মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাস্তবায়ন : সাম্প্রতিক ভাবনা

ম আমিনুল হক চুন্নু :

স্বাধীনতা মানে শুধু পরাধীন দেশকে মুক্ত করা নয়। স্বাধীনতা মানে দেশের সার্বিক উন্নতি-অগ্রগতি সমুন্নত রাখা। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, হানাহানি, লুটতরাজ নিয়ন্ত্রণ করা। বঙ্গবন্ধু সে লক্ষ্যেই বাঙালিকে আহ্বান করেছিলেন ৭ মার্চের ভাষণে। স্বাধীন দেশে রাজনীতি মানে যাচ্ছেতাই করা নয়। সব নাগরিকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ভোটাধিকার, কথা বলার অধিকার নিশ্চিত করা। ইতিহাস মুছে দেওয়ার প্ায়তারা নয়; সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা। সর্বোপরি জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়াই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

স্বাধীনতার চেয়ে প্রিয় কোনো শব্দ নেই। এ শব্দটির উচ্চারণে শরীরে আনন্দের শিহরণ বয়ে যায়। এই আনন্দ একেকজনের কাছে একেক রকম। কেউ স্বাধীনতা উপভোগ করে গলা ছেড়ে মুক্তির গান গেয়ে। কেউ ভরদুপুরে শান-বাঁধানো ঘাটে পা ভিজিয়ে কবিতা পড়ে। কেউ একপশলা বৃষ্টিতে ভিজে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। স্বাধীনতা মানে মুক্তি। স্বাধীনতা মানে লাল-সবুজের পতাকা হাতে দুরন্ত গতিতে কিশোরের ছুটে চলা। স্বাধীনতা মানে শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার শব্দের ঘুঙুর।

মনীষীরা স্বাধীনতার সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। দার্শনিক প্লেটো বলেছেন, ‘স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গৌরব। একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই স্বাধীন মানুষেরা বসবাস করতে ভালোবাসে।’ এ সম্পর্কে রুশোর উক্তি হচ্ছে, ‘যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে স্বাধীনতা নেই।’ শিলার বলেছেন, ‘স্বাধীনতা যেখানে সীমাহীন, আনন্দও সেখানে সীমাহীন।’ জর্জ বার্নাড শয়ের মত হচ্ছে, ‘স্বাধীনতার অর্থই দায়িত্ব।’
বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের বহিঃশত্রুর নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের সুদীর্ঘ ইতিহাস। তারই পথ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের মার্চে পুরো জাতি সর্বশেষ দখলদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঐক্য ও আত্মবিস্ফোরণের চূড়ান্ত বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। সেই কেন্দ্রবিন্দুর নাম বাংলাদেশ। তা ছাড়া পাকিস্তানের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন এবং শোষণ-বঞ্চনাহীন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য।

আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশের শৃঙ্খল ভেঙে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ কখনো পাকিস্তানের অংশ বলে গ্রহণ করতে পারল না। বাঙালিকেও ‘পাকিস্তান’ বলে স্বীকৃতি দিল না। বাঙালিদের জন্য শুধু ঘৃণা, শোষণ এবং বঞ্চনা-বৈষম্য। আওয়াজ উঠতে শুরু হয়ে গেল ‘মানি না, মানব না’ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই। স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই। সর্বশেষ স্বাধীনতার জন্য লড়াই। প্রস্তুতি, রক্ত, জীবন উৎসর্গ, জেল-জুলুম। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১Ñ২৪ বছর। ২৪টি বছরজুড়েই শোষণ-বঞ্চনা আর জেল-জুলুমের কালি দিয়ে লেখা এক কালো ইতিহাস।

সেই ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার লড়াই। এ পর্বের মূল লড়াই শুরু হয় প্রকৃত অর্থে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করলে। প্রকৃত অর্থে ছয় দফার সারমর্মই ছিল বাঙালির স্বাধীনতা। তারপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটক করা হয়। শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। অতঃপর গণ-আন্দোলনের মুখে তাঁকে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে।
তবে ১৯৭১ সালের মার্চ ছিল উত্তাল, যাকে বলা হয় উত্তাল মার্চ। রাজনৈতিক আন্দোলন পরিণতির দিকে যায় স্বাধীনতার আন্দোলনে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো শুরু হয়। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার অলিগলিসহ সারা দেশের রাজপথ। স্লোগানে স্লোগানে প্রতিধ্বনিত হয় পুরো বাংলাদেশ। আর সেই স্লোগান হলো : ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।

অগ্নিঝরা মার্চ। বছর ঘুরে আবার এসেছে। বসন্ত পল্লব প্রকৃতিতে এই মার্চ মাসেই বাংলার জীবনে নেমে এসেছিল এক মহাপ্রলয়। দেশ কি পাকিস্তানের অধীনেই থাকবে নাকি স্বাধীন এক ভূখণ্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব-সংগ্রাম-রক্তক্ষয় হয়েছে। সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয় হয়েছে পঁচিশে মার্চের সেই কালরাতে।

২৫ মার্চ ১৯৭১-এ সংঘটিত হয় ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শুরুও সেই কালরাত থেকে এবং ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়। বীর বাঙালি অসীম সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে হানাদার পাকিস্তানিদের পরাজিত করে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বাংলাদেশের আপামর মানুষের রক্তের ঋণ আমাদের চিরকালীন পাথেয়। একাত্তরের মার্চে দেশবাসীর রক্ত ঝরেছিল। বায়ান্ন বছর পরে আবার আরেক রক্তঝরা মার্চ আসুক, তা আজ আমরা কেউ চাই না। যে শিশুটি সেদিন জন্মেছিল, সেও চায় না।

স্বাধীনতার পরই অনেকে দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছেন। অনেকে বলেছেন দেশটি উন্নয়নের ‘কঠিন পরীক্ষার’ সম্মুখীন। এসব কিছু অনেকটাই ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এই দেশটি উন্নয়নের একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে এসেছে। এর পেছনে দেশের আপামর জনসাধারণের সমর্থন, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, ছাত্র, সরকারি খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সবিশেষ অবদান রয়েছে। মার্চ মাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় বহুমূল্য রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ দেশ। উদার গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক ও সমৃদ্ধ দেশ নির্মাণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং স্বপ্ন, ব্যর্থতা, অর্জন ও আকাক্সক্ষার সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রিয় মাতৃভূমি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অন্যান্য দেশের তুলনায় সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। বিশেষ করে, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায়। স্বভাবতই ২৬ মার্চ আমাদের কাছে বিশেষ গৌরবের দিন, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি ওই দিনে, দিনটি গৌরবের বটে। কিন্তু এর পরও কথা থাকে। স্বাধীন রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পেছনে যে উদ্দেশ্যাবলি বিদ্যমান ছিল, সেগুলো আমরা সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি কি না, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে বলে মনে করি। ২৬ মার্চকে কেন্দ্র করে এ বিষয়গুলো নিয়ে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি ভাবতে হবে আমাদের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়ে।

প্রাপ্তি আমাদের অনেক। স্বাধীনতা নিজেই একটা বড় প্রাপ্তি। পাকিস্তান নামক একটি অমানবিক রাষ্ট্রের অধীনে দীর্ঘ ২৪ বছর নির্যাতিত হয়েছি, শোষিত হয়েছি। কাজেই সেই পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত হওয়াটাই বড় পাওয়া। স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা প্রণয়ন করেছি বিশেষ এক দলিল, সেই দলিলটি হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান। সেই সংবিধানে আমরা স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছিলাম, রাষ্ট্রের মালিক হবে জনগণ। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলাম সেই সংবিধানে। আমরা এসব কিছুর নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন এবং মূলনীতির বাস্তবায়ন ঘটাতে পারলেই প্রকৃত স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারব।

দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করছি, দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। ৫২ বছর পর বহু কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু হয়েছে। একযোগে ১০০ সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। জনগণের জীবনমান উন্নত হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে কি বেড়েছে সেবার মান?

যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে এ দেশে শিকড় গাড়া বাংলাদেশিদের, অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে তাদের। যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার সরকার বাংলাদেশের বিরোধিতা করলেও এ দেশের সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। তারা রাস্তায় নেমেছিল, অর্থ সংগ্রহ করেছিল, জর্জ হ্যারিসন এবং অন্য শিল্পীরা রবিশংকরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য কনসার্ট করেছিলেন, যা আজ ইতিহাস হয়ে আছে। সেই আমেরিকায় আজ বাংলাদেশের বিরাট প্রতিষ্ঠা। এই ৫২ বছরে ধীরে ধীরে বদলে গেছে সব চালচিত্র। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দরজা খুলে দিয়েছে বাংলাদেশিদের স্বাগত জানাতে। বাংলাদেশিদের ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রশংসিত। এ দেশের প্রতিটি প্রান্তে বাংলাদেশ নামটি আজ মর্যাদার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। যেমন নারীর ক্ষমতায়ন, মা ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্যসুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম। কৃষিক্ষেত্রে ধানের বাম্পার ফলন, মৎস্য চাষ এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে সড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণেও বাংলাদেশের উন্নতি লক্ষণীয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বইয়ে দেখতে পাই, চীন দেশটি মাত্র কয়েক বছরে আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে। সরকার ও জনগণ মিলে দেশটিকে বদলে দিয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, দেহব্যবসা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে। ছেলে অপরাধ করলে বাবা; স্বামী অন্যায় করলে স্ত্রী তুলে দিয়েছে প্রশাসনের হাতে। এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হয়তো এমন উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন। নিলেও কি তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল? স্বাধীন দেশেও স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন করতে হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও অর্থ কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা আমাদের সামনে এগোতে দেয়নি। ফলে এখন পর্যন্ত বেকারত্ব নিরসন করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষার হার বাড়লেও কর্মসংস্থানের অভাবে বেশির ভাগ তরুণ বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দিন কাটাচ্ছে।

সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা আমরা কি প্রণয়ন করতে পেরেছি? তাই অনেকেই এমবিবিএস পাস করে প্রশাসন ক্যাডারে চলে যাচ্ছেন। বুয়েটে পড়েও গুরুত্ব দিচ্ছেন বিসিএসকে। গত ৫২ বছরে শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে নানাজন নানা কথা বললেও মানোন্নয়ন ঠিক কতটুকু হয়েছে, তা শিক্ষার্থীরাই ভালো বলতে পারবেন। শিক্ষার অন্তরায় হয়ে উঠেছে ছাত্ররাজনীতি। অথচ স্বাধীনতার আগে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে ছাত্ররাই ছিলেন সোচ্চার। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাড়লেও মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এখন নৈতিক শিক্ষার অভাব। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনরা ছাত্রদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে। সঠিক নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে খুবই কম।

তা ছাড়া এখনো নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। অব্যবস্থাপনায় অকালেই ধ্বংস হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, মারামারি, লুটপাট দিন দিন যেন বাড়ছেই। সম্প্রতি গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এই বাংলাদেশে কোনো দল, কোনো গোষ্ঠী এমনকি কোনো ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ই মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতন্ত্রের চেতনা ও আদর্শ মানতে চায় না। এমনকি যারা ক্ষমতায় থাকে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাদের আদালতকে পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেখা যায়।

কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর পরও এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্তÑএকটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন, মানুষের সেই আশা আজও পূর্ণ হতে পারল না। এ জন্য রাজনীতির ময়দানে যারা খেলছেন, তাদের কোনো একটি পক্ষকে দোষ দিয়ে গণতন্ত্র তথা বাংলাদেশের সংকট থেকে বের হয়ে আসা যাবে না। এমনকি পাকিস্তান আমলেও বাঙালিদের কাছে যে নির্বাচন ছিল উৎসব, সেই নির্বাচন এখন যেমন অনিশ্চিত, তেমনি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমনটা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? বাংলাদেশ স্বাধীন হলো সব ধর্ম, সম্প্রদায়, সব গোষ্ঠীর মিলিত লড়াই, সংগ্রাম ও যুদ্ধে। সকল মানুষের এক রঙের লাল রক্ত মিলেমিশে গিয়েছিল। হানাদার বাহিনীর বন্দুকের গুলি একইভাবে সব ধর্মের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোর কর্মীর বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। মুসলমানদের বাড়ি, হিন্দুদের ঘর একই সঙ্গে জ্বলল। একই সঙ্গে প্রাণের ভয়ে দেশত্যাগ করে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান। তারপর সব এলোমেলো, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কোন ভূতের আছড়ে! কোথায় গেল সেই ঐক্য, সেই সমঝোতা?
অন্যদিকে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক বিশ্বের এক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন। এই সম্মেলনে ১১০ দেশের ৭৫০ জন প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এ খবর ছিল অভাবনীয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ বা গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের বাংলাদেশকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হবে না, এমন কথা কেউ ভাবতেও পারেনি। আড়াই বছর পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন আগামী ২৯ ও ৩০ মার্চ ২০২৩ অনুষ্ঠান করতে চলেছেন তার দ্বিতীয় গণতন্ত্র সম্মেলন। ১১০টি দেশ আসন্ন এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছে। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশ এবারও বাদ পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে ভারত আমন্ত্রণ পেয়েছে, নেপাল-মালদ্বীপের মতো দেশ পেয়েছে, এমনকি পাকিস্তানও পেয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ পায়নি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫২ বছরে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য, লুণ্ঠিত গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য দেশের মানুষকে নতুন করে লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, সেই বাংলাদেশ গণতন্ত্রের একটি আদর্শ ভূমি হবে, এটাই তো ছিল প্রত্যাশিত। গণতান্ত্রিক দেশসমূহের সম্মুখসারিতে থাকার কথা ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু বাস্তবে তা কি হয়েছে?
তবে প্লেটোর ভাষায় স্বাধীনতা যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গৌরব, সে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আজও হয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। গণতন্ত্রের ধারণাকে আমরা ধূলিসাৎ করে দিয়েছি। এর স্থান দখল করেছে কর্তৃত্ববাদ। সুশাসন এখানে নির্বাসিত। বিচারেরর বাণী এখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। মিডিয়ার মতে, বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। নামমাত্র নির্বাচন হলেও নির্বাচনী ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। বিনা ভোটে নির্বাচন হয়, দিনের ভোট আগের রাতেই হয়ে যায়। সংসদ থাকলেও সেখানে চলে একটিমাত্র দলেরই কিচ্ছাকাহিনি। ওই দলের নির্দেশেই চলে ‘বিরোধী দল’। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া অভিজাত শ্রেণি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার রীতি চালু করেছে। অধ্যাপক রওনাক জাহান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইন দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে শৃঙ্খলিত এবং মতপ্রকাশকে বাধা প্রদান করার ঘটনা উদ্বেগজনক।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রিডম সংস্থা ২০২১ সালে তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা একদমই কম বাংলাদেশে। রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে আংশিক স্বাধীন দেশগুলোর মধ্যে তলানিতে বাংলাদেশ। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড রেজিম’ দেশের তালিকায় স্থান দেওয়া হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা রয়েছে। ২৮ জানুয়ারি ২০২২ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের আরো অবনতি হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীনতা, মতপ্রকাশ ও জবাবদিহির অভাবকেও বর্তমান অবস্থার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছে তারা।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকী উদ্্যাপন করে। রক্তে অর্জিত আমাদের সেই স্বাধীনতার আজ ৫২ বছর পূর্তি, এর চেয়ে আনন্দের দিন আর কী হতে পারে? নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনি। সেই দিনটিই ২৬ মার্চ এক গোলাপ ফোটানো দিন। লক্ষ প্রাণের দানে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এসেছে এই অমূল্য দিন।
উপরে উল্লেখিত সবকিছু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন ঘটাতে পারলেই প্রকৃত স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারব, ৫২ বছরে বিশ্বের বুকে যতটা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি, সেই সঙ্গে উন্নত দেশের কাতারেও নিজের দেশকে দাঁড় করাতে পারব।

লেখক : গবেষক। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সিলেট। পিএইচডি ফেলো, নিউইয়র্ক