`মাল্টি ক্লায়েন্ট’ জরিপের ফাঁদে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান

ঢাকা : মাল্টি ক্লায়েন্ট’ জরিপের ফাঁদে আটকা পড়েছে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ফাইলটি। অভিযোগ আছে, সরকারের ভেতর ও বাইরে বৈশ্বিক জ্বালানি রাজনীতির শিকার একটি সিন্ডিকেটের ধারণা ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে’ ছাড়া সমুদ্রে তেল-গ্যাসসহ সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধানে যাওয়া বৃথা।

এ সিন্ডিকেটে রয়েছেন কিছু পেশাজীবী আমলা, দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী চক্র ও এ খাতের বিশেষজ্ঞ একটি মহল। অথচ বাংলাদেশের পাশের দুটি দেশ মিয়ানমার ও ভারত ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ সার্ভে ছাড়াই নিজ নিজ সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান শুরু করেছে এবং বিপুল পরিমাণ গ্যাসের সন্ধানও পেয়েছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমানাসংলগ্ন একাধিক বøক থেকে গ্যাস উত্তোলনও শুরু করছে।

জানা গেছে, শিল্প, বাণিজ্যসহ সব খাতে চলছে জ্বালানির জন্য হাহাকার। ঘাটতি মেটাতে ৪ গুণ বেশি দামে গ্যাস আমদানি হচ্ছে। কিন্তু দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে গতি নেই। স্থলভাগে কিছু কাজ হলেও সমুদ্রে একবারেই নজর নেই। বছরের পর বছর ঝুলে আছে দেশের বিশাল সমুদ্রসীমায় খনিজসম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রুত ও ব্যাপক শিল্পায়নের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো প্রাথমিক জ্বালানিস্বল্পতা।

জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারত বঙ্গোপসাগরে তাদের সীমানায় তেল-গ্যাস আবিষ্কারের পাশাপাশি উত্তোলনও করছে।

সেখানে বাংলাদেশ গত ৪ বছর ধরে একটি জরিপ কাজ শুরুই করতে পারেনি। দু’বার দরপত্র ডেকেও নির্বাচিত কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া যায়নি। সমুদ্রের বøকগুলোতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে না। এর আগে কয়েক দফা আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেও পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকায় ভালো সাড়া মেলেনি।

গভীর সমুদ্রে জরিপের জন্য জাহাজ কেনা বা ভাড়ার বিষয়টিও দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ। তারপর প্রায় ৭ বছর কেটে গেছে।

আর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই। তারপর কেটে গেছে সাড়ে ৪ বছরের বেশি। এতদিন ধরে বাংলাদেশ শুধু ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ সার্ভের পেছনেই ছুটে চলেছে।

জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি এখনই সিদ্ধান্ত নেয় ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ সার্ভে করবে, তাহলেও এর সব আনুষঙ্গিকতা শেষ করতে অন্তত ২ বছর লাগবে। এরপর যে কোম্পানিকে দিয়ে সার্ভে করাবে, তারা নিজ খরচে সার্ভে করবে ঠিকই। কিন্তু অন্তত ১৫ বছর প্রাপ্ত সব তথ্যের মালিকানা থাকবে তাদের। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাও সেই তথ্য না কিনে ব্যবহার করতে পারবে না।

পেট্রোবাংলার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, যে কোম্পানি সার্ভে করবে তারা আগ্রহী বিদেশি কোম্পানির কাছে তাদের প্রাপ্ত তথ্য বিক্রি করবে। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো কোম্পানি সম্ভাবনাময় মনে করলে শুধু তখনই তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় আসতে পারে।

এ ক্ষেত্রে যদি কোনো কোম্পানি আসেও সরকারের সঙ্গে তাদের সমঝোতা এবং চুক্তি অনুযায়ী কাজ শুরু করতে লাগবে আরও অন্তত ৫ বছর। অর্থাৎ সরকারের ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ সার্ভের এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জ্বালানি অনুসন্ধানের বাস্তব কাজ শুরু করতে অন্তত ৭ বছর লেগে যাবে।

পেট্রোবাংলার অপর একটি সূত্র জানায়, ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ সার্ভে ছাড়া মিয়ানমার ও ভারতের পদ্ধতি অনুসরণ করলে ১ বছরের মধ্যে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা সম্ভব।

এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে তাদের ২০টি বøকে ১৩টি আন্তর্জাতিক কোম্পানির মাধ্যমে পিএসসি চুক্তি করে এ-৪, এ-৫, এ-৬, এ-৭, এ-৯, এডি-২, এডি-৩, এডি-৫, এডি-৭, এডি-১১, এম-১১, এম-১২, এম-১৩, এম-১৪ বøকে টুডি এবং থ্রিডি সিসমিক সার্ভে ও ক‚প খননের মাধ্যমে চারটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে।

তার মতে, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে একটি কোম্পানি দুটি উন্নয়ন ক‚পে নতুন গ্যাসের স্তর (৪৮০০ মিটার) আবিষ্কার করেছে যা বাংলাদেশের অগভীর, গভীর সমুদ্র ও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও প্রাপ্তিকে আরও সম্ভাবনাময় করেছে।

পেট্রোবাংলার এ কর্মকর্তা বলেন, ১৯৮৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে ১০টি বøক ৯টি বিদেশি কোম্পানিকে প্রদান করে এবং দুটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে।

২০১৩ সালে মিয়ানমার ৩০টি অফশোর (গভীর সমুদ্রে) বøকে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান ও উৎপাদন কার্যক্রমের পদক্ষেপ গ্রহণ করে চারটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। মিয়ানমার এখন এ প্রক্রিয়াকে আরও বড় পরিসরে শুরু করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাও তেল-গ্যাসের জন্য সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র। তাদের মতে, ১৯৬৯-১৯৭৬ সাল পর্যন্ত জাপান, জার্মান এবং মিয়ানমারের পৃথক তিনটি কোম্পানি বঙ্গোপসাগরে সিসমিক সার্ভে এবং অনুসন্ধান ক‚প খনন করেছে।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ৮টি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ৩১ হাজার লাইন কিলোমিটার ভূকম্পন জরিপ এবং সাতটি অনুসন্ধান ক‚প খনন করে একটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করেন। তাদের মতে বঙ্গবন্ধুর এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে সমুদ্রের চিত্র পাল্টে যেত এত দিনে।