মাফিয়া-দানবে আক্রান্ত বাংলাদেশ

বিশেষ প্রতিনিধি : সরকারের বিদায় বা পতন নয়, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই লাখ লাখ কোটি টাকা লুট, পাচার, দুর্নীতির রহস্য ফাঁস শুরু হয়েছে। যার কিছুটা নেপথ্য আয়োজনে। বেশির ভাগই ঘটনাচক্রে। বঞ্চিতদের ক্ষোভ, কাগজপত্রে গোলমাল, লুটের ইফেক্ট ইত্যাদি কারণে ব্যাংকিং জগতের জগৎশেঠদের লুটপাটের খবর এখন আর সোশ্যাল মিডিয়ার খবর নয়। অনিবার্যভাবে তা মূলধারার গণমাধ্যমেও চলে আসছে। সঙ্গে সরকারি ঘরানার নেপথ্য কুশীলবদের হাঁড়ির খবরও। করোনা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বমন্দার জেরের অজুহাত আর কুলাচ্ছে না। কেবল ইসলামী ব্যাংকসহ কিছু ব্যাংক ফোকলা করা নয়; হলমার্কের সাড়ে তিন হাজার কোটি, বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১ হাজার ২০০ কোটি, অ্যাননটেক্সের ৫ হাজার ৫০০ কোটি, ক্রিসেন্টের ৫ হাজার ১৩০ কোটি, পি কে হালদার ১১ হাজার কোটি টাকা গায়েবের আয়োজক ও ভাগ হাতানোদের হালনাগাদ তথ্যও বাজারে আসার অপেক্ষা। এর বাইরে তাদের পার পাইয়ে দেওয়া শক্ত হাতগুলোর কাণ্ডকীর্তিও বাদ নেই।
‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে’ গুজব সরকার ঠেকিয়েছে ‘বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাচ্ছে’ আওয়াজে। এখন ভেতরের অবস্থার তথ্য-সাবুদ বিশেষ বিশেষ জায়গায়। কাগজের টাকা ছাপিয়েও এখন টিকে থাকার পথঘাট অন্ধকার। অবস্থা বুঝে সরকারের খাস অর্থনীতিবিদেরা সরে সরে থাকছেন। তাদের দিয়ে কথা বলানো বা দু-চারটা কলাম লেখানোর কাজও করানো যাচ্ছে না। নিজ থেকেই সাইডলাইনে চলে গেছেন তারা। তার ওপর ব্যাংকিং সেক্টরে বিশাল অঙ্কের লুটপাট, পাচারের মতো বিষয় চলে গেছে আদালতে। ইসলামী ব্যাংক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, তাদের ব্যাংক কোনো বেনামী ঋণ দেয়নি এবং সব ঋণ দেওয়া হয়েছে নিয়ম মেনে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কথা আরো সোজাসিধা। ব্যাংক, বিমা, শেয়ারবাজার, রিজার্ভসহ অর্থনীতি বিষয়ে ‘ডুব দিয়ে চুপ মেরে থাকা’র কৌশল তার। ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে লোপাট নিয়ে প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ লিখিত দিয়ে যান, খতিয়ে দেখা হবে।
এস আলম গ্রুপের এই ‘অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন’ একেবারে গোপনে হয়নি। জানতেন ব্যাংকসহ সরকারের অনেকে। কিন্তু টুঁ শব্দও করেননি কেউ। গ্রুপটির একটি ব্যাংকের টাকা দিয়ে আরেকটি ব্যাংক কেনাও ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা জানতেন। তাদের কাজের পথে কোনো ধরনের বাধা যেন তৈরি না হয়, সরকারের টপ লেভেল পর্যায়ের এ-সংক্রান্ত হুকুম জারিও তাদের জানা। একটি গ্রুপের এত বেশি ঋণ নেওয়া এবং একাধিক ব্যাংক একটি গ্রুপের পরিচালনায় থাকা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। বরং দফায় দফায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, ৮০ হাজার কোটি টাকা বা ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে ব্যাংকিং জগৎ তথা দেশের অর্থনীতির ‘প্রাণভোমরা’ করে গড়ে তোলা হয়েছে। দেশের গণমাধ্যমেও এ-সংক্রান্ত খবর আসেনি। গুঞ্জন ছিল। তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ‘গুজব’ বলে। তবে ২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কিছু সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে এসেছে, এস আলম গ্রুপ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারে একাধিক হোটেল কিনেছে দেশটিতে। মাসখানেক আগে তারা কিনে নিয়েছে সিঙ্গাপুরের হায়াত হোটেল। শপিংমলও আছে। যার মূল্যমান কয়েকশ মিলিয়ন ডলার।
রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায় থেকে মদদ পাওয়া এ সম্প্রদায়ের দুর্বৃত্তদের এখন দেশ ছেড়ে পালানো বা রাজসাক্ষী হওয়া ছাড়া তৃতীয় পথ নেই। ঋণখেলাপি আর অর্থপাচারকারীরা আলাদা নয়। একই মানুষ তারা। সব লুটের কুশীলবরা একই বৃত্তভুক্ত। এরা বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বতন্ত্র মেরুদণ্ডী রাখেননি, আজ্ঞাবহ বানিয়ে নিয়েছেন। ব্যাংক জবরদখলের মালিকানা বদলে গভীর রাতে অনুমোদনপত্রে স্বাক্ষর ও প্রজ্ঞাপন দিয়েছেন পাঁচতারকা হোটেলে বসে।
চক্রটি ঠান্ডা মাথায় দীর্ঘদিন থেকে এক এক করে সব গুছিয়ে আনছিল। চেষ্টা শুরু হয় আবুল মালের সময় থেকেই। তাকে বিভিন্নমুখী চাপ ও যন্ত্রণায় ফেলে কিছু কাজ সারা হয়। পরে ২০১৮ এর সরকারে নতুন অর্থমন্ত্রী পেয়ে একেবারে সোনায় সোহাগা পেয়ে যায়। এই অর্থমন্ত্রী নিজেকে একসময় ইসলামী ব্যাংকের প্রোডাকশন বলতেন, এখন তিনিই সাংবাদিকদের কাছে ঋণের তথ্য চেয়ে প্রকারান্তরে নিজের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দিলেন। শতভাগ অর্থমন্ত্রী ও সাবেক গভর্নর সাহেবের দৃষ্টির মধ্যেই এসব হয়েছে।
এখন বেগতিক সময়ে নানা কথার কচলানিতে হাঁড়ির খবর বেরিয়ে পড়ছে। অনেক ব্যাংক ‘নাই’ হয়ে যাবে বা ‘দেউলিয়া’ হয়ে পালাবে ধরনের গুঞ্জনে গ্রাহকদের ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব। কয়েক দিন আগে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছিলেন, অর্থের অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি আনতে পারছে না সরকার। ব্যাংকে একই পরিবার থেকে দুজন পরিচালকের জায়গায় চারজন থাকতে পারবেন- এই নিয়ম করার বুদ্ধি কারা দিয়েছিলেন, এই পরিচালকেরা ছয় বছরের জায়গায় নয় বছর থাকতে পারবেন- মন্ত্রটা কোত্থেকে এসেছিল, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে আনার বুদ্ধি কারা দিয়েছিল? -এসব তথ্যও বেরিয়ে পড়ছে।
অবস্থা ঠেকা দেওয়ার বিকল্প রাস্তা শেয়ারবাজারের শিরা-উপশিরাও নষ্ট করা হয়েছে ওই চক্রের কারসাজিতে। পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান এমনকি শ্রীলঙ্কার শেয়ারবাজারও চাঙা হয়ে উঠেছে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা করুণের চেয়েও করুণ। অর্থ ও পুঁজিবাজারের এমন বেহাল চিত্র আগে কখনো হয়নি। দেশের অর্থ ও পুঁজিবাজার ফোকলা করে দিয়ে আনারসের চোকলা খাইয়ে মানি ফ্লো দেখানোর ফাঁকও আর নেই। এ বাজারের প্রণোদনা-পুরস্কার, সুযোগ-সুবিধা সব হজম করে ফেলেছে লুটেরা ও তাদের সহযোগীরা। তাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা মেটাতে সরকার সম্ভাব্য অনেক কিছুই দিয়েছে। এখন তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। শেষ চেষ্টা হিসেবে সাইডলাইনে অপেক্ষমাণ অপ্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বাজারে টেনে আনার চেষ্টা করছে। ফ্লোর প্রাইস থেকে বাজারকে অন্তত ঘুরে দাঁড় করানোর এ চেষ্টার সাফল্যের নমুনাও দেখা যাচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক মৌল সূচকগুলো ধনাত্মক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু মাফিয়া দানবদের থাবায় বাংলাদেশে সেই ধনাত্মকের ছাপ নেই।