বাহারুল আলম :
বিগত কয়েক মাসের বহু জল্পনা-কল্পনা ও আলোচনা-পর্যালোচনার অবসান শেষে আমেরিকার ইতিহাসের সবচাইতে উত্তেজনা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মধ্যবর্তী নির্বাচন গত ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের আগে ৯দিন ধরে চলে আগাম ভোট পর্ব।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, আগাম ভোট পর্বে প্রায় ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। এতো বিপুল সংখ্যক ভোটারের ভোটদান এই নির্বাচনকে ঘিরে তাদের মধ্যে সৃষ্ট ব্যাপক উত্তেজনা ও উৎসাহেরই প্রমাণ বহণ করে।
মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের (House of Representatives) ৪৩৫টি, সিনেটের ৩৫টি এবং ৩৬টি রাজ্যের গভর্নর ছাড়াও স্থানীয় সরকারের বহু পদে (অ্যাটর্নি জেনারেল, সেক্রেটারি অব স্টেট ইত্যাদি) নির্বাচন হয়। প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২১৮টি, আর সিনেটে ৫১টি আসন।
বিভিন্ন মহল থেকে এসব পদের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দেয়া হয়। প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের জয়ের আভাস থাকলেও সিনেটের নিয়ন্ত্রণ কোন পক্ষে যাবে- সেটা হলফ করে বলা যায়নি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত নির্বাচনের সর্বশেষ ফলাফলে দেখা যায়, প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা পেয়েছে ২২২টি আসন, আর ডেমোক্র্যাটরা ২১৩টি আসন। সিনেটে ডোমোক্র্যাটরা ৫০টি ও রিপাবলিকানরা ৪৯টি আসনে বিজয়ী হয়েছে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সিদ্ধান্ত নির্ধারণকারী ভোটের কারণে সিনেটের নিয়ন্ত্রণ থাকছে ডেমোক্র্যাটদের হাতে। জর্জিয়ার একটি আসনে দু’দলের কেউ প্রয়োজনীয় ৫০ ভাগ ভোট না পাওয়ায় ঐ আসনে আগামী ৬ ডিসেম্বর পুনরায় নির্বাচন (Run Off) অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হলেও সিনেটে বিজয় ছাড়াও বেশ কয়েকটি রাজ্যে গভর্নর পদে ডেমোক্র্যাটরা বিজয়ী হন। নিউইয়র্ক, ম্যাসাচুসেটস, উইসকনসিন, ইলিনয়, কানেকটিকাট, অরেগন ও পেনসিলভানিয়াসহ আরো কয়েকটি রাজ্যে গভর্নর পদে তারা বিজয় লাভ করে। ট্রাম্প সমর্থিত বেশ কয়েকজন প্রার্থী বিজয়ী হলেও কয়েকজন পরাজিতও হন। ট্রাম্প সমর্থিত পরাজিত প্রার্থীদের মধ্যেÑ ডাগ মাস্ট্রিয়ানো, ডা. মেহমেত অজ (পেনসিলভানিয়া), টিউডর ডিক্সন (উইসকনসিন), ব্লেইক মাস্টার্স (অ্যারিজোনা), সারাহ পোলিন (আলাস্কা) এবং অ্যাডাম ল্যাক্সল্ট (নেভাদা) অন্যতম।
ট্রাম্প সমর্থিত প্রার্থীদের অনেকের পরাজয়ের ফলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মার্কিন রাজনীতিতে তিনি ঐক্যের বিপরীতে যে একজন Polarising figure, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। গর্ভপাতের অধিকারের (Right to choose) কঠোর বিরোধিতা এবং ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবন হামলার ঘটনায় তার ভূমিকার বিষয়টি জনগণ বিস্মৃত হয়নি।
নির্বাচনে এহেন ফলাফলের কারণে রিপাবলিকান পার্টিতে তার একচ্ছত্র প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেকটাই ক্ষুণ্ন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। উপরে বর্ণিত ফলাফল দৃষ্টে এ নির্বাচনের ফলাফলকে এক কথায় Mixed Bag Result বা মিশ্র ফলাফল বলা যেতে পারে।
এ নির্বাচনকে উভয় দলের নেতারাই খুব গুরুত্ব দেন। নির্বাচনের দিন এক টুইট বার্তায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন লেখেনÑ ‘Make your voice heard today. We know in our bones that democracy is at risk. Today is a defining moment for US democracy.’
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সমাবেশে ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলেন- ‘If you support the decline and fall of America then vote for the radical left, but if you want to stop the destruction of our country, then you must vote republicans in a giant red wave.’
রিপাবলিকানরা তাদের প্রচার-প্রচারণায় অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, গ্যাস, ইউটিলিটিসহ নিত্যপণ্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি; বর্ডার সিকিউরিটি ও পাবলিকন সেফটির মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিলেও ডেমোক্র্যাটরা মূলত গণতন্ত্র রক্ষা, ভোট ও গর্ভপাতের অধিকার এবং সোস্যাল সিকিউরিটি, মেডিকেয়ার, মেডিকেইড বেনিফিট ও জলবায়ু সংক্রান্ত ইস্যুকে প্রাধান্য দেন।
ডাইনিং টেবিলে খাবার (ডিম, দুধ, রুটি, কলা ইত্যাদি) থাকা ও গাড়িতে তেল ভরার বিষয়টি মার্কিন ভোটারদের প্রাত্যহিক জীবনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী মেসেজিং (Messaging) তাদের মধ্যে কাক্সিক্ষত আবেদন সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। দেশের মাটিতে বিপুল পরিমাণ এনার্জি সম্পদ (তেল, গ্যাস, কয়লা) মজুদ থাকা সত্ত্বেও, সেগুলো আহরণে গুরুত্ব না দিয়ে তেলের জন্য অন্য দেশের দুয়ারে ধর্ণা দেয়ার বিষয়টি ভোটাররা সুনজরে নেননি। তেল ছাড়া কেবল বাতাস ও সূর্যরশ্মিজাত (Windand & Solar) এনার্জি দিয়ে কীভাবে আমেরিকার মতো একটি বৃহৎ শিল্পোন্নত দেশ চলতে পারে, তা অনেকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকেছে।
তাছাড়া বহু ভোটার আমেরিকার দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে অবাধে বিদেশি নাগরিক ও ক্যান্টানল, হেরোইন, কোকেনসহ বিপুল পরিমাণ মাদক প্রবেশের ঘটনা এবং অপরাধ দমনে ডেমোক্র্যাটদের নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গীকে (Soft on Crime) সহজভাবে নেয়নি। এসব কারণে ডেমোক্র্যাটদের জনপ্রিয়তা বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে মনে করা হচ্ছে।
এ নির্বাচনে ট্রাম্প তার কাক্সিক্ষত ফল পেতে ব্যর্থ হওয়ায় দলে ইতোমধ্যে নানা কানাঘুষা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে হাউজ স্পিকারের পদ ও ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলের মনোনয়ন তিনি, না ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিস্যান্টিস পাবেন, তা নিয়ে ব্যাপক মতানৈক্যের আভাস দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠছে। স্পিকার পদে প্রতিনিধি পরিষদে মাইনরিটি লিডার কেভিন ম্যাকার্থির চাইতে ট্রাম্প নিউইয়র্কের কংগ্রেসওম্যান এলিস স্টেফানিকে অধিক পছন্দ করেন বলে জানা যায়।
সিনেট ও প্রেসিডেন্টের সমর্থনের অভাবে রিপাবলিকানদের পক্ষে কোন বিল পাস করা দুরূহ হবে। তবে তারা হাউজে বিভিন্ন Oversight Committee গঠন করে বাইডেন পরিবারের কথিত দুর্নীতি, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নাগিরক ও সেনা প্রত্যাহারে বিপর্যয় ও বর্ডার সিকিউরিটি রক্ষায় বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়ে তদন্তের নামে বাইডেন ও তার প্রশাসনকে নাজেহাল করতে প্রয়াসী হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে রন ডিস্যান্টিসের বাকযুদ্ধ আগামীদিনের মার্কিন রাজনীতিতে কুৎসিত ও কদর্য রূপ নিতে পরে, যা হবে বেশ তামাসাপূর্ণ।
লেখক : কলামিস্ট।