
মুহম্মদ শামসুল হক :
মহান আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা সমভিব্যাহারে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের কাছ থেকে মাহে রমজানের পবিত্র রহমতের অধ্যায় ১ এপ্রিল শনিবার বিদায় নিচ্ছে এবং ২ এপ্রিল রোববার থেকে মাগফিরাতের অধ্যায় সূচিত হচ্ছে। মাগফিরাত প্রসঙ্গে আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা বিবি হাওয়ার (আ.) বিষয়টি আলোচনায় অগ্রাধিকার পায়। পবিত্র কোরআনের প্রথম অধ্যায়ের সুরা বাকারার ৩০ থেকে ৩৫ নং আয়াতগুলোতে আদম সৃষ্টির প্রসঙ্গ, আগুনের তৈরি শয়তানের মাটির তৈরি আদমকে সেজদা না করার আল্লাহর আদেশ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান ও অভিশপ্ত হওয়ার ঘটনা এবং আদম ও হাওয়াকে বেহেশতে স্থান দেওয়া এবং নিষিদ্ধ বৃক্ষের নিকট না যাওয়ার হুকুম বর্ণিত হয়েছে। অথচ পরবর্তী সময়ে অভিশপ্ত শয়তানের প্ররোচনায় হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) আল্লাহর আদেশ অমান্য করে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে বড় ধরনের অপরাধ করলেন। তার শাস্তিস্বরূপ তাদের শরীর থেকে বেহেশতি লেবাস খসে পড়ল, পরস্পরের গোপনীয় অঙ্গ উন্মুক্ত হয়ে গেল।
তাঁরা গাছের পাতা-লতার সাহায্যে লজ্জা নিবারণ করলেন এবং বেহেশত থেকে বহিষ্কৃত হয়ে মাশরিক ও মাগরিবে ভূপতিত হলেন। এরপর হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে একাধারে কয়েক শ বছর আল্লাহর নিকট নিজেদের অপরাধ মার্জনার জন্য কান্নাকাটি করলেন। পরিশেষে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর অছিলায় দয়াময় আল্লাহ তায়ালা তাঁদের অপরাধ মার্জনা করলেন এবং আল্লাহর অপার অনুগ্রহে দীর্ঘকালের বিরহ-বিচ্ছেদের পর হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) আরাফার ময়দানে পুনর্মিলিত হলেন। এর থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, আল্লাহর আদেশ অমান্য করার পর শয়তান অনুতপ্ত না হয়ে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করায় চিরঅভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়েছে। পক্ষান্তরে শয়তানের প্ররোচনায় হজরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া (আ.) নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়ে জঘন্য পাপ করা সত্ত্বেও অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে এবং তওবা-আস্তাগফিরুল্লাহসহ তাঁরা আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করায় মহান আল্লাহ তাঁদের মাগফিরাত বা ক্ষমা করলেন এবং হজরত আদমকে (আ.) নবুয়ত দান করলেন। নিজেদের পাপরাশি এবং কৃত অপরাধের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহর কাছ থেকে হজরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়ার (আ.) মাগফিরাত বা ক্ষমালাভের ঘটনা আদম সন্তান-সন্ততিদের জন্য এক অনুকরণীয়, অনুসরণীয় এবং দৃষ্টিগ্রাহ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।
পরকালীন আজাব-গজব থেকে অব্যাহতি এবং আমাদের পরম আরাধ্য বেহেশত লাভের প্রশ্নে বিশ্বপ্রতিপালক মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমত ছাড়া আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে পরিচিত মানুষের বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। অথচ পবিত্র মাহে রমজানের রহমতের অধ্যায়টুকু আমরা কতটুকু কাজে লাগিয়েছি তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী হবে। তা সত্ত্বেও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হিসেবে আমরা মহান আল্লাহর মাগফিরাত কামনা করছি। মাগফিরাত প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের কয়েকটি সুস্পষ্ট ঘোষণার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সুরা হাশরের একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ইন্নাল্লাহা শাদীদুল ইক্বাব (আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর)। আর সুরা মায়েদার একটি আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ওয়াল্লাহু আজিজুন জুনতিকাম (আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী প্রতিশোধ গ্রহণকারী)। আবার পবিত্র কোরআনের অন্যত্র জাহান্নামকে বসবাসের জন্য অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সুরা ও আয়াতে আল্লাহর অপরিসীম রহমতের পাশাপাশি কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারিও উচ্চারিত হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে গিবত বা পরচর্চাকে জেনা বা ব্যভিচারের চেয়ে এবং ফিতনা বা সংঘাতকে কাতল বা হত্যার চেয়েও ভয়াবহ পাপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলিম বিশ্বে এবং পারিবারিক-সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে উভয় অপরাধই স্থায়ী পালঙ্ক পেতে বসেছে। গিবত ছাড়া আমাদের ভুক্ত খাদ্য হজম হয় না আর ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ ও বিবাদ-বিসম্বাদ ছাড়া বর্তমান মুসলিম বিশ্ব অচল। প্রতিদিনই নিত্যনতুন সংঘাতে মুসলিম বিশ্ব জর্জরিত হচ্ছে এবং ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মতানৈক্য অভিনব ফিতনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে জ্বালানি বা ইন্ধন হিসেবে কাজ করছে। তাই প্রাণান্ত প্রচেষ্টায়ও আমরা উভয় অপরাধ থেকে অব্যাহতি পাচ্ছি না।
পবিত্র রমজানের মাগফিরাতের অধ্যায়ই ইসলামের আদর্শচ্যুত মুসলমানদের গিবত-ফিতনাসহ সকল অপরাধের হাত থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস, ইনশা আল্লাহ। আবার সাওম পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি। আত্মশুদ্ধির অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে যাবতীয় পাপ ও অন্যায় থেকে মুক্তিলাভ। এ ক্ষেত্রে পরচর্চায় মশগুল না থেকে নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাপ-পুণ্যের মাত্রা নির্ধারণপূর্বক আত্মশুদ্ধির কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পবিত্র রমজানে অতিভোজনের স্থলে অন্যদের খাওয়ানোর তাগিদ রয়েছে। তাই মুখরোচক ইফতারি এবং রসনাপূজা পরিহার করে ব্যয় সাশ্রয়ের মাধ্যমে সঞ্চিত অর্থে দুঃখীদের দুর্দশা লাঘবে সক্রিয় হতে হবে। পরচর্চা, বাকচাতুর্য বা বাকবাগিশতা সর্বাংশে বর্জন করে চুপ থাকতে এবং মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। সদাসর্বদা আস্তাগফিরুল্লাসহ বিভিন্ন তসবি তেলাওয়াত করতে হবে।
যাহোক, ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় এবং ষড়্্রিপু ও শয়তানের প্ররোচনায় আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছায় অসংখ্য পাপাচারে জড়িয়ে পড়ি। বর্তমানে অপরের সম্পদ লুণ্ঠনের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা মানুষকে নরখেকো বাঘের মতো তাড়া করছে। মনুষ্যত্ববোধের নির্বাসন এবং দানবীয় শক্তির উত্থানের ফলে পাপপঙ্কিলতার সাগরে বিশ্ববাসী হাবুডুবু খাচ্ছে। পররাজ্য দখলের ঘৃণ্য প্রচেষ্টার ফলে বিশ্বজুড়ে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। জগৎজুড়ে ধনী-নির্ধনের ব্যবধান গগনচুম্বী হচ্ছে। প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরে মাৎস্যন্যায় অবস্থা বিরাজ করছে। মূলত স্বার্থের ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত বর্তমান বিশ্বচরাচরে বিশ্বমুসলিমকে পার্থিব যাবতীয় অপরাধমুক্তির সুবর্ণ সুযোগ দান করে পবিত্র রমজানের মাগফিরাতের অধ্যায়। বিশ্ববাসীর শাশ্বত জীবনবিধান পবিত্র কোরআনে পরম করুণাময় আল্লাহ বান্দার অপরাধ মার্জনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তাই নিজেদের যাবতীয় অপরাধের জন্য অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে এবং তওবা-ইস্তেগফারসহ আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আমরা বিশ্ববিধাতার মাগফিরাত প্রত্যাশা করতে পারি। কারণ, আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকারকারী কাফের, আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারকারী এবং বান্দার হক আত্মসাৎকারী ছাড়া অন্য সকল অপরাধীকে ক্ষমা প্রদানের প্রতিশ্রুতি মহান বিশ্বপ্রতিপালক পবিত্র কোরআনে প্রদান করেছেন।
স্মর্তব্য, আমরা সর্বক্ষণ নিজেদের পোষ্যদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। অথচ যেসব বাবা-মা নিজেদের সর্বত্র উজাড় করে দিয়ে আমাদের মানুষ করেছেন এবং লোকান্তরিত হয়েছেন, তাদের কথা স্মরণ করার সুযোগ আমাদের তেমন হয় না। নিকট ভবিষ্যতে আপনি এবং আমাকেও একই পরিণতি বরণ করতে হবে। সর্বাধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদধন্য আমাদের সন্তান-সন্ততিরা তাদের পোষ্যদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকবে যে আপনি আর আমাকে স্মরণ করা সময়ের অপচয় হিসেবে গণ্য হবে। তাই জীবদ্দশায় নিজ নিজ পরকালীন যাত্রাপথ সুগম করার অনুরোধ রইল।
উপসংহারে গোনাহর পাহাড় শিরোধার্য করে আমরা আল্লাহর মাগফিরাত লাভের প্রত্যাশায় পবিত্র রমজানের বাদবাকি সময় ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতে সক্রিয় থাকব। গিবত বা পরচর্চা, ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি সর্বাংশে বর্জন করব; ধৈর্য ধারণে সচেষ্ট হব; অন্যের প্রতি অহেতুক বিষোদ্গার কিংবা অপরের অমঙ্গল কামনা পরিহার করব এবং ভুরিভোজন বা রসনাপূজার স্থলে রোজাদার ও ক্ষুধার্তদের আপ্যায়নে সক্রিয় হব। জীবনাচরণে যথাসাধ্য কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে সাশ্রয়কৃত অর্থে গরিব-দুঃখীর দুর্দশা লাঘবে সক্রিয় হব। মহান বিশ্বপ্রতিপালক আমাদের সহায় হোন। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
২৮ মার্চ ২০২৩