মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বর্তমান বাংলাদেশ

রওশন হাসান

রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অথবা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয়টি স্বাধীন ভূখন্ডের একটি অপরিহার্য বিষয়। স্বাধীনতার সাথে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা কতটুকু সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া স্বাধীনতা কোন চেতনার মধ্য দিয়ে অর্জিত এবং এই স্বাধীনতাকে বহাল রাখার জন্য কোন চেতনা ধারণ করা উচিত সে বিষয়টিও আলোচনার আওতাধীন। তবে এ বিষয়গুলোর গতিপ্রকৃতি সময় ও বাস্তবতার সাথে পরিবর্তনশীল। এরপরও স্বাধীনতা ও চেতনার মধ্যে কিছু মৌলিক ও সাধারণ মিল ও পার্থক্য রয়েছে । যে সমাজে সমাজসচেতন ও মননশীল ব্যক্তি যত অধিক, সে সমাজ ততোধিক শ্রেষ্ঠ ও শক্তিসম্পন্ন। সমাজে মহাত্মাগণ জন্মগ্রহণ করেন বলেই অধঃপতিত সমাজের উন্নতি সাধিত হয় অথবা দুর্বল সমাজ প্রবল হতে পারে না। কিন্তু এই মননশীলতার অনুশীলন স্বাধীন পরিবেশে যেমন সম্ভব তেমনি ব্যক্তি মননশীলতার উন্নতির মধ্যদিয়ে সামগ্রিকভাবে জনসমাজের উন্নতিও সম্ভব। সে কারণেই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার পরবর্তী পরিবর্তন মননশীলতা বা চিন্তার। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্বার্থান্বেষী ও কুচক্রিদল অপরাধ, অপরের ছিদ্রান্বষণে অনৈতিক ভূমিকা পালন করে চলেছে এবং এ পরিস্থিতি জাতীয় চেতনাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে চলেছে । যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ তাদের স্ব-স্ব ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠানসহ সহাবস্থান করে এসেছে। এই সহাবস্থানমূলক বসবাসের মাধ্যমে এ দেশের মানুষ গড়ে তুলেছে সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্য। এই ভূখন্ডের জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী বিদেশি শাসক শোষকদের হাতে শোষিত হয়েছে। ব্রিটিশদের সুদীর্ঘ দু’শো বছর ধরে শোষণ, জমিদারী প্রথার মাধ্যমেও নিষ্পেষিত হয়েছে এই ভূখন্ডের জনগণ। সর্বশেষ, ভারত বিভক্তি এবং তারই ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্মের পরে ব্রিটিশ রচিত ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম রেখে পাকিস্তানের উঠতি পুঁজিবাদী গোষ্ঠী, বিশেষ করে সামরিক এবং বেসামরিক আমলাগোষ্ঠী এ ভূখন্ডের জনগণের উপর নিপীড়ন এবং শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। ফলে এ ভূখ- থেকে যায় অনগ্রসর ও অবহেলিত । নিপীড়িত জনগণের অভাব-অনটন, হতাশা ও বিক্ষোভের ধূম্রজালে ১৯৭১ সালে একটি প্রবল আগ্নেয়গিরির উদগিরণ ঘটে। এই উদগিরণের ফলাফল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনের একটি সক্রিয় রূপ। ১৯৭১ সালের গণঅভুত্থান ছিল একটি যুগান্তকারী গৌরবময় অধ্যায়। শোষণ, জুলুমের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম পরিচালনা করার অগ্নি শপথপুষ্ট চেতনার নামই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আর এই চেতনা তৈরির প্রাণকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক অনবদ্য জীবনী শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের এ অধ্যায় রচনা করতে অসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার শিকার হতে হয়েছে গণমানুষকে । শহীদ হয়েছে লক্ষ লক্ষ দামাল সন্তান, সভ্রমহীন হয়েছে অগণিত মা-বোন। মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের মানুষের মান সম্মান এবং জানমালের নিরাপত্তা ও আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ। সকল মানুষের সমমর্যদায় জাতি বিশ্বে পরিচিতি লাভ ও একটি সুখী, স্বাধীন, সমৃদ্ধ সার্বভৌম জাতির বিকাশ। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা ও মুক্তযুদ্ধকালীন ইতিহাস আজও অনিশ্চিত এবং এভাবেই স্বাধীনতার মূল চেতনা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কর্তৃক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ৪১ জন নারীকে ‘বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি ও নামের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ মুক্তিযুদ্ধ চেতনার একটি বলিষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ। যে কাজটি যুদ্ধ পরবর্তীকালীন সকল বয়সী বীরাঙ্গনাদের প্রাপ্তি ছিল, স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পরে হলেও সেটি সংঘটিত হয়েছে। তবে বীরাঙ্গনাদের সম্মাননা প্রদানের চেয়ে তাঁদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা অধিক জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধ নয়। চেতনার বিশালতাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে ষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুক্তিযুদ্ধ নিরপেক্ষ; ঠিক যেভাবে ধর্মের বাণী মানবতা নিরপেক্ষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে বাংলাদেশের সৃজনশীল সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মধ্যে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া চলচ্চিত্রও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটকে ও চলচ্চিত্রে প্রগতিশীল ধারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী গত চারদশকের সমাজ ও সৃজনশীল সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন সেটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অন্যদিকে এর বিপরীত চিন্তাই পশ্চাদগামিতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা। বেদনা, বিক্ষোভ, উত্তাপ ও সন্তাপকে অঙ্গিকার করে গণমুখী ধারায় বিকশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাংলাদেশের কবিগোষ্ঠীর কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল স্পষ্ট। ফলে সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে নানাভাবে। তবে সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমর্থনে বাংলাদেশে কতটুকু পরিবর্তন এসেছে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠনের লক্ষ্য হওয়া উচিত সকল নাগরিকদের মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি না করা, বৈষম্যবিহীন আচরণ করা। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সরকারের কাছ থেকে কোন ধরনের পক্ষপাত ছাড়াই সম্মান, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার লাভের অধিকারপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা পাওয়া। সকল ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা এবং আইনের সম্ভাব্য সর্বোত্তম প্রয়োগের ব্যবস্থা করা। আইনের আওতা বহির্ভূতভাবে কোন পদক্ষেপ আইন পরিপন্থি বলে বিবেচ্য হওয়া উচিত। মৌলিক মানবাধিকার আমাদের সংবিধানে যেমন লিখিত আছে, তেমনই আছে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সনদে। কোন নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের উপর সরকার আক্রমণ করতে পারবে না এবং সরকার সকল নাগরিককে অপরের এরূপ আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। নাগরিকরাও একইভাবে একে অপরের সমমর্যাদাকে ও স্বাধীনতাকে কথায় ও কাজে অস্বীকার করবে না, অন্যের প্রতি অত্যাচার, নির্যাতন, উৎপীড়ন থেকে বিরত থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে সৃষ্ট বাংলাদেশের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত বাংলাদেশ হবে জনগণের দেশ এবং জনগণের দ্বারা পরিচালিত দেশ; অর্থাৎ গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত দেশ। অথচ বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, দুর্নীতি ও দুর্নীতির ক্রমবিকাশ এখন দেশের গ-ি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে। এরূপ স্বৈরাচারী মনোভাব গণতন্ত্র শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী। বাংলাদেশে বর্তমানে বৈষম্য ও দলীয়করণের ব্যাপক প্রভাবে বর্তমানে সরকারদলীয় ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য নাগরিকদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় বা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা, চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি সম্ভব হচ্ছে না। স্পষ্টত, সাধারণ মানুষ ও সরকারদলীয় ব্যক্তিদের মধ্যে নিয়মনীতি ও আইন প্রয়োগে ব্যাপক পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যায়। বস্তুতঃ বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনে লালিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আজ স্বাধীনতা লাভের সাতচল্লিশ বছর পরও মূল্যায়ন করার প্রয়োজন এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়নে জাতি কতটুকু সফল? সেক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কোথায় বিশ্লেষণ করে যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন এবং এ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সকল ক্ষেত্রে দেশপ্রেম, নিষ্ঠা এবং সততার সুস্থাপন ও ঐক্যবদ্ধতার বিকল্প নেই।
কবি, নিউ ইয়র্ক।