মায়ের ডায়েরি

জাকিয়া শিমু :

আমাদের বাড়ির অদূরে ফিলিপস পার্কে একেলা বসে আছি। মা হসপিটালের হিমঘরে, সেও অবশ্য একাই।
শরৎকাল। মাথার উপর আকাশটাকে সমুদ্রের মতো লাগছে। নীলাকাশের গায়ে ঈষৎ জমাট-ছোপ ছোপ সাদা মেঘের জাল, ঢেউয়ের ডগার ফসফরাসের ফেনার মতো যেন ভেসে যায়। অচেনা পাখির বহর আকাশ ছুঁয়ে ধীরলয়ে ছুটে চলেছে। গাছতলা ঝরাপাতায় নকশি আঁকা চাদরে মুড়ে আছে। পার্কের পাশ ঘেঁষে শিয়ালের চোখের মতো চকচকে কালো জলের লেক। লেকের পাড় ধরে বহুদূর হেঁটে যাওয়া পথ।

ম্যাপলসের টানেলের বৈকালি আলো-ছায়াপথে মা আর আমি প্রায় দিনই বহুদূর পথ হেঁটে চলে যাই। আমাদের পায়ের নিচে চাপা পড়ে শুকনো মচমচে কমলা রঙের ঝরাপাতা, নববধূর হাতের কাঁকনের মতো ঝমঝম শব্দে ভেঙে পড়ে। বালিহাঁস হাওয়ায় ভেসে এসে ঝুপ করে লেকের জলের তলে ডুবসাঁতার খেলায় মেতে ওঠে। ঝরাপাতা আলগোছে আমাদের মাথার উপর ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ে। এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে মায়ের বেশ আগ্রহ। মায়ের চোখ দুটো খুশিতে ছোট্ট খুকিদের মতো ঝলমলিয়ে ওঠে। মায়ের কাছ থেকে হয়তো অভ্যাসটা আমাকেও পেয়ে বসেছে। গত প্রায় দুই দিন এ পার্কেই আমার বেশির ভাগ সময় বয়ে গেল।

আমার মা খুব অভিমানী কিন্তু বোকা ধরনের মানুষ। সৃষ্টিকর্তা বোকাদের বিষয়বুদ্ধি কম দেন কিন্তু সে ঘাটতি পূরণ করেন রূপ দিয়ে। মা অসম্ভব রূপবতী। রূপের সাথে গুণের মিশেলে যার জন্ম তার ভবিষ্যৎ নাকি ভয়ংকর হয়। সৃষ্টিকর্তা তাকে বিশেষ শক্তি দিয়ে ধরায় প্রেরণ করেন। ভাগ্যগুণে সে হয় রাজরানি, নয়তো চাকরানি। এসব কথা আমার নানার বয়ানে শোনা। নানার কাছে আমি আমার ছোটবেলা পার করে এসেছি। নানা আমার বুদ্ধি দেখে চমকে উঠতেন। তার বেজায় খুশি হওয়ার কথা কিন্তু তিনি আতঙ্কিত হতেন। নানিকে বলতেন, মুরগি যখন বাচ্চা ফোটাতে ডিমে তা দেয়, তখন খুব কৌশলী এবং বুদ্ধিমানরা পারে আলগোছে পালকের ভেতর থেকে ডিম সরিয়ে আনতে। তোমার নাতনি সেই গোছের বুদ্ধিমতী। এমন ক্ষণজন্মা মানুষের জন্ম অহরহ হয় না। এরপর দু’হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করতেন, আমি যেন রাজরানি হই। আমার তখন নানার এমন ভারভারতি কথার ভাবার্থ বোঝার বয়স হয়নি। তার পরও আমি নানার সাথে দু’হাত তুলে রাজরানি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হতাম। নানা, আমার রূপবতী মায়ের জন্যও দোয়া করতেন। তার বুদ্ধিশুদ্ধি যাতে সামান্য হলেও বৃদ্ধি করা হয়। সে দোয়া অবশ্য তিনি বেঁচে থাকতে প্রায় প্রতিদিন করতেন। কিন্তু আমার মায়ের জ্ঞানবুদ্ধির খুব একটা নড়চড় এই মধ্যবয়সে এসেও হয়নি।

মায়ের নির্বুদ্ধিতার বহু গল্প আমার ঝুড়িতে আছে! তিনি নিজের গল্প বলতেন আর আফসোস করতেন। এবং আফসোস অব্যাহত রাখতে প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘটাতেন। মায়ের বিয়ের গল্পটা, তার একটি। তিনি বহুবার বিভিন্ন ছলচাতুরে এই গল্প আমার কানে দিয়েছেন। আমার ধারণা, আমাকে ভবিষ্যতে যাতে তার পথ মাড়াতে না হয়, সে জন্য তিনি এই গল্পটা বারবার বলতেন। আমার মায়ের বাড়ি হিজলতলা গাঁয়ে। এ গাঁয়ের নাম নিয়ে বিভিন্ন লোকগাথা রয়েছে। বিষয়টা আমাকে খুব আন্দোলিত করে। মায়ের গল্পের সাথে তার গাঁয়ের গল্প ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
নানার কাছ থেকে শোনা গাঁয়ের গল্পটা অনেকটা এ রকম : এই গাঁয়ে বহুকাল আগে অসংখ্য হিজলগাছ ছিল। কে, কখন, কী উদ্দেশ্যে এসব এ গাঁয়ে রোপণ করে, তার ইতিহাস অবশ্য জানা যায় না। এটা অবশ্য একটা রহস্যও বটে!
হিজলগাছ সাধারণত ডহরডাঙ্গায়, অনাবাদি জায়গাজমিতে অনাদরে বেড়ে ওঠে। তেমন উপকারী নয় বলে গৃহস্থের মূল বাড়ির ত্রিসীমানায় এ গাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু এ গাঁয়ের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
ধারণা করা হয়, কারো কাছ থেকে হয়তো ছড়িয়ে ছিল হিজলগাছ, সৌভাগ্যের প্রতীক। সেই থেকে লোকজন যত্ন করে বাড়ির উঠোনে, আবাদি-অনাবাদি জমিতে, মাঠে-ঘাটে যে যেখানে জায়গা পেয়েছে সারি সারি হিজলগাছ রোপণ করেছে। গাঁয়ের সর্বত্র হিজলগাছের ছড়াছড়ি। ক্রমান্বয়ে গ্রামটা ঢেকে যায় হিজলগাছের ছায়ে।

বহুকাল আগের সে ঘটনা। তখন দেশে রাজপ্রথা চালু ছিল। তো সে সময় কোনো এক রাজ্যের রাজা হাতির বহর নিয়ে এ গাঁয়ের পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন পাশের রাজ্যে। বিশ্রাম নেওয়ার সময় হলে রাজা তার বাহিনীকে এ গাঁয়ে যাত্রাবিরতির আদেশ করেন। তখন ছিল জ্যৈষ্ঠ মাস। তপ্ত দাবদাহে পুড়ে মাঠঘাট শুকনো পাতার মতো ঝরঝরে কড়কড়ে হয়ে আছে। পুরো আকাশ ফাঁকা, কোথাও একখণ্ড মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। সে সুযোগে সূর্য তেতিয়ে উঠেছে। ক্লান্ত হাতি-বহর হিজলগাছের ছায়ায় আয়েশ করে চার পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিশ্রাম নেয়। রাজা এবং তার সঙ্গীসাথিদের জন্য তাঁবু টানানো হয়। রাজার ইচ্ছে দিন শেষের রাতটা এখানে কাটানোর। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস। হিজলফুল ফোটার মৌসুম। গাছের ডাল হতে অসংখ্য পুষ্পদণ্ডের লম্বা ঝাড় ঝুলে আছে বাদুড়ঝোলা হয়ে। পুষ্পদণ্ডে গোলাপি রঙের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তারার মতো অসংখ্য ফুল মালার মতো হয়ে ঝুলে আছে। শেষ রাতে ফুল ফোটে এবং সূর্য উঠতে টুপটাপ ঝরতে শুরু করে। একটু বেলা গড়াতে গাছতলা গোলাপি চাদরে ঢেকে যায়। মৃদু কিন্তু মনমাতানো সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। ভোরবেলা রাজার ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে রাজা তাজ্জব বনে যান। ফুলের সৌন্দর্যে যারপরনাই তিনি মুগ্ধ। নিজে হেঁটে পুরো এলাকা ঘুরে দেখেন। সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তিনি এ গাঁয়ের নাম বদল করে নয়া নাম রাখেন হিজলতলা। রাজার ইচ্ছেয় কর্ম। সেই থেকে এ গাঁয়ের নাম হিজলতলা।

এত দিন পরে এসে সে গাঁয়ের চেহারাসুরত অবশ্য অনেকটাই বদলে গেছে। তার পরও আমার মায়ের বাড়ির সীমানাঘেঁষা বহর-ডাঙ্গায়, গুটিকয় হিজলগাছ হয়তো গাঁয়ের নাম বাঁচাতে এখনো কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। মা ভোরসকালে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন, কোঁচরভর্তি ফুল কুড়ান। হালকা গোলাপি রঙের অগুনতি হিজল ফুল, ডোবার জলে আকাশের বুকে নক্ষত্রের আদলে ভেসে বেড়ায়। অবর্ণনীয় সে দৃশ্য। মা ডোবার জলে দু’পা গুঁজে মনজঠরে লুকানো স্বপ্নদের সুতায় ভরে মালায় গাঁথেন। গুনগুনিয়ে গান ধরেন। একটু বেলা উঠলে মায়ের শাহিন ভাই, সে পথে হাইস্কুলে পড়তে যায়। মাকে দেখে স্মিত হাস্যে মায়ের কাছে এগিয়ে আসেন। মা চটজলদি শাহিন ভাইয়ের হাতে হিজল ফুলের মালা গুঁজে দিয়ে একদৌড়ে ছুটে পালান। এরপর মা প্রাইমারি, হাইস্কুল পেরিয়ে স্থানীয় কলেজে ভর্তি হন। শাহিন ভাই শহরে উঁচু ক্লাসে পড়তে চলে যান। মায়ের সাথে গোপনে চিঠিপত্রের চালাচালি অবশ্য অব্যাহত থাকে।
এদিকে মায়ের সৌন্দর্যের বর্ণন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে। পাশের গাঁয়ে আমার দাদাবাড়ি। বাবা আমেরিকা থেকে দেশে ফেরেন, একজন রূপসী কন্যার খোঁজে। লোক মারফত খবর পান পাশের গাঁয়ে আগুনজ্বলা এক মেয়ে আছে। মাকে একনজর দেখামাত্র বাবার মনে ধরে যায়। বাবা যে রূপের পূজারি। মায়ের সম্মতিতে সেই রাতেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।

মা অবলীলায় শাহিন ভাইয়ের সাথে হাজারো স্মৃতি-প্রতিশ্রুতি, দুই জোড়া বিশ্বস্ত হাত, কাছাকাছি অনুভূতির দুটি মন এসব কিছুকে নিমেষে জলাঞ্জলি দিয়ে দেন। বাবা মাস দুয়েক মায়ের সাথে কাটিয়ে আমেরিকায় ফেরত আসেন। এরপর আমার জন্ম হয়। আমি আর মা নানার কাছে থাকি। বাবা মাঝেমধ্যে ছুটিছাটায় দেশে এসে আমাদের দেখে যান। আমার যখন বয়স পাঁচ, নানা পৃথিবী ছেড়ে অন্য আলয়ে চলে যান। আমরা একটা কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাই। বাধ্য হয়ে অবশেষে বাবা আমাদের আমেরিকায় নিয়ে আসেন।

মায়ের সাথে বাবার বনিবনার বিষয়টা অস্পষ্ট, অনেকটা ভরা মাঘ মাসের কুয়াশার মতো, অথই আঁধার। আমার কাছে তো বটেই, আমার মনে হয় তাদের নিজেদের কাছেও তা পরিষ্কার নয়। তবে দুজনের মনের মাঝের অসীম দূরত্বটা আমি আঁচ করতে পারি। বাবা যখন অকাজে মাকে অপমান করেন, তার চোখে তখন ভাসে অন্য পুরুষের ছবিÑশাহিন ভাই। গত দুদিন আগেও আমি মায়ের টলমল চোখে সে ভুলের আক্ষেপ দেখেছি। মাকে আমি বহুবার গোপনে জিজ্ঞেস করেছি, কেন তিনি শাহিন ভাইকে ছেড়ে বাবাকে বিয়ে করেছিলেন। মা সঠিক কোনো হেতু দাঁড় করাতে পারেন না। আদতে সেটা মায়ের বোকামির খেসারত ছাড়া অন্য কিছু নয়।

অন্যদিকে বাবার আছে ব্যত্যয় সৌন্দর্য-পূজারি দু’খানা শকুনে-চোখ! রূপের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে বাবা ভালোবাসেন কিন্তু প্রকৃত সৌন্দর্য ধারণ করার ক্ষমতা আসলে তার নেই। যে সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মাকে এক দিনের নোটিশে বিয়ে করেছিলেন, সেই একই স্বরূপের খোঁজে মাকে ছেড়ে শম্পা খালাসহ আরও অনেকের পেছনে ছুটে চলেছেন।

বাবাকে আমি মনে মনে নপুংসক বলি। অন্তত গত দুদিনে বহুবার নিজমনে এমন নোংরা শব্দটা আওড়েছি। নপুংসকের প্রেমাকাক্সক্ষা থাকে আসমান সমান কিন্তু হৃদয় থাকে শূন্য। এদের কাউকে আপন করে ধারণ করার ক্ষমতা থাকে না। ভেতর জগতের পুরোটাই থাকে, নিঃস্ব-নিরাশ্রয়। আপন ভালোবাসার আশ্রয় রেখে বাইর-দুয়ারে প্রেম খুঁজে ফেরে। বাবা যখন শম্পা খালার সাথে কথা বলেন, আমি একদৃষ্টিতে তার লোলুপ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। ফিসফিসিয়ে বলি, নপুংসক। মা ছাড়া অন্য যেকোনো নারীর সাথে বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলেন। আমার মা, সে লোভাতুর দৃষ্টি পড়তে পারেন না, তা কিন্তু নয়। সেটুকু ক্ষমতা অবশ্য সৃষ্টিকর্তা তাকে দিয়েছেন। মায়ের নিঃসঙ্গ চোখজোড়ায় তখন অপমানের অভিচ্ছায়া পরিপুষ্টভাবে ফুটে ওঠে। মা যখন বাবার কাছ থেকে চরম অপমানিত হন, তখন ছোট্ট শিশুর মতো আমার কাছ ঘেঁষে চুপচাপ বসে থাকেন। আমি মায়ের কাছে গল্প শুনতে আবদার করি। আমি জানি, এ সময়ে মাকে তার দেশের কথা মনে করিয়ে দিলে, অপমানের ধাক্কাটা অন্যদিকে সরে গিয়ে একটু হলেও স্বস্তি পাবেন।

মায়ের নিজের দেশের প্রতি বড্ড টান। দেশের গল্প বেশ উৎসাহ নিয়ে করেন। কত গল্পÑআড়ই বিলের গল্প, ইছামতিপাড়ের গল্প, হিজলতলা গাঁয়ের কথা, আরও কত শত গল্প যে মায়ের ভেতর জমে আছে। সেসব গল্পে আদ্যোপান্ত জুড়ে থাকেন মায়ের শাহিন ভাই। মা যখন মনঃকষ্টে ভোগেন, শাহিন ভাই যেন মলম হয়ে মায়ের মনে প্রশান্তি ছড়ান। মা, শাহিন ভাইয়ের গল্প বলেন, আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে মায়ের মুখখানা দেখি। ক্রমশ বাবার অবহেলার কালো মেঘের ছায়া মায়ের চোখ থেকে ছুটে পালায়। মা সেই পুরোনো দিনের সময়গুলোতে ফিরে যান।
মায়ের বাড়ি থেকে অনেকখানি দূরে বিখ্যাত আড়ই বিল। বর্ষার দিনে সেই বিলের জলের ছাদে লালচে-কমলের মেলা বসে। বিলটাকে আকাশ মনে হয়। যেন আকাশের পরে শতসহস্র লালচে নক্ষত্র জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মায়ের খুব পছন্দের ফুল কমল। কিন্তু মায়ের পানিতে বড্ড ভয়। তা ছাড়া কমলের পাতার ওপর জলঢোঁড়া হেঁটে বেড়ায়। জলঢোঁড়া মানুষের ক্ষতি করে না। শাহিন ভাই মাকে বুঝিয়েও সাপের ভয় কাটাতে পারেন না। মায়ের আড়ই বিলে যাওয়া হয় না বটে কিন্তু কমল ফুলের পিয়াস তাকে জেঁকে বসে। শেষমেশ শাহিন ভাই ভোরসকালে সালতি বেয়ে একাই চলে যান আড়ই বিলে। সূর্য জাগার আগে সদ্যফোটা কমল তুলে নেন, তাতে ফুলগুলো বেশ তরতাজা থাকে। মায়ের হাতে কয়েক গুচ্ছ কমল তুলে দিয়ে নীরবে বাড়ির পথে পা বাড়ান। মায়ের চোখের কোণে সেই খুশির অশ্রু আজও চিকচিক করে। আমি বহুবার এ গল্প মায়ের মুখে শুনেছি, তার পরও আগ্রহ নিয়ে মায়ের দিকে মনোযোগ দিই। মাকে একদণ্ড শান্তি দিতে আমি বারবার শুনি মায়ের হারিয়ে ফেলা গল্পের ঝুড়ির গল্পগুলো। গল্প শেষে মা দূর আকাশে উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন।

মায়ের হিজলতলা গাঁয়ে পৌষ-সংক্রান্তির মেলা বসে। বেশ নামডাক এ মেলার, বহুলোকের জমায়েত হয়। মায়ের তখন অল্প বয়স, বড়জোর সাত কিংবা আট হবে। মা শাহিন ভাইয়ের সাথে মেলায় সারা দিন ঘুরঘুর করেন। তার কাছে মেলার প্রধান আকর্ষণ চড়কগাছ। চড়কগাছ যখন উপর হতে নিচ দিকে নেমে আসে, মায়ের তখন অসাধারণ এক অনুভূতি হয়। যে বোধ বলেকয়ে বোঝাবার নয়। নিজেকে খোলা আকাশে ঘুরে ফেরা মুক্তবিহঙ্গ মনে হয়। মা দু’হাত দুদিকে ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে আকাশে উড়ে বেড়ান। মেলায় লম্বা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে বায়োস্কোপ দেখেন। বায়োস্কোপে ভিন্ন জগৎ দেখায়। সেসব নিয়ে মায়ের মনে হাজারো অজানা কথা ঘুরে ফেরে। শাহিন ভাই বিশেষ ধৈর্য নিয়ে সেসব নিছক ভাবনার পাশ থেকে মাকে বের করে আনেন। কালোর মতো নীল রংটাও মায়ের খুব পছন্দ। নীল রেশমি চুড়ি দুহাতে ভরে তবেই মা শান্ত হন। নানির নির্দেশ সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। শাহিন ভাই বাড়ি ফেরার তাড়া করেন। মায়ের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মা মেলার ভিড় দুহাতে ঠেলে সামনে এগিয়ে ঠিক ঠিক খুঁজে বের করেন কুমোরদের দোকানগুলো। মাটির বাহারি জিনিসপত্রে ঠাসা সেসব দোকান থেকে তুলে নেন ট্যাপা পুতুল। একটা নয়, দু-দুটো ভিন্ন গড়নের ট্যাপা পুতুল তার চাই। শেষে ভরসন্ধ্যা মাথায় করে মা বাড়ির পথ ধরতেন।
বড় হয়ে অবশ্য মায়ের আর সেভাবে মেলায় যাওয়া হয় না। শাহিন ভাই শহরে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকেন। তা ছাড়া মায়ের বাড়ির নিয়মকানুন ছিল গাঁয়ের আর দশটা বাড়ি থেকে খানিকটা ভিন্ন গোছের। বাড়ির বউ-ঝিরা মেলা বান্নি এড়িয়ে চলতে বাধ্য হতো। কিন্তু এ দিনটি শাহিন ভাই ভুলতেন না। পৌষ-সংক্রান্তির মেলার দিন তিনি ঠিকই হিজলতলা গাঁয়ে ফিরতেন। ভরসন্ধ্যাবেলায় নীল রেশমি চুড়ি, ট্যাপা পুতুল নিয়ে মায়ের বাড়ি আসতেন। মা সেসব স্মৃতি ঘেঁটে আজও পুলকিত হন।

ইংরেজি নববর্ষ পালনে সে সময়ে দেশে আজকালের মতো রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু এ দিনে শাহিন ভাই মাকে সে সময়ের আলোচিত আজাদ প্রোডাক্টসের একটা ডায়েরি নববর্ষের উপহার হিসেবে দিতেন। মায়ের ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই কিন্তু শাহিন ভাই নিয়মিত ডায়েরি লেখেন। মাকে উৎসাহ দিয়েও কাজ হয় না। মা অবশ্য দেশ ছেড়ে আসার সময় যত্ন করে সেসব ডায়েরি বয়ে নিয়ে আসেন। মায়ের খুব মন খারাপ হলে মা আমার পড়ার টেবিলে বসে গুটি গুটি অক্ষরে মন দিয়ে কীসব লেখেন। আমি লুকিয়ে মায়ের কাণ্ড দেখি। মা লিখতে লিখতে উদাস হোন, কখনো চোখের জল ওড়নার আঁচলে মোছেন। ডায়েরি লেখা শেষ হলে আমার ঘরের আলমারিতে যত্ন করে তুলে রাখেন। মায়ের চেপে রাখা বুকের কষ্টপাহাড় উগলে উঠে গলার কাছটায়, ধরা কণ্ঠে বলেন, ‘যখন আমি থাকব না, এই ডায়েরিগুলো তোর হবে।’ মায়ের চোখ জলে ভরে ওঠে। আমি মায়ের চোখের জল যত্ন করে মুছে দিই কিন্তু মায়ের বুকের ভেতরের কষ্টটার কোনো হেরফের করতে পারি না।

শম্পা খালা ‘ঘষামাজা’ ধরনের সুন্দর। নিজেকে সুন্দর করতে বেচারা রাতদিন পরিশ্রম করে। যদিও ভেতরের স্বরূপ কদর্যে ভরপুর। পরপুরুষের সামনে নিজেকে ঢলেঢঙ্গে মেলে ধরে। রাস্তার মেয়েদের মতো। আমার মায়ের বেলেল্লাপনা ‘গুণ’ নেই। মায়ের সৌন্দর্য যতটা না তার দেহে, তার চেয়ে ঢের বেশি অন্দরে। তবে অন্তরের সৌন্দর্য দেখার মতো ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা সবাইকে দেন না। বাবাকেও সে সামর্থ্য দেওয়া হয় নাই। বাবার মুরোদ নেই মায়ের মতো মানুষের মনোজগতের নাগাল পাওয়া। তিনি তার অক্ষমতা ঢাকতে শম্পা খালার সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকেন। মাকে চরমভাবে অহোরাত্র অকারণ অপমান করেন। শম্পা খালার বাসায় যখন তখন যাতায়াত করেন। শম্পা খালার স্বামীর সাথে বাবার ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই অকারণ তার বাসায় যাতায়াত বাবার জন্য বেশ সহজ ছিল।

অবশ্য বাবা শুধু শম্পা খালা নন, এমন অগুনতি মেয়ের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেন। আমার বোকা মা এ দেশে আসার আগে বিষয়টি টের পাননি। মা সহজ-সরল এবং বিশ্বাসী। বাবা এই সুযোগটা হাতিয়ে নিয়ে নির্ভয়ে বহুগামিতা করে বেড়ান।

মাকে আমি প্রায়ই বলি, ‘চলো মা, আমরা হিজলতলা গাঁয়ে ফিরে যাই।’ মায়ের চোখে মুহূর্তে খুশির রেখা ঝলমলিয়ে ওঠে। মায়ের চোখে ভেসে ওঠে হিজলের বন, ইছামতি নদীর পাড়, মায়ের বাড়ির পাশের খোলা মাঠে ভরে ওঠা সরষে ফুলের হলুদ বন, মাঝের চরের কচুরিপানার বিল, ঝিলের জলের কমল, নানার আশ্রয়-প্রশ্রয়। এবং মায়ের খুব কাছের শাহিন ভাই। আরও কত কী! কিন্তু মুহূর্তে মা মিইয়ে যান। মায়ের কাছে এখন হিজলতলা গাঁয়ের সবকিছু খাঁ খাঁ শূন্যতায় ঘেরা দুঃস্বপ্নালোক। হিজলতলা গাঁয়ের হিজল বন উজাড় হয়েছে সেই কবে। নানাও পৃথিবী ছেড়েছেন। মায়ের সেই শাহিন ভাই, অবশেষে বিয়ে করে শহরে সংসার পেতেছেন। মা বলেন, ‘হিজলতলা গাঁয়ে এখন ঘুটঘুটে আঁধার। হিজলগাছগুলোর মতো করে আপন মানুষগুলোও ধীরে ধীরে ও গ্রাম থেকে বিদায় নিয়েছে।’ মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তার ভেতরের কষ্টপাহাড়টা আঁচ করতে পারি। মা এখন শুধু ফেলে আসা সেসব সুদিনের স্মৃতি হাতড়ে ফিরে বেঁচে আছেন।

শরতের এই সোনালি রোদে আমার হিমধরা শীত লাগছে। আমি দুহাত বুকের কাছে ভাঁজ করে গুটিয়ে নিয়ে বসে আছি। মা গরমের দিনেও শীতে চুপসে যেতেন। ঘরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে রাখতেন। আমরা ঘেমে উঠতাম। শেষমেশ অবশ্য আমার কষ্ট বিবেচনায় তাপমাত্রার স্কেল কমিয়ে নিজের গায়ে সামার জ্যাকেট জড়াতেন। গত দুদিন মা হসপিটালের হিমঘরে। মায়ের কি তীব্র শীতবোধ হচ্ছে? হবে হয়তো। মায়ের ওপর থেকে আমার অভিমানটা ধীরলয়ে ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। মা শীতে নিশ্চয় খুব কষ্ট পাচ্ছেন। তাকে কি ভারী একটা কম্বলে জড়িয়ে রাখা যায় না!
এলিজা, আমার বন্ধু। গত দুদিনে স্কুলের সময় ছাড়া বাকি সময়টা আমার পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। এলিজার হিমঘর নিয়ে অভিজ্ঞতা আছে। ওর দাদি গত বছর করোনায় মারা গেলেন। প্রায় দুই সপ্তাহ হিমঘরে ছিল। এখন স্কুলসময়। স্কুল থেকে ফিরে নির্ঘাত আমার কাছে চলে আসবে। তখন হিমঘরের বিষয়-আশয় জেনে নেব।

এলিজা যতক্ষণ আমার কাছে থাকে, আমি তাবৎ দুনিয়ার অশুভ বিষয় ভুলে যাই। অভিরূপ, মায়ের সাথেও এমনটা ঘটত। মা আমাকে দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারতেন। মায়ের ঝুলিতে হাজারো গল্প। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। এলিজাকে মা খুব ভালোবাসতেন। এলিজাও আমার মাকে নিজের মায়ের মতো দেখত। এলিজা, স্বভাবে বেশ চটপটে অস্থির কিন্তু বেচারা গত দুদিনে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। আমার পাশে এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকে।

বাবা ধর্মকর্ম খুব একটা করেন না। কিন্তু গত দুদিন খুব করে এসব করে বেড়াচ্ছেন। লম্বা আলখেল্লা গোছের পাঞ্জাবি তার গা থেকে নামছে না। শোক পালনের যাবতীয় অভিনয়ে তিনি খুব ভালো করছেন, অবশ্য এর মধ্যে আরেক উটকো ঝামেলা তার পিছু ছাড়ছে না। পুলিশ! বারবার পুলিশের সাথে কথা বলতে হচ্ছে। তাদের সন্দেহ তাকে ঘিরে। বাবার এমন ভয়ে তটস্থ অবস্থায় আমি অভ্যস্ত নই। তিনি সব সময় খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে চলেন। মা চলে যেয়ে বাবাকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত একটা অবস্থায় ফেলে গেছেন। বেঁচে থাকা অবস্থায় অবশ্য তার এমন ভগ্ন-অবস্থা প্রাপ্য ছিল। আমার সাথেও অবশ্য পুলিশ কথা বলেছে। বাবা আমাকে নিয়ে ভয়ে আছেন। কারণ অবশ্য স্পষ্ট, আমি মায়ের মতো বোকা নই। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বাবাকে ফাঁসানোর আলামত পাওয়া যায়নি। তার পরও পুলিশ সহজে বাবাকে ক্ষান্ত দিচ্ছে না। বাবার এমন ভোগান্তি অবস্থাটা দেরিতে হলেও আমি খুব উপভোগ করছি। শুধু মায়ের জন্য আফসোস হচ্ছে।

গত দুদিন আমার মাথা এলেবেলে ভাবনায় জট বেঁধে আছে। যেমন মাকে আমার খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে। মা ছাড়া আমার অন্য কোনো আশ্রয় গড়ে ওঠেনি। মায়েরও তদ্রƒপ। মা নিজে চলে যেয়ে বেঁচে যেতে চাইলেন! আমার কথা মনে পড়লে মা হয়তো এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতেন না। মাকে ছাড়া পৃথিবীতে আমি কী করে বাঁচব, এমন ভাবনা কি মায়ের মনে আসেনি! হয়তো ভেবেছিলেন, শেষ সময়ে। কিন্তু তখন ফেরার পথ ছিল না। সে অসহায় মুহূর্তটা ভাবতে আমার খুব কষ্ট হয়। আমার কষ্টের মাত্রা হয়তো শেষ সময়ে মা টের পেয়েছিলেন। তাইতো ঝুলে থাকা পায়ের নখগুলো ক্ষত-বিক্ষত ছিল। বাঁচার জন্য পাশের দেয়ালটাকে পা দিয়ে আঁকড়ে ধরতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। জানালার পর্দা পা দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছেন। আহা! বাঁচার জন্য কী ভয়ংকর চেষ্টা ছিল, অথচ ঝুলে পড়ার আগে, পরের অবস্থাটা কল্পনায় আসেনি।

মায়ের প্রতিক্ষণ চিতার আগুনে জ্বলে মরার কষ্টটা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তীব্র অপমানের অসহায় চোখের আমি সাক্ষী। হয়তো ভেবেছিলেন হাজার বার না মরে একবারে চলে যাই। ‘আত্মহত্যা মানে অন্যকে জিতিয়ে দেওয়া। নিজেকে বঞ্চিত করা’Ñনানা বলতেন। আমি যতদূর জানি, মাও তা বিশ্বাস করতেন।

মায়ের তো অন্তত আমি ছিলাম, আরও অনেকে ছিলেন। নানা চলে গিয়েও মায়ের সাথে আরো বহুগুণে জুড়ে ছিলেন। অন্যদিকে বাবার আদতে কেউ কখনো ছিল না। বাবা একা। কাউকে একান্ত নিজের করার ক্ষমতা তার নেই। এই সহজ বিষয়টা মায়ের মগজে কেন ধরল না! বাবার কারণে মায়ের যখন মন খারাপ করত, আমি বলতাম, ‘তোমাকে ধারণ করার ক্ষমতা বাবাকে দেওয়া হয় নাই। তাকে নিয়ে তুমি স্বপ্ন বেঁধো না।’ মা বুঝতেন কি না, জানি না, ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। মাকে আমি খুব বেশি ভালোবাসি, মায়ের সরলতা এবং সততার কারণে। মাকে আমি বহুবার জড়িয়ে ধরে বলেছিও, ‘তুমি ছাড়া আমার পৃথিবী অচল।’ মায়ের অপমানের যন্ত্রণার কাছে আমার প্রতিশ্রুতিরা হয়তো মাকে সঠিক পথের ঠিকানা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।

এলিজার মা নেই। ভুল বললাম, আছে কিন্তু তার সাথে এলিজার কখনো যোগাযোগ হয়নি। ওর মায়ের একটা চিঠি আছে ওর কাছে। সেখানে ওর বয়স আঠারো হলে ওকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে। আমার মা এলিজার দুঃখে চোখের জল ফেলতেন। এলিজা অবশ্য মাকে বোঝাত। ওর যখন আঠারো হবে, তখন সে মায়ের কাছে চলে যাবে। মা সেসব প্রতিশ্রুতি মেনে নিতে চাইতেন না। আজ আমার খুব করে মনে হচ্ছে, মা তো এলিজার মতো আমাকে একটা বছর অবধি স্বপ্নে আটকে রাখার পথও খুলে রেখে গেলেন না। এলিজার মা নেই বলে, মা ঠিক আমার মতো করে ওকে আদর করতেন। ওরা আমাদের পড়শি। আমরা একসঙ্গে একই স্কুলে পড়ি। একসাথে স্কুলে আসা-যাওয়া করি। আমার মায়ের গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। বাবা চাইতেন না বলে মায়ের লাইসেন্স পাওয়া হয়নি। মা আমাদের সাতসকালে হেঁটে স্কুলে দিয়ে আসেন, স্কুল শেষে বাড়ি নিয়ে আসেন। এ সময়ে মা এলিজার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতেন। এলিজা আমার মাকে হারিয়ে শোকার্ত, ওর চোখ দুটো কান্না সামাল দিতে ফুলেফেঁপে লাল টকটকে হয়ে আছে।

আমি চোখ বন্ধ করে লেকের ধারের বেঞ্চিতে বসে আছি। এলিজা আমার হাত ধরে বসে থাকে। ওকগাছ বেয়ে বেশ কটা কাঠবিড়ালি আবোলতাবোল খেলা খেলে যায়। একলাফে একদম মগডালে উঠে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার ভোঁ-দৌড়ে নিচে নেমে আসে। লেকের পানিতে রাজহাঁসের দল প্রতিদিনের মতো মাথা জলের তলে গুঁজে খাবারের খোঁজে। মৃদু হাওয়ায় গাছের পাতায় শিরশিরিয়ে কাঁপন ধরে। আকাশজুড়ে ধবল বকের ডানার মতো মেঘের বহর উড়ে উড়ে বহুদূরের পথে চলে যায়।

চারপাশের প্রকৃতির আয়োজন সেই আগের মতোই আছে। একবিন্দু নড়চড় নেই। কেবল মা বহুদূরের অজানা পথে চলে গেলেন। আজ বিকেলে আরও দূরে, যেখানে ফেরত আসার পথ রুদ্ধ, সেখানে চলে যাবেন। মা কি সবকিছু ভেবেচিন্তে এমনটা করলেন! মা, একা অন্ধকার ঘরে থাকতে ভয়ে পেতেন। অনেক কিছুতেই মায়ের ভয় ছিল। বাবার সাথে সামান্য বাক্য বিনিময়ে মা ভয়ে চুপসে যেতেন। তিনি এমন ভয়ংকর অচেনা পথে হাঁটার সাহস পেলেন কোথা থেকে! ভাবনাগুলো আমাকে মাকড়সার জালের মতো অবরুদ্ধ করে রেখেছে।

বাবা শোকের চিহ্ন ধরে রাখতে কালোর ওপর রুপালি জরির কাজ করানো পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়েছেন। গত বছর ঈদের সময় মা নিজের শাড়ির সাথে মিলিয়ে বাবার জন্য পাঞ্জাবিটা নিয়েছিলেন। মায়ের শাড়ি ভাঁজভাঙাহীন হয়ে পড়ে আছে ক্লোজেটে। হয়তো আজকের দিনে বাবার এই রংটা লাগবে মায়ের এমন মনে হয়েছিল কিনা! মা একটু আগবাড়িয়ে আমাদের দেখভাল করতেন। অসম্ভব ভালোবাসার ক্ষমতা ছিল। কাউকে নিয়ে কখনো অভিযোগ করতেন না। মায়ের চারপাশের মানুষগুলো ছিল প্রায় সবাই সমান দরের লোক। মা ছিলেন ব্যতিক্রম। মায়ের সমমনা মানুষের খোঁজ করার অধিকার মায়ের ছিল না। বাবার বেঁধে দেওয়া গণ্ডির বাইরে যাওয়া মায়ের বারণ ছিল। বাবার ব্যবসার সাথে যারা জড়িত, তাদের পরিবারের সাথে মায়ের বাধ্যগত চলাফেরা সীমাবদ্ধ। এসব পরিবারের মানুষগুলোর চলাফেরার ধরনধারণ স্বাভাবিক মানুষজনের চেয়ে একদম আলাদা। এদের হাতে প্রচুর টাকাকড়ি। বিষয়-সম্পদের গালগল্প এদের পছন্দের বিষয়। মাকে দেখতাম এসবের মাঝে নিরুপায় হয়ে বসে থাকতেন। কোনো অভিযোগ ছিল না।

শম্পা খালাকে নিয়েও মায়ের সবাক অভিযোগ দেখিনি। তার স্বভাবচরিত্র পুরো শহর জানত, মাও জানতেন কিন্তু ধর্তব্যের মধ্যে নিতেন না। বাবা যখন বাসায় থাকতেন, শম্পা খালা সেজেগুজে আমাদের বাড়ি ঘুরঘুর করতেন। মা হাসিমুখে তাকে আপ্যায়ন করতেন। তাদের মাঝের নোংরা সম্পর্ক মা ঠিক ঠিক টের পেতেন কিন্তু বুঝতে দিতেন না। মাকে বাবার সাথে এ বিষয় নিয়ে আমার সামনে অন্তত কোনো ফ্যাসাদে যেতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মায়ের অসম্ভব আত্মসম্মানবোধ ছিল। বাবা মাকে অহরহ অবহেলা করতেন। মানুষের সামনে মাকে অসম্মান করতেন। বাবা ইচ্ছে করে এসব করতেন। দেশে ফিরে যেতে চাপ দিতেন।

শম্পা খালা কুচকুচে কালোর ওপর রুপালি জরির কাজ করা একটা তাঁতের শাড়ি পরেছেন। সকলের পাশে বসে চোখেমুখে মাত্রাতিরিক্ত দুঃখের ছায়া ধরে রাখতে তটস্থ। বাবা কালো পাঞ্জাবিটা পরেছেন। ঈদের দিন সকালে মা বাবাকে পাঞ্জাবিটা বের করে দেন। নিজেও কালো শাড়িটা নামিয়ে আনেন ড্রেসিংরুমে। সে ঈদে আমাকেও কালোর ওপর সাদা সুতোয় কাজ করা চমৎকার একটা জামা কিনে দেন। ঈদের জামাত শেষে আমাদের বেড়াতে যাওয়ার কথা। বাবা হঠাৎ পাঞ্জাবিটা দেখে খেপে যান। ষাঁড় যেমন লাল রং দেখলে খেপে যায়, বাবার আচরণটাও ছিল তার অভিরূপ। বাবা, মায়ের যেকোনো আগ্রহকে নিমেষে নিষ্প্রভ করে দিয়ে সুখ পান। বাবা তখন বলেছিলেন, রংটা তার পছন্দ নয়। মায়ের পছন্দের রং কালো। বাবার পছন্দের রং আমি জানি না। বাবা খোলাসা করে তার কিছুই আমাদের বলেন না। হয়তো বাবার সব রং পছন্দ, শুধু মায়ের পছন্দের রং কিংবা পছন্দ ছাড়া। পাঞ্জাবিটা বাবাকে আসলেই খুব মানিয়েছে কিন্তু আফসোস, মা নিজের চোখে দেখে যেতে পারলেন না। সেবার আমাদের ঈদ হলো না। আমার আর মায়ের। বাবা হাতের কাছে যে পাঞ্জাবিটা পেলেন, গায়ে জড়িয়ে ঈদ জামাতে চলে গেলেন। জামাত শেষে শম্পা খালার বাসায় সময় কাটালেন। আমি আর মা চুপচাপ ঘরে বসে রইলাম।

মাকে হিমঘর থেকে অবশেষে বের করে নিয়ে আসা হয় গোরস্থানে। আমি, বাবা এবং আরও অনেকে মায়ের জন্য অপেক্ষায় থাকি সেখানে। বাদ আসর মায়ের জানাজা শেষে এখানে দাফন হবে। আমি কিংবা মা আগে কখনো এ স্থানে আসিনি। মায়ের কবরস্থান বিষয়ে খুব ভয় ছিল। মায়ের মতো আমারও খুব ভয়। হাইওয়ের এক পাশে কবরস্থান। বহুবার এ পথে আমরা গিয়েছি। মা আমার চোখ চেপে ধরে থাকতেন, যেন আমি ওদিকে না তাকাই।

মায়ের মুখটা শেষবারের জন্য আমাকে দেখাতে কেউ আগ্রহ দেখায় না। অপঘাতে চলে যাওয়া মুখের আদল পুরোটাই বদলে যায়। আমি অবশ্য আগবাড়িয়ে দেখতে চাইনি। মায়ের রূপ আমার চিরচেনা, সেটাই আমৃত্যু আমি ধরে রাখব।
মাকে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে কবরে নামানো হলে বাবা আমাকে অনেকটা জোর করে কাছে নিয়ে যান। আমি এক মুঠ বালুমাটি হাতের মুঠে পুরে নিয়ে মায়ের ওপর ছড়িয়ে দিই। এরপর একটু একটু করে উপর থেকে হাজার মুঠো মাটিতে মায়ের কাফন জড়ানো দেহটা মাটির ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়।

গত দুদিনে আমার চোখে একফোঁটা অশ্রুবিন্দু ঝরেনি। সমস্ত কষ্টটা বুকের ভেতর পাথর হয়ে জমাট বেঁধে ছিল। আজ এ মুহূর্তে মাকে মাটির গভীরে তলিয়ে যেতে দেখে সে কষ্টগুলো আষাঢ়ের অঢেল বৃষ্টির মতো দুচোখ বেয়ে অবিরত ঝরতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম, এ মুহূর্ত থেকে আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলাম। যাকে আজ হারালাম, তার চেয়ে বেশি আর কী-ইবা হারানোর আছে আমার! আমার আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না।
বাড়ি ফেরার আধঘণ্টা পর পুলিশের তিন-তিনটে গাড়ি আমাদের বাড়ির পার্কিং লটে এসে ভেড়ে। আমি বাড়ির সম্মুখের খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়াই। মাথার উপর বিছিয়ে থাকা আকাশে আজ বড্ড নীল রঙের ছড়াছড়ি। শেষ বিকেলের আহ্লাদী রোদটা বারান্দার পাশে মায়ের ফুলবাগানে মৃদু আবেশ ছড়িয়ে যায়। ফুলের ওপর নানান রঙের প্রজাপতি পাখনা তুলে নেচে বেড়ায়।

পুলিশপ্রধান সহাস্যে আমার দিকে এগিয়ে আসেন। সঠিক সময়ে মায়ের ডায়েরিটা তার হাতে দিয়েছিলাম বলে বিশেষ ধন্যবাদ জানান। বাবার হাতে হাতকড়াটা শক্ত গিঁটে লাগিয়ে তাকে পুলিশের বিশেষ ভ্যানে তুলে নেন। মাকে আত্মহননের পথে যেতে বাবার বিশেষ ভূমিকা সবিস্তারে মা তার ডায়েরিতে লিখে রেখে যান।