বাংলাদেশে জন্ম নয় তার। মানব সেবার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৬০ সালে এসেছেন এ দেশে। বছর বাদে ফেরার কথা থাকলেও আর ফেরা হয়নি তার। প্রকৃতি আর মানুষের ভালোবাসা আকৃষ্ট করেছে তাকে। তাই তো প্রায় ৫৭ বছর ধরে আছেন এ দেশে। ভিনদেশি হলেও মনে-প্রাণে তিনি বাঙালি। মরতেও চান এ দেশে। তার শেষ ইচ্ছাÑ তাকে যেন কবর দেওয়া হয় বাংলার মাটির গন্ধের মধ্যে। সে জন্য দরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্বÑ এটাই চেয়েছিলেন তিনি। এ দেশে তার অবদানের কথা ভাবলে তার চাওয়া যেন অতি সামান্য। সামান্য বটে, তবুও যেন কোনোভাবেই পূরণ হচ্ছে না তার চাওয়াটা।
গল্পটা ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হল্টের। ইংল্যান্ডের হ্যালেন শহরে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ৩০ বছর বয়সে বরিশাল অক্সফোর্ড মিশন হাসপাতালে আসেন সেবীকা হিসেবে। তখন থেকে আজ অবধি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মানব সেবায় বিলিয়ে দিয়েছেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। নিজ দেশের মায়া ত্যাগ করে আপন করে নিয়েছেন এ দেশের মানুুষকে। দিয়েছেন অফুরন্ত ভালোবাসা। শুধু দিয়েছেন তা বলা যাবে না, পেয়েছেনও বটে। তাই তো দীর্ঘ ৫৭ বছর পার করেছেন এই বাঙালিদের টানে। ভালোবেসেছেন বাঙালিত্বকে, বাংলা ভাষাকে ও দেশের মানুষকে। মূল্য কী? কিছু নেই বললেই চলে। ব্রিটিশ নাগরিক হওয়াতে ৭০ পাউন্ড বা ৬ হাজার টাকা পান মাসিক ভাতা। তাও বিলীয়ে দেন অসহায়দের মধ্যে।
কোনো রক্তের বন্ধন নেই। তবুও মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এ দেশের সঙ্গে। কেন এত মায়া? জানতে চেয়েছিলাম তার মুখ থেকে। তিনি বলেন, এ দেশের মাটি, মানুষ ও তাদের ভালোবাসা আমায় মুগ্ধ করে। যার ফলে আর ফিরে যাওয়া হয়নি। এখন আমার সংসার বলতে বাঙালিরাই। যতটুকু পারি সেবা করে যাচ্ছি। মৃত্যুর আগ অবধি আমি এ দেশের মানুষের সেবা করতে চাই। আমার ইচ্ছাÑ আমি যেন বাংলার মাটিতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি।
দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখন আশায় আছি। আমার বয়স এখন ৮৭ চলছে। জানি না আর কত দিন বাঁচব। সবার কাছে আমার অনুরোধ, আমার মৃত্যুর আগে এ দেশের নাগরিকত্বের স্বাদ যেন পেতে পারি। যেন শান্তিতে সবাইকে বিদায় বলতে পারি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্ম হয়। তার ঠিক ৪১ বছর আগে একই দিনে জন্ম হয় লুসি হল্টের। বাংলার ইতিহাসে তার এই জন্ম দিনটাকে স্বর্ণাক্ষরে লিখতে পিছপা হননি তিনি। রেখেছেন অনবদ্য ভূমিকা। তার চোখজুড়ে রয়েছে ’৭১ এর স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে আহতদের সেবা দেওয়া ছিল তার অন্যান্য দৃষ্টান্ত। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে আজ। তবুও মেলেনি কোনো যথার্থ স্বীকৃতি। এ নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই তার। তবে ইচ্ছা একটাই। দ্বৈত নাগরিকত্ব।
সবার আড়ালে থাকা লুসি হল্টকে বিগত বছরের শেষের দিকে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরেন সাংবাদিক অপূর্ব অপু। যেখান থেকে উঠে আসে তার দুটি দাবি। ১. দ্বৈত নাগরিকত্ব। ২. ভিসা নবায়নের ৩৮ হাজার টাকা মওকুফ, যা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছিলেন সে সময়ের দায়িত্বরত জেলা প্রশাসক ডক্টর গাজী মো. সাইফুজ্জামান। কিছুটা পদক্ষেপ ও নিয়েছিলেন তিনি। ফরম পূরণ করে পাঠিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এ নিয়ে লেখালেখি ও হয়েছিল বেশ কয়েকটা জাতীয় পত্রিকায়। তবুও সুরহার দেখা মেলেনি আজো। দৈত্ব নাগরিকত্ব পাননি। পাননি কোনো মওকুফ আর্থিকভাবে। এ ঘটনার প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেছে, যোগ দিয়েছেন নতুন জেলা প্রশাসক।
খোঁজ করেছিলাম। কথা বলেছিলাম বর্তমান জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ এগুলো দেখে থাকে। দ্বৈত নাগরিকত্বের ফরমের নির্দিষ্ট শর্তাবলি পূরণ করে আবেদন করলে একটা গোয়েন্দা রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়। তদন্ত শেষে সরকার যদি মনে করে রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের স্বার্থে তার নাগরিকত্ব প্রদানে কোনো স্বার্থ পরিপন্থী হবে না। তাহলেই তার দৈত্ব নাগরিকত্ব পেতে আর কোনো আইনি জটিলতা থাকবে না। দৈত্ব নাগরিকত্বের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের করার কিছু নেই।
বিগত জেলা প্রশাসকের আশ্বাসের কথা তুলে ধরলে তিনি বলেন, তিনি একটি ফরম পূরণ করে পাঠিয়েছিল, শুনেছি। কিন্তু এর কোনো অনুলিপি আমি পাইনি। তবে মন্ত্রণালয়ের ইমিগ্রেশন-৪ এ খোঁজ নিলে কিছু জানা যেতে পারে। আমাদের এখানে করার কিছু নেই। কেউ এ উদ্যোগ নিলে আমরা অবশ্যই সেখানে সহযোগিতা করব।
মুক্তিযুদ্ধের নিভৃতচারী অবদানকারী লুসি হল্টের দ্বৈত নাগরিকত্ব পেতে নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাকে। বিভিন্ন জনের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পেরিয়ে গেছে একটি বছর। তবুও মিলছে না কোনো হাল। লুসি হল্টের কাছে দ্বৈত নাগরিকত্ব যেন আজ একটি দুঃস্বপ্ন। এর এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সাংবাদিক অপূর্ব অপু এবং দীপু হাফিজুর রহমানসহ আরো বেশ কয়েকজন। ইতোমধ্যে তারা মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদনও করেছে।
মানবকল্যাণে নীরবে কাজ করে যাওয়া ব্রিটিশ এই নারী পরিচিতি পেতে চায় একজন বাঙালি নারী হিসেবে। সবুজ শ্যামলে ভরা প্রকৃতি ও মানুষের ভালোবাসায় পার করে দিতে চায় জীবনের বাকিটা সময়। চিরনিদ্রায় যেতে চায় এই বাংলার মাটিতে।
মহিলা কর্মকর্তাদের জন্য চালু হচ্ছে ড্রেসকোড
প্রশাসনে উইমেন নেটওয়ার্কের জরিপ শেষ পর্যায়ে
সিভিল সার্ভিসে কর্মরত মহিলা কর্মকর্তাদের জন্য শিগগির ড্রেসকোড হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে মতামত নিতে একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) উইমেন নেটওয়ার্ক। এটি মহিলা কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠন। যার সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম, এনডিসি।
সূত্র জানায়, এ বিষয়ে নির্ধারিত একটি ছকে প্রয়োজনীয় মতামত নিতে সম্প্রতি প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠি দিয়েছেন বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের উপদেষ্টা সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের সচিব বেগম আকতারী মমতাজ। চিঠি পাওয়ার পর সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা তাদের মতামত দেয়া শুরু করেছেন। ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মতামত নিয়ে জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। এরপর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে সমন্বিত প্রস্তাবটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ে জমা দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের উপদেষ্টা সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের সচিব বেগম আকতারী মমতাজ গত ২৫ জানুয়ারি বলেন, বেশ কিছুদিন আগে তিনিই প্রস্তাবটি তাদের সংগঠনের সভায় উপস্থাপন করেছিলেন। এরপর সেটি গৃহীত হয়। পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাবস্থায় ড্রেসকোড চালু করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে ডিও লেটার দেন। মাঠ প্রশাসনেও চিঠি দেয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। সবার কাছ থেকে অনেক সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি, সরকার বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার মতামত বিবেচনায় নিয়ে বিসিএস মহিলা কর্মকর্তাদের জন্য শিগগির ড্রেসকোড ঘোষণা করবে।
এ দিকে প্রশাসনে কর্মরত বেশির ভাগ কর্মকর্তা প্রস্তাবটিকে খুবই সময়োপযোগী উদ্যোগ বলে সাধুবাদ জানিয়েছেন। কেউ কেউ একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন, এটি আরও অনেক আগে হওয়া উচিত ছিল। একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘যখন সচিবালয়ে লিফটে উঠি তখন আমার ও দর্শনার্থীর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। এমনকি পরিচিতি জানার সুযোগ না থাকায় সাধারণ কর্মচারীও আমাকে তার মতো একজন ভাবতে থাকলে ওই সময় কিছু বলার থাকে না। এ রকম বিব্রতকর অবস্থা সব স্থানে কমবেশি হচ্ছে। কিন্তু যদি ড্রেসকোড থাকত তাহলে এমন সংকট তৈরি হতো না।’
জরিপ সংশ্লিষ্ট ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশের জনগণ ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি অগ্রসর চিন্তা-চেতনাকে ধারণ ও লালন করে আসছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সব সামাজিক আন্দোলনে নারী-পুরুষ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের জনগণ ধর্মনিরপেক্ষতা, পরমতসহিঞ্চুতা ও সহমর্মিতার মূল্যবোধে লালিত। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারও বদ্ধপরিকর। এ ছাড়া ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, সিভিল সার্ভিসে পুরুষ কর্মকর্তাদের জন্য আনুষ্ঠানিক ও দাফতরিক ড্রেসকোড নির্ধারিত আছে। পরবর্তী সময়ে মহিলা কর্মকর্তারা সিভিল সার্ভিসে যোগদান করলেও তাদের ড্রেসকোডের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে তাদের (মহিলা কর্মকর্তা) সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ অবস্থায় মহিলা কর্মকর্তাদের জন্য ড্রেসকোড না থাকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিধেয় পোশাক সম্পর্কে তারা দ্বিধান্বিত থাকেন। এ কারণে ইদানীং তাদের পোশাকে বিভিন্ন ধারা লক্ষ করা যায়।
সরকারি দফতরে মহিলা কর্মকর্তাদের জন্য নির্দিষ্ট ড্রেসকোড না থাকায় ব্যক্তিগত রুচি অনুসারে তারা পোশাক পরিধান করে থাকেন। এতে করে অনেক সময় কর্মকর্তাদের ব্যক্তিত্ব, পরিচিতি ও পেশাদারিত্ব যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় না। প্রসঙ্গত, ইতোমধ্যে বিভিন্ন বাহিনীতে এবং পুলিশ সার্ভিসে বেশ কিছুমহিলা কর্মকর্তা যোগদান করেছেন। তারা বাহিনীর ও সার্ভিসের নির্ধারিত পোশাক পরিধান করছেন। এর ফলে তাদের সমস্যা হচ্ছে না।
ড্রেসকোডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, কর্মক্ষেত্রে মহিলা কর্মকর্তাদের ব্যক্তিত্ব, পরিচিতি ও পেশাদারিত্ব যাতে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় সে জন্য সুনির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিক এবং দৈনন্দিন দাফতরিক পোশাক থাকা প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্য ও চিন্তা সমীচীন কি না সে বিষয়ে অভিমত যাচাইয়ের জন্য বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
মিশে যেতে চাই এ বাংলার মাটিতেই
ইংল্যান্ডের হ্যালেন শহরে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ৩০ বছর বয়সে বরিশাল অক্সফোর্ড মিশন হাসপাতালে আসেন সেবিকা হিসেবে। তখন থেকে আজ অবধি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মানব সেবায় বিলিয়ে দিয়েছেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। নিজ দেশের মায়া ত্যাগ করে আপন করে নিয়েছেন এ দেশের মানুষকে