মহামারিকালে দুই লক্ষাধিক মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেয়ার নেটওয়ার্ক তৈরি করি

সাক্ষাৎকারে কুইন্স টুগেদারের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর জনাথন ফরগাস

মুশরাত শাহীন : মহামারি করোনার তাণ্ডবে গোটা নিউইয়র্ক যখন লন্ডভন্ড, চারদিকে যখন রোগীদের ভয়াল আর্তচিৎকার, লাশের মিছিলে প্রতিনিয়ত যখন যোগ হচ্ছে একের পর এক নাম, আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তির একান্ত আপনজনেরাও যখন দূরে সরে গেছেন, খাদ্য ও নিরাপত্তার অভাবে যখন অনেক মানুষ দিশেহারা; ঠিক সেই মুহূর্তে সকল ভয়-ভীতিকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে বিপৎসংকুল মানুষের পাশে দাঁড়ান কিছু মহান ব্যক্তিত্ব। তারা মানবসেবায় নিজেদের নিয়োজিত করে মানবতার মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাদেরই একজন কুইন্স টুগেদার নামের একটি নন-প্রফিট সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর জনাথন ফরগাস। যিনি মানুষের সেই কঠিন ও ভয়াল মুহূর্তে হাসপাতাল ও বিভিন্ন বাড়িতে খাবার ও খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়ে এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। এস্টোরিয়া ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক জাবেদ উদ্দিনের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশি কমিউনিটির পাশেও দাঁড়ান। কঠিন বিপদে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করায় জনাথন আজ বাংলাদেশিদের কাছে অতি আপনজন ও বন্ধু। ঠিকানার সঙ্গে একান্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান সেই সময়কার নানা অজানা কথা।

পাঠকদের জন্য তার সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো :
মহামারি সংকটের সময়ে তিনি ও তার সংগঠন কুইন্স টুগেদার কীভাবে বিপদাপন্ন মানুষকে সহায়তা করেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে জনাথন ফরগাস বলেন, ২০২০ সালের মার্চ মাসে আমরা একটি ওয়েবসাইট তৈরি করি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অর্থ সংগ্রহ শুরু করি। ধারণাটি ছিল রেস্টুরেন্টগুলোকে ন্যায্য মূল্য প্রদান করে হাসপাতালের কর্মী এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন পরিবারগুলোর জন্য খাবার প্রস্তুত করা। এতে আমরা ব্যাপক সাড়া পাই। রেস্তোরাঁগুলো প্রতিবেশীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। আমরা ৩৫ হাজারেরও বেশি খাবার ও শুকনো পণ্যের প্যাকেজ প্রস্তুত এবং সরবরাহ করতে সহায়তা করি। মহামারি চলাকালে অভাবী লোকদের খাবার সরবরাহ করে তাদের নিরাপদ ও সুস্থ রাখতে সহায়তা করি। করোনাকালীন আমরা ছয়টি ভাষায় ফ্লায়ার বিতরণ করি।


বাংলাদেশিদের সহায়তার বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশি কমিউনিটি আমার খুব প্রিয়। করোনাকালে যেসব স্থানে বাংলাদেশিরা বিপদে আছেন বলে তিনি জেনেছেন, সেসব বাংলাদেশিকে খাদ্য সহায়তাসহ নানাভাবে সহযোগিতার চেষ্টা করেছেন।


জনাথন ফরগাস আরো বলেন, কুইন্স টুগেদার একটি অলাভজনক সংগঠন। তারা একটি তৃণমূল রেস্তোরাঁ অ্যাসোসিয়েশন এবং সম্প্রদায় পরিষেবা সংস্থা, যা বরোজুড়ে অসহায় ব্যক্তি এবং পরিবারকে খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা করে। কোভিড-১৯ শুরুর পর থেকে কুইন্স টুগেদার নিউইয়র্কের কুইন্সে খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি দুই লাখের বেশি লোককে খাদ্য সহায়তা করার জন্য রেস্তোরাঁ, খাদ্য প্যান্ট্রি এবং কমিউনিটি গ্রুপের মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। তাদের কিছু বিখ্যাত ক্লায়েন্টের মধ্যে রয়েছে ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট, অল মাই চিলড্রেন, হোয়াইট কলার, আলফা হাউস, দ্য আমেরিকানস এবং ফুড নেটওয়ার্কের শো, যেমন এমেরিল লাগসে, ববি ফ্লে, রাচেল রে ও উলফগ্যাং পার্ক।
তিনি আরো বলেন, বিগত থ্যাঙ্কস গিভিংয়ে তারা সকল মানুষকে সেবা দিতে এগিয়ে আসেন। তারা ১ হাজার পরিবারকে সুস্বাদু থ্যাঙ্কসগিভিং দেওয়ার উদ্যোগ নেন। থ্যাঙ্কসগিভিং টার্কির জন্য কুইন্স টুগেদারের দাতা, কমিউনিটি গ্রুপ এবং স্পনসররা অর্থ প্রদান করেন। এগুলোর অন্যতম কাউফম্যান এস্টোরিয়া স্টুডিও, ইনোভেশন কিউএনএস, সিসকো ফুডস এবং টিএফ কর্নারস্টোন। কুইন্স টুগেদার নিউইয়র্কের এস্টোরিয়া, এলআইসি, উডসাইড, জ্যাকসন হাইটস, সানিসাইড, ইস্ট এলমহার্স্ট, জ্যামাইকা, রোজডেল, ফার রকওয়ে, মেরিন টেরেস পার্কে এক হাজার পরিবারের মধ্যে টার্কি বিতরণ করে। এ ছাড়া তারা ফ্যাশন শ্যুট, মিউজিক ভিডিও এবং নিউইয়র্ক সিটি ও স্থানীয় স্টুডিও কফম্যান এস্টোরিয়া স্টুডিও, সিলভারকাপ এবং ব্রডওয়ে স্টেজে ফিচার ফিল্ম ও টেলিভিশনের জন্যও ক্যাটারিং শুরু করেন। তারা ক্যানসারের চিকিৎসাধীন লোকেদের জন্যও রান্না করা শুরু করেছিলেন এবং হাসপাতাল ও বিভিন্ন সংস্থায় এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন।


কুইন্স টুগেদারের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী, এ সম্পর্কে জানতে চাইলে জনাথন বলেন, এটি রেস্তোরাঁ ও খাদ্য ব্যবসার বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে অ্যাডভোকেসি, প্রচার এবং সঞ্চয়ের জন্য একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। সংস্থাটি খাদ্য-ত্রাণ বিশেষ প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সম্প্রদায়ভিত্তিক পরিষেবা দেয়। কুইন্স টুগেদারের এ পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি আসনবিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং কুইন্সজুড়ে কমিউনিটি গ্রুপের একটি বড় নেটওয়ার্ক আছে। সদস্যপদ এবং সম্প্রদায়ের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। রেস্তোরাঁগুলো ব্যবসায় একে অপরকে সমর্থন করা এবং সংকটে থাকা সম্প্রদায়গুলোর খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করবে। ভবিষ্যতে বরোজুড়ে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় সংস্থাটি আরো বড় পরিসরে কাজ করবে।
জনাথন ফরগাস ১৯৬৭ সালে ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠেন লং আইল্যান্ড সিটি ও ম্যানহাটনের কেন্দ্রস্থলে। ২৫ বছর বয়সে তিনি এস্টোরিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। স্ত্রী জেনিফার ও ছেলেকে নিয়ে বর্তমানে এস্টোরিয়াতেই থাকেন তিনি।