প্রণবকান্তি দেব : মিশুর জন্য কাঁদছে সিলেট। থামছে না প্রিয়জনের মনের ভেতর বয়ে চলা শোকের ঝড়। স্মৃতি হাতড়ে আকুলি বিকুলি চলছেই। শোক ব্যানারে ছেয়ে গেছে তাঁর পদচারণায় একদিন মুখর থাকা প্রাঙ্গণগুলো – কবি নজরুল অডিটোরিয়াম, শহিদমিনার প্রাঙ্গণ, নজরুল একাডেমি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে অতীতের নানা ছবি, নানা স্মৃতি। শোকস্তব্দতা সবখানে। নীরব ক্রন্দন চলছে রায়নগরের বাড়িজুড়ে। সকাল-সন্ধ্যা ধূলো উড়িয়ে চলা তাঁর পথের বাঁকে কেবলই বিষন্নতা, কেবলই হাহাকার এখন। সাংস্কৃতিক সহকর্মী, অনুজ, অগ্রজ, সুহৃদ-স্বজন কেউই মেনে নিতে পারছেন না তাঁর এমন চলে যাওয়া। রাত ৯ টা অবধি মঞ্চে সজীব থাকা মানুষটি ভোর বিহানে লাশ হয়ে গেলেন!
মিশফাক আহমদ চৌধুরী মিশু। সিলেটের সামাজিক -সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক পরিচিত নাম। নব্বই দশকের জনপ্রিয় টিভি মডেল। পরবর্তীতে কয়েক দশক ধরে সিলেটের মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো অভিনেতা, সংগঠক। প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীর পরিচয়ও আছে তাঁর সমানভাবে। ক্রিকেটার ছিলেন কৈশোর-তারুণ্যে। গত ৫ নভেম্বর ভোরে আকস্মিকভাবে ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে। স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে রেখে। তারপর থেকেই সিলেটজুড়ে নেমে আসে শূন্যতা। মৃত্যু ভয়ও পেয়ে বসেছে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটানো প্রিয়জনদের মধ্যে।
কেউ কেউ বলছেন, এই শহরের সবচেয়ে স্মার্ট লোক ছিলেন মিশফাক আহমদ মিশু, কেউ বলছেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক চিন্তার সংগঠক ছিলেন তিনি। কারও মতে আবার যেকোনো সংকটে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানবিক এক মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁকে হারিয়ে কাঁদছে সিলেট!
অগ্রজরা বলছেন, মিশুকে হারিয়ে হারিয়েছেন বিশ্বস্ত হাত, কোনো কোনো অনুজ বলছেন, তাদের আইকন ছিলেন ‘মিশু ভাই’। শুভবোধের যাত্রায় সহযোগী ছিলেন অনেকেরও। তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
জাসদের মিছিল, শহীদ মনির-তপন-জুয়েল স্মরণ আন্দোলন, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট, লিটল থিয়েটার, নজরুল একাডেমি, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি সিলেট, সিলেট ক্লাব- এমন অসংখ্য জায়গায় আলো ছড়াতে ছড়াতেই যেন ধপ করে নিভে গেল মিশুর জীবন প্রদীপ।
করোনা সংকটকালের সেই ‘কলের গাড়ির’ নায়কের এমন অকাল, অবেলায় মৃত্যুতে সহযোদ্ধারা বার বার বলছেন, ‘এভাবে চলে যাওয়া ঠিক হয়নি বন্ধু। কারও অনুতাপ, ‘আর দেখা হবে না মিশু ভাই’।
মিশুর জন্য এলিজিও রচনা করেছেন কেউ কেউ। সিলেটের বিশিষ্ট ছড়াকার অজিত রায় ভজন লিখেছেন- ‘কেমন যেনো শূন্য লাগে তোমায় ছাড়া সবই,/কার্তিকে আজ রঙ হারালো পুব আকাশে রবি।’
শুধু কি সিলেটে বিলাপ চলছে? না, নিউইয়র্কে থাকা তাঁর পরিবার স্বজন, লন্ডন, কানাডাসহ পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মিশুর বন্ধু-বান্ধব, শুভার্থীরাও করছেন একই বিলাপ। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় ভাসছে একূল-ওকূল দুকূল।