মানুষ কি বিবেক হারিয়ে ফেলছে?

মীর আব্দুল আলীম

মানুষের বিবেক বোধ কি হারিয়ে যাচ্ছে? মানুষগুলো কেমন যেন দয়া-মায়াহীন হয়ে পড়েছে। খুনের পর লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলা, নিজ সন্তানকে পুড়িয়ে মারা, নিজ সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন হওয়া, শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। প্রেম ও পরকীয়ার মোহে নিজ শিশুকে পুড়িয়ে মারতেও দ্বিধা করছে না গর্ভধারিণী মা। এ দিকে দাম্পত্য কলহের জেরে স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে। তুচ্ছ ঘটনার জেরেই একের পর এক ঘটছে প্রাণসংহারের মতো ঘটনা। পরিবারের আপন মানুষটির কাছেই আরেকজন সদস্য ক্রমশ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে। প্রাণ হারাচ্ছে।
৯ বছরের শিশু নুদরাত। পৃথিবী কী বোঝার আগে সব ছেড়ে চলে যেতে হলো তাকে। এর আগে তার ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। গত ১০ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। চট্টগ্রামের সার্সন রোড এলাকায় নুদরাতকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মোবাইল চুরির অভিযোগে নরসিংদীর শিবপুরে আজিজা আক্তার (১৪) নামে এক কিশোরীকে গাছের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে গায়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে আড়াইহাজারে মায়ের অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলায় দুই সন্তানকে মা ও তার প্রেমিক মিলে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া বড় ছেলে হৃদয়। তবে ভাগ্যক্রমে ওই রাতে বেঁচে যায় ছোট ছেলে জিহাদ। ১৩ এপ্রিল উপজেলার বারৈপাড়া এলাকায় ঘটনাটি ঘটে।
পত্রিকার এক রিপোর্টে দেখলাম, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৮৭ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ সময়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৯ জনকে।
প্রতিকারহীনতার কারণে দিন দিন ধর্ষণকারীরা আরো বেপরোয়া হচ্ছে। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়ে উল্টো ভিকটিম ও তার পরিবারই পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও অধিকাংশ অপরাধী রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। রাজধানীর কাছে ধামরাইয়ে মিথ্যে অপবাদে নাসিমাকে পুড়িয়ে মারে ক’জন সমাজপতি। কী নিষ্ঠুরই না ঘটনার বিবরণ। যৌতুকলোভী স্বামী বহু আগে ছেড়ে চলে গেছে। তবুও বাঁচতে চেয়েছিল নাসিমা। কিন্তু তাকে বাঁচতে দিলো না কিছু সমাজপতি। তাদের কুপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নাসিমাকে চরিত্রহীনা অপবাদ দিয়ে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন নাসিমার রক্তমাংসের শরীরে প্রাণটা কোনোমতে আটকে ছিল দেহে। পুলিশ খবর পেয়ে নাসিমার দগ্ধ বীভৎস দেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। মৃত্যুর আগে নাসিমা পুলিশকে জানিয়েছেন, ‘আমি চরিত্রহীনা নই। ওরা আমাকে চরিত্রহীনার অপবাদ দিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমার শত আকুতি-মিনতিতে ওদের পাষাণ হৃদয় গলেনি। আমি ওদের বিচার চাই।’
এ কোন সময়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি আমরা? এসব সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির জন্য মাদক, অসুস্থ রাজনীতি, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, সুস্থ বিনোদনের অভাব, বেকারত্ব, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয়, দাম্পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতা, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব এবং সামাজিক উন্নয়নে রাষ্ট্রের উদাসীনতাই দায়ী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ অবস্থা থেকে যেকোনো মূল্যে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সবাইকে সম্মিলিতভাবে সে পথটা খুঁজে বের করতে হবে।
লেখক : গবেষক