলো। নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের ঠিকাদার পেয়ারু সরদার ছাত্রদের কাজের সুবিধার্থে খুলে দিয়েছিল গুদামের তালা। স্ট্রেচারে করে ইট, বালু, সিমেন্ট নিয়ে এসেছিলাম, বালতি ভরে পানি এনেছিলাম। সারা রাত কাজ করে ভোর পাঁচটার দিকে তৈরি হলো দেশের প্রথম শহীদ মিনার।
‘এখন যেখানে আউটডোর বিল্ডিংয়ের সামনের ডিসপেনসারি স্টোর, সেখানেই তৈরি হয়েছিল প্রথম “স্মৃতিস্তম্ভ” বা শহীদ মিনার, আমাদের হল থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে। স্মৃতিস্তম্ভটির চারদিকে লাল সালু দিয়ে ঘেরা আর দুটি পোস্টার লাগানো ছিল তাতে। একাটতে লেখা “স্মৃতিস্তম্ভ”, আরেকটিতে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। পরদিন সকাল থেকেই সেখানে মানুষের ঢল নামে। স্তম্ভটি উদ্বোধন করেন শহীদ সফিউর রহমানের পিতা। সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল। অনেক মহিলা আন্দোলনের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য গলা ও হাতের সোনার গয়না দান করেন। আমার এখনো মনে আছে, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মা এসেছিলেন। তিনি তার গলা থেকে সোনার চেইন খুলে ছাত্রদের হাতে তুলে দিলেন।’
ভাষাসংগ্রামী, প্রাবন্ধিক, গবেষক এবং সে সময়কার ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র আহম্মেদ রফিকের বর্ণনায়, ‘রাতভর ২ জন রাজমিস্ত্রি, বিপুলসংখ্যক মেডিকেল ছাত্রছাত্রীর সহযোগিতায় সকালের মধ্যেই নির্মাণ করে ফেলল “১০ ফুট লম্বা ও ৬ ফুট চওড়া শহীদ মিনার স্মৃতিস্তম্ভ”।’
ভাষাসৈনিক প্রফেসর ডা. আফজালুন নেসার বর্ণনায়, ‘২৬ তারিখ সকালে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ট্রাক এসে আমাদের ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলল। তারা এসেছিল শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলতে। দড়ি দিয়ে স্তম্ভটি বেঁধে ১০-১২ জন মিলে টেনে উপড়ে ফেলল। তারপর ট্রাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। সেই ফাঁকা জায়গাটিতে আমরা বাঁশের কঞ্চি গেঁথে কালো কাপড়ের নিশান লাগিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলাম। শহীদ মিনার তৈরির সেই অবিস্মরণীয় রাতের কথা এখন অনেক বছরের অতীত। অথচ সেই রাতের প্রতিটি মুহূর্ত এখনো মানসপটে জ্বলজ্বল করে। কী প্রবল দেশপ্রেমেই না আমরা তখন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। মাত্র এক রাতে আমরা এমন এক স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করি, যা ভবিষ্যতে আমাদের সকল আন্দোলনের পীঠস্থান হয়ে থাকবে। ঢাকা মেডিকেলের প্রাঙ্গণ থেকেই যে আন্দোলন শুরু তা একদিন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলাফল হলো আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতা।’
ভাষাসংগ্রামী আহম্মেদ রফিকের মতে, ‘ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী হয়েছিল, যার প্রভাব সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করে। আধুনিকতায়, প্রগতিশীলতায়, রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটায় ভাষা আন্দোলন।’ মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখলেন একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখলেন ‘স্মৃতি-স্তম্ভ’।
‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা
এখনো চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো! যে ভিত কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙতে…
…ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক! ভয় কী বন্ধু, দেখো একবার আমরা জাগরিত চার কোটি পরিবার।’
আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখে ফেললেন সেই অমর কবিতাখানি, যা পরে হয়ে গেল একুশের প্রভাতফেরির গান। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’ গানটার ব্যাপারে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ‘গানটা ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রæয়ারির গুলিবর্ষণের ঘটনার পর লেখা। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে ছুটে গিয়ে দেখলাম, একটা লাশ পড়ে আছে। লাশটার মাথার খুলি উড়ে গেছে। ভাবলাম হয়তো বরকতের লাশ। মনে হলো, আমার ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে। অনেক পরে জেনেছি, ওটা ছিল ভাষাশহীদ রফিকের লাশ।’
‘প্রথমে আব্দুল লতিফ সুর করলেন। পরে করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন করে সুর দিলেন। সেই থেকে ওটা হয়ে গেল একুশের প্রভাতফেরির গান। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৬৮ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় এ গানটি ব্যবহার করার পর এর জনপ্রিয়তা বাড়ে।
আর ২১ শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এ গানটিও আন্তর্জাতিকতা পেতে শুরু করে। সুইডিশ, জার্মানি, আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছে গানটির সুর অক্ষুগ্ন রেখে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের তৈরি প্রথম শহীদ মিনার বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অনেক বছর পর্যন্ত ২৩ ফেব্রুয়ারি নির্মিত ‘স্মৃতিস্তম্ভ’টির কোনো ছবি কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। ডা. বদরুল-আফজালুন নেসা দম্পতির ছেলে Dr Ashfaque SwapanÑDMC Graduate and editor of India-West weekly newspaper, based in California, USA-এর বদরুল আলমের সঙ্গী ভাষাসৈনিক সাঈদ হায়দারের সাথে নেওয়া প্রকাশিত সাক্ষাৎকার থেকে শৌখিন ফটোগ্রাফার ডা. সাঈদ হায়দারের জবানিতে জানা যায়, ‘স্মৃতিস্তম্ভ’-এর ছবি সে সময় বা পরে না পাওয়াটা কোনো দৈব ঘটনা বা দুর্ঘটনার ফসল ছিল না। পুলিশ এবং সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সর্বত্র স্মৃতিস্তম্ভের ছবি বা ছবির নেগেটিভ উদ্ধারে হন্যে হয়ে ঘুরছিল। ডা. হাফিজ আরো আমাকে জানান, ‘আমি কোনো অসুবিধায় পড়তে পারি আশঙ্কায় আমার উদ্বিগ্ন আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে আমি ছবির নেগেটিভ এবং সকল কপি নষ্ট করে ফেলি। অনেক বছর পর আমার কাছে রক্ষিত একটি মেডিকেল বইয়ের পাতা ওল্টাতে গিয়ে পেয়ে যাই প্রথম শহীদ মিনারের দুর্লভ একখানা ছবি।’ পরে ডা. হাফিজ দুটি শর্তে ১৯৫৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে তার তোলা ও সামান্য নষ্ট হয়ে যাওয়া ছবিটি সামান্য টাচ করে ডিজিটাল কপি করে প্রফেসর আফজালুন নেসার নিকট ই-মেইলের মাধ্যমে হস্তান্তর করেন। শর্তসমূহ ছিল :
ফটোর ক্রেডিট ডা. হাফিজকে দিতে হবে।
এবং ২. ছবিটির বাণিজ্যিক ব্যবহার করা যাবে না।
(ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় কমিটির প্রাক্তন মহাসচিব, নিউজার্সি।)
তথ্য সহায়িকা, অনুস্মরণিকা এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকারে :
১. অতন্দ্র একাত্তর : প্রবন্ধ সংকলন ।
২. ভাষাসৈনিক ঢাকা মেডিকেলের দশম ব্যাচের ছাত্রী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ডা. আফজালুন নেসার স্মৃতিচারণামূলক সাক্ষাৎকার
৩. Dr Ashfaque Swapan DMC Graduate and editor of India-West weekly newspaper, based in California, USA.
৪. ডা. মোশতাক আহমদ, সংযুক্ত সম্পাদক, অতন্দ্র একাত্তর
৫. ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’ গানটার ব্যাপারে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
৬. ফিরে দেখা ইতিহাস : ভাষা আন্দোলনের দিনপঞ্জি : বাঁধভাঙার আওয়াজে; নির্বাচিত পোস্ট : যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজে ক্যানসারের বিশেষ ওষুধ উদ্ভাবনে চেষ্টারত : মিরাজ
৭। আহম্মেদ রফিক, ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক-গবেষক DMC Graduate-এর সাক্ষাৎকার