মার্কিন রাজনীতির হালহকিকত

বাহারুল আলম :

সম্প্রতি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পক্ষ থেকে পার্টির জাতীয় কনভেনশন আগামী বছরের ১৯ থেকে ২২ আগস্ট ইলিনয় রাজ্যের শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কনভেনশনে বিভিন্ন রাজ্য ও টেরিটরির জন্য ডেলিগেট নির্বাচন ছাড়াও সে বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে কারা পার্টির টিকেট পাবেন, সেটা ঘোষণা করা হবে। এর আগে ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ঐ দুই পদে মনোনয়নের জন্য প্রাইমারি নির্বাচন অনুষ্টিত হবে।

একাধিক মহল থেকে কনভেনশন নিউইয়র্কে অনুষ্ঠানরে দাবি তোলা হলেও, শেষ পর্যন্ত কনভেনশনের ভেন্যু হিসাবে Windy City হিসাবে পরিচিত শিকাগোকে বেছে নেয়া হয়েছে। ১৭৮৬ সালে শিকাগোর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলঙ্ককরী টর্নেডোর সূত্রে ঐ শহরকে Windy City নামে ডাকা হয়।

অপরদিকে একই উদ্দেশ্যে রিপাবলিকান পার্টির কনভেনশন আগামী বছরের জুলাই মাসের ১৫ থেকে ১৮ তারিখে উইসকনসিন রাজ্যর মিলওয়ার্কি শহরে অনুষ্ঠানের ঘোষণা করা হয়েছে। দলের প্রাইমারি নির্বাচন হবে ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে।

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কনভেনশনের স্থান ও তারিখ ঘোষণা করা হলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন গত ২৫ এপ্রিল। যদিও এই ঘোষণা জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছিল। বহু প্রতীক্ষিত এই ঘোষণা প্রদানে বিলম্বের কারণ হিসাবে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জাঁ পিয়ের জানান যে, বাইডেন বর্তমানে অন্যকিছুর চাইতে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে বিরাজমান বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে অধিক মনোযোগী রয়েছেন।

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে ঘোষণা প্রদানে বিলম্বের কারণে তিনি আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কীনা, সে বিষয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনার সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্টের স্ত্রী জিল বাইডেন অবশ্য তার স্বামীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে প্রবল আশাবাদ ও সর্বাত্মক সমর্থন ব্যক্ত করেন। তার ভাষার I am all for it. প্রথম মেয়াদের অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে তার দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মত পোষণ করেন।

ঘোষণা প্রদানে দেরির পেছনে বাইডেন তার শারীরিক সুস্থতা ও সামনের দিনগুলোতে দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও বৈদেশিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেটা পর্যবেক্ষণ করতে চান বলে কোন কোন মহল থেকে অভিমত প্রকাশ করা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি ৮০ বছর বয়সী প্রেসিডেন্টের বুকে ত্বকের ক্যান্সারের চিকিৎসার কথা শোনা গেছে। চিকিৎসার পর তিনি বর্তমানে ক্যান্সারমুক্ত বলে জানানো হয়েছে। কাকতালীয় হলেও প্রথম মেয়াদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণাও ২৫ এপ্রিল দেয়া হয়েছিল। সালটা ছিল ২০১৯।
বাইডেনের স্বাস্থ্য নিয়ে বিদ্যমান সংশয়ের প্রেক্ষাপটে হোয়াইট হাউজের জনৈক চিকিৎসক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বাইডেনকে পুরোপুরি সক্ষম (Healty vigorous and fit for the job) মর্মে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। এনবিসি নিউজ পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা যায়Ñ ৭০ ভাগ মার্কিন নাগরিক ও ৫১ ভাগ ডেমোক্র্যাট বাইডেন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন, সেটা চান না। অন্যদিকে ৬০ ভাগ মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের ক্ষেত্রে অনুরূপ মনোভাব পোষণ করেন।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অন্যান্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ইলিনয়ের গভর্নর জেবি প্রিটজকার, ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গেভিন নিউসম, নিউজার্সির গভর্নর ফিল মার্কি, সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স প্রমুখের নাম শোনা যাচ্ছে।

গভর্নর প্রিটজকার একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি (বিলিয়নেয়ার)। তিনি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হায়াৎ হোটেল চেইন মালিক পরিবারের একজন। তার অর্থবিত্তের পরিমাণ কমবেশি সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া পার্টির প্রগ্রেসিভ অংশের কাছেও তিনি বেশ জনপ্রিয় একজন নেতা। বাইডেনের বিকল্প হিসাবে তার সম্ভাবনা একেবারে কম নয় বলে কেউ কেউ মনে করেন। তাছাড়া বস্টনের মেরিঅ্যান উইলিয়ামসনও আরএফকে জুনিয়র প্রার্থী হবেন।

রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসাবে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্তের কথা সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত বছরের নভেম্বরে জানান দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসাবে তিনি ইতোমধ্যে একাধিক জনসভায় বক্তব্য প্রদান ছাড়াও যেসব রাজ্যে প্রথমদিকে প্রাইমারি নির্বাচন হবে (যেমন, আইওয়া, নিউ হ্যাম্পশায়ার ইত্যাদি), সেসব রাজ্যে গিয়ে দলীয় বেশ কিছু নেতার সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। তিনি তার রাজনৈতিক বেস ইভানজেলিকেল খ্রিষ্টান শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে তার প্রার্থিতার পক্ষে বেশ সাড়াও পাচ্ছেন বলে প্রতীয়মান হয়।

সরাসরি এখনো ঘোষণা না দিলেও অন্যান্যের মধ্যে ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিস্যান্টিস, নিউ হ্যাম্পশায়ারের গভর্নর ক্রিস সুনুনু, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন বলে শোনা যাচ্ছে। জাতিসংঘের সাবেক মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হ্যালি, ভারতীয়-আমেরিকান ব্যবসায়ী (Entrepreneur) বিবেক রামস্বামী এবং আরকান সাসের সাবেক গভর্নর আসা হাচিনসন ইতোমধ্যে তাদের প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছেন।

সাম্প্রতিক একাধিক জনমত জরিপে ট্রাম্প তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রন ডিস্যান্টিসের চাইতে বড় মাত্রায় এগিয়ে রয়েছেন। রিপাবলিকানদের ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ৪৬ ভাগ, ডিস্যান্টিস ৩১ ভাগ এবং অন্যান্যরা ১০ ভাগের নিচে রয়েছেন। মনোনয়ন লাভের দৌড়ে তিনি Front Runner, যদিও পরে এর পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এখন পর্যন্ত ট্রাম্প-ট্রেনের গতি অত্যন্ত বেগবান বলেই মনে হয়।

অর্থনীতি, বিশেষত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিরোধসহ আরো বেশ কিছু ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের তেমন সাফল্য না থাকলেও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সমর্থন দান, ব্যাংকিং ক্রাইসিস এড়ানো, নারীর প্রজনন অধিকার (Reproductive Rights/Services) এবং তাদের ‘আমার শরীর আমার মর্জি’ (My Body, My Choice) স্লোগানের স্বপক্ষে ও মেডিকেয়ার-মেডিকেইড এবং সোশ্যাল সিকিউরিটি বেনিফিট রক্ষায় বাইডেনের দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা বিপুলসংখ্যক মার্কিন নাগরিকের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।

তাছাড়া, ভোটিং রাইটস, জলবায়ু পরিবর্তন ও অবকাঠামো উন্নয়নে বাইডেনের অবস্থানের পেছনেও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে। রিপাবলিকান তথা ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে এসব ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে বলে জনগণকে জানানো হবে। ব্যাপক জনগোষ্ঠী ডেমোক্র্যাটদের এহেনর প্রচারণায় আস্থা রাখেন বলে প্রতীয়মান হয়। রিপাবলিকানরা অবশ্য এসব প্রচারণাকে অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। অপরদিকে রিপাবলিকানদের নির্বাচনী Playbook-এ, অর্থনীতি, বর্ডার, ক্রাইম ক্রাইসিস ও দেশের ভূগর্ভস্থ তেল-গ্যাস উত্তোলনের মাধ্যমে এনার্জি স্বাধীনতা অর্জনকে প্রাধান্য দেয়া হবে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে চীন-রাশিয়ার নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা (New Global Order) তৈরির চেষ্টার বিপরীতে বাইডেনের কথিত দুর্বল নেতৃত্বের বিষয়টিও প্রচারণায় গুরুত্ব পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে, যা হবে দেশের জন্য অগৌরবজনক ও মর্যাদাহানীকর।

মার্কিন জনগণের মধ্যে বাইডেন নিজেকে একজন ধীরস্থির ও সজ্জন রাজনীতিক হিসাবে উপস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছেন। অপরদিকে টাম্প একজন বিশৃঙ্খল চরিত্রের (Chaotic) ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তার দেয়া টুইট পড়ে অনেকের মন্তব্য- You can not make sense out of Nonsense. অধিকাংশই ওফরড়ঃরপ বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন।
বর্ণিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচনে বাইডেনের বিজয়ের সম্ভাবনা একেবারে অনুজ্জ্বল নয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।

লেখক : কলামিস্ট।