মানবসেবার পরিসর বাড়াতে ফাউন্ডেশন করার উদ্যোগ নিচ্ছি

সাক্ষাৎকারে আবু জাফর মাহমুদ

আবু জাফর মাহমুদ

নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী : বাংলা সিডিপ্যাপ সার্ভিসেস ইনক্্ ও অ্যালেগ্রা হোম কেয়ার ইনক্ এর সিইও ও প্রেসিডেন্ট আবু জাফর মাহমুদ। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা। সমাজসেবা আর মানবকল্যাণে কাজ করা তার নেশা। তাই নিজের উপার্জনের একটা অংশ সমাজসেবামূলক কাজে ব্যয় করেন। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট এই ব্যবসায়ী দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বাস করছেন নিউইয়র্কে। দেশের মানুষের যেকোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারে থেকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। নিজ জেলার মানুষের পাশাপাশি দেশের যেকোনো অঞ্চলের বিপদগ্রস্ত মানুষকে অর্থ ও খাদ্য সহায়তা করেন। মানুষের সেবা করে মনে তৃপ্তি ও আনন্দ পান। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান মাহমুদের আশা ভবিষ্যতে একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করে এর মাধ্যমে মানুষকে আরো বড় পরিসরে সেবা দিতে। গত ৬ জুন দুপুরে ঠিকানার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান এই সমাজসেবক। তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশটুকু পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
আবু জাফর মাহমুদ জানান, ছোটবেলা থেকেই সমাজসেবা করা তার অভ্যাস। বিশেষ করে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়াতেন তিনি। স্কুলে পড়া অবস্থাতেই এলাকায় বন্যা হলে বন্যার্ত মানুষকে তিনি নানাভাবে সহায়তা করতেন। ছোটবেলার এই অভ্যাস এখনো অব্যাহত আছে। তাই আমেরিকায় বসবাস করেও তিনি দেশের অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করেন। বর্তমানে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন। সিলেটের জনৈক কবির মিঞার মাধ্যমে তিনি সেখানকার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০ পরিবারে এক সপ্তাহের খাবারের অর্থ পাঠিয়েছেন। সুনামগঞ্জেও এ রকম ৩০০ পরিবারকে সহায়তা দিয়েছেন। বন্যাদুর্গতদের ছাড়াও রমজান মাসে তিনি গরিব রোজাদারদের ইফতার ও সাহ্রির ব্যবস্থা করেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়াও নিজের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও তিনি মানুষকে সহায়তা করছেন। শুধু দেশে নয়, নিউইয়র্কেও বিভিন্ন মানুষকে তিনি সহযোগিতা করছেন।
ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে মানবসেবা করার লক্ষ্য আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি ফাউন্ডেশন করার ইচ্ছা আছে। এটি করার পর দেশের মানুষের জন্য আরো বড় পরিসরে কাজ করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবে ফাউন্ডেশনটি। নিউইয়র্কেও বিপদে পড়া মানুষকে সহায়তা করব। আমার জ্যাকসন হাইটসের দোতলার অফিসটি এ জন্য ব্যবহার করব।
সমাজসেবামূলক কাজের জন্য কোনো বাজেট আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে কোনো বাজেট নেই। আমার আয়ের একটা অংশ মানুষকে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
আবু জাফর মাহমুদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তিনি মাউন্টেন ব্যাটালিয়নের কলাম-২ এর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে একই সময়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগে মৌলভীবাজারের রাজনগরের ক্যাম্পে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে অবস্থান করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, যুদ্ধের প্রশিক্ষণের আগে ওই ক্যাম্পে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে এক বালিশে তিন মাস ঘুমিয়েছি। এখানে তিনি আসার পর আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তখন আমাকে দেখে কিরণ বলে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।
কিরণ নামের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুদ্ধের সময়ে আমাকে কিরণ চন্দ্রবর্তী নাম ধারণ করতে হয়েছিল। তাই এই নামেই তিনি আমাকে ডাকেন। তিনি বলেন, গত বছর কিরণ চন্দ্র দাস (মঙ্গল চন্দ্র) নামে সন্দ্বীপ এলাকার এক ব্যক্তি তার ছোট ভাই, ছেলে ও শ্যালককে নিয়ে গভীর সমুদ্রে ঝড়ে পড়া নাবিকদের উদ্ধার করেছিলেন। তার এই অসীম সাহসিকতার জন্য তার সাথে কথা বলেছি, তাকে সহায়তা করতে চেয়েছি। কিন্তু তিনি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেননি। পাশের একজন বলেছেন, তার মাছ ধরার ট্রলারের ইঞ্জিন ও জাল দরকার। সে জন্য তাকে এক লাখ টাকা দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে কিরণ চক্রবর্তী নাম ধারণ করতে হয়। ছদ্মনাম হলেও কিরণ চন্দ্র দাস (মঙ্গল চন্দ্র) নামের কারণে তার প্রতি আমার মায়া লাগে। এ ধরনের সাহসী মানুষকে সহায়তা করতে চাই।
এ পর্যন্ত কত মানুষকে সহযোগিতা করেছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করা ছাড়াও বাংলা সিডিপ্যাপ এবং অ্যালেগ্রা হোম কেয়ারের মাধ্যমে মানুষের জন্য সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছি। কত মানুষের সেবা করেছি, তার হিসাব নেই। তবে হাজার হাজার মানুষকে সহায়তা করেছি এবং এখনো করছি।
আবু জাফর মাহমুদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর টরো কলেজ থেকে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স বিষয়ে মাস্টার্স করেন। তিনি বলেন, আমি মানুষের সেবা করতে এতটাই পছন্দ করতাম, যে কারণে আমাকে চারবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল। মাস্টার্স করার জন্য একবার ইংরেজিতে, এবার ইকোনমিক্সে, একবার বাংলায় ভর্তি হই। পরে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করি। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতাম আর মানুষের সেবায় ছুটে যেতোম। দেশের কাজের জন্যও ছুটে যেতাম। এ কারণে প্রথম তিনবার মাস্টার্স পড়া হয়নি।
আবু জাফর মাহমুদ ৩০ বছর ধরে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। জ্যাকসন হাইটসে একাই থাকেন। তার স্ত্রী বাংলাদেশে থাকেন এবং এখানে মাঝে মাঝে আসেন। তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। লেখাপড়া শেষ করার পর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বড় ছেলে ফয়সাল মাহমুদ এখানে এমবিএ করার পর এখন যুক্তরাজ্যে আছেন। সেখানে তিনি ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন। মেজো ছেলে পেশায় চিকিৎসক। বিসিএস ক্যাডার। আর ছোট ছেলেও বিসিএস ক্যাডার। তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হিসেবে রেলওয়েতে জয়েন করেছেন। তারা দেশেই থাকেন।