খায়রুল আনাম
‘মাদার্স ডে’ বা ‘মা দিবস’ মা-কে বিশেষ আপ্যায়ন করে সম্মান দেখানোর জন্য পালন করা হয়। অনেক আগে এটি একটি নিছক ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল। আধুনিককালে, আমেরিকায় প্রথম ধর্মনিরপেক্ষভাবে দিনটি পালন করা শুরু হয়। ছোট্ট একটা শহরে এর সূত্রপাত হলেও সেখান থেকে আইডিয়াটা ‘পপুলার’ হয়ে সারা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ‘মাদার্স ডে’ পালিত হচ্ছে। আমেরিকা থেকে আইডিয়াটা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও এর উৎস প্রাচীন মিসর এবং এর সূত্রপাত হয় ধর্মীয়ভাবে।
প্রাচীনকালে মিসরের দেবী “আইসিসকে মিসরের রাজা ‘ফেরাও’ বা ‘ফেরাউনদের মা হিসেবে গণ্য করা হতো। আর সেই উপলক্ষে বছরে একদিন উৎসব পালন করা হতো। তার সুন্দর ও সুঠাম মাথার উপর একটা মুকুট পরানো থাকত, যার দু’দিকে দুটি ষাঁড়ের শিং ও মাঝখানে একটা জ্বলন্ত সূর্যের আকৃতি থাকত। তিনি যেন সিংহাসনে বসে আছেন, এভাবেই দেখান হতো। গল্পটা হলো, আইসিসের দুটো ভাই ছিল, একজন হোসাইরিস ও অন্যজন সেথ। সেথের খুব ইচ্ছা ছিল, সে আইসিসকে বিয়ে করবে। কিন্তু আইসিস তার বদলে হোসাইরিসকে বেশি পছন্দ করে তাকে বিয়ে করে বসে। এতে ক্ষেপে গিয়ে সেথ, হোসাইরিসকে কেটে ১৩ টুকরো বানিয়ে গায়ের ঝাল মেটায়। আইসিস তখন সেই তেরটি টুকরোই তার শরীরের মধ্যে আবার ঢুকিয়ে নেয়। সেখান থেকে তার ‘হোরাস’ নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সেথের কোপানল থেকে বাঁচানোর জন্য আইসিস হোরাসকে সব সময় লুকিয়ে রাখত। এক সময় সেথ মারা যান; অন্যদিকে হোরাস বড় হয়ে সংযুক্ত মিসরের রাজা বা ‘ফেরাও’ হন। সেই থেকে আইসিস মিসরের ফেরাওদের মাতা হিসেবে পরিগণিত। ক্রমশ: দেবী আইসিস রোমানদের দেবী হিসেবেও প্রচলিত হয়ে পড়েন।
আবার অনেকের মতে, “মাদার্স ডের প্রচলন প্রথম শুরু করে গ্রিকরা। বসন্তকালে গ্রিকদের সকল দেবীর মাতা, দেবীমা রিয়াকে উপলক্ষ করে উৎসব হতো। এটা যখন রোম ও এশিয়া মাইনরে ছড়িয়ে পড়ে, তখন গ্রিক দেবী রিয়ার বদলে রোমানদের আসল দেবী হিসেবে জায়গা করে নেন, গ্রেট মেটার বা মহা মাতা, দেবী ‘সিবিল’। রোম ও সারা এশিয়া মাইনরে সিবিলের পূজা হতো ঠিক ‘রিয়া’ কে যেমন গ্রিকরা সকল দেব-দেবীর মাতা হিসেবে মান্য করতো সেভাবেই। এই উৎসবটি সাধারণরত ১৫ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতো। প্রথম দিকে লোকে উৎসবটা খুব উছৃঙ্খলভাবে পালন করতো বলে পরে তা নিষিদ্ধ করা হয়। মৌলবাদীরা কেবল মধু দিয়ে রুটি খাওয়া ও পরস্পরকে ফুল বিতরণের মধ্য দিয়ে উৎসবটি অনাড়ম্বরভাবে সম্পন্ন করার রেওয়াজ চালু করে। তারপর সেই মূর্তি কাঁধে নিয়ে সবাই শোভাযাত্রা করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত। এই উৎসবের নাম ছিল ‘হিলারিয়া’। এই উৎসব উপলক্ষে নানা ধরনের চারু শিল্পকলা প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা থাকত।
এশিয়া মাইনর ও রোমের এই অনুষ্ঠানটি ক্রমশ সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দিনটি উদযাপনের ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন আসে। পরিবর্তনটি ছিল নতুন এই ইউরোপীয় ব্যবস্থায় ‘মাদারহুড’ বা মাতৃত্বের সম্মান দেখানোর ধর্মীয় ব্যবস্থাপনার ওপর। ইউরাপে সাধারণত ‘লেন্ট’, অর্থাৎ ইস্টার সানডের আগের ৪০ দিনের উপবাসের চতুর্থ রবিবারে এই দিনটি ধার্য করা হতো। প্রথম দিকে খ্রিস্টানরা যেখানে ব্যাপ্টাইজ্ড হয়েছে, সেই গির্জাকে তারা ‘মাদার চার্চ’ বা ‘মা গির্জা’ বলতো এবং এই দিনটির উৎসব সেই ‘মা গির্জা’র সম্মানেই পালিত হতো। এ উপলক্ষে মাদার চার্চকে নানা অলঙ্কার ও ফুল দিয়ে সাজানো হতো।
১৬০০ খ্রিস্টাব্দে, ইংল্যান্ডের পাদ্রীরা একটা ফতোয়া জারি করলেন যে, ‘মাদার চার্চ’ এর সীমানা আরো বাড়িয়ে ‘রিয়েল মাদার’ বা সত্যিকারের ‘মা’দেরকেও এর মধ্যে আনতে হবে এবং দিনটা এখন থেকে ‘মাদারিং ডে’ হিসেবে পালিত হবে। ‘মাদারিং ডে’ কে চাকর বাকর, শ্রমিক বা কাজ করে খাওয়া অন্যান্য মানুষদের জন্য একটা বিশেষ সহানুভূতিশীল দিন হিসেবে মান্য করা শুরু হয়। ঐ ‘লেন্টেন সানডে’ বা উপবাসের রবিবারের দিনটাতে তারা ছুটি পেয়ে নিজ নিজ দেশের বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আসতে পারত। ধর্মযাজকরা ঠিক করলেন যে এই দিনটাতে ‘লেন্ট’ বা উপবাস থেকে সবাইকে অব্যাহতি দেওয়া দরকার। এর ফলে তারা পুরো পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হতে পারার আনন্দভোগ হিসেবে ‘ফিস্ট’ বা আনন্দভোজন করতে পারবে এবং এই আয়োজন উৎসবের প্রধান অতিথি থাকবেন, ‘মা’।
পুনঃ বিষয়টির সঙ্গে মুসলমানদের ‘ঈদ’ উৎসব পালনের অনেকটা মিল রয়েছে। গৃহভৃত্যদের ঐদিন মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা ও একমাস ধরে কঠোর রমজান ব্রত পালান করার পর ‘ফিস্ট’ করে আনন্দ করার জন্য ঈদুল ফিতরের দিনটিতে রোজা রাখা হারাম করা হয়েছে। আধুনিককালে আমাদের দেশে দুই ঈদের ছুটিতে শহরে মানুষের বাড়িতে, অফিস আদালতে, কল কারখানায় কাজ করতে আসা মানুষ মনের আনন্দে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দিনটি উদযাপন করে থাকে।
শিকাগো।