১৯৭১-এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাগণ যে বীরত্ব প্রদর্শন করে দেশকে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন এক কথায় তা অনন্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সহযোগিতা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভারত এগিয়ে না এলে দুধর্ষ, রণসজ্জিত পাকিস্তানি সৈন্যদের পরাজিত করা যেত কিনা সে এক বিরাট প্রশ্ন। এক কোটি শরনার্থীকে যুদ্ধের ন’মাস আশ্রয় দিয়ে, ভরণ পোষনের ব্যবস্থা করে ভারত এক মানবীয় অনুকরণের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। অগণিত ভারতীয় যে যেভাবে পেরেছে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে।

নাম জানা না জানা অগণিত ভারতীয় সাহায্যকারীর মধ্যে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেসের লিটল বাংলাদেশে বসবাসরত ঘনশ্যাম চেজারা পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণে প্রাক্কালে ভারতীয় জেনারেল জ্যাকব-ফারজ-রাফায়েল (জেএফআর জ্যাকব) ও পাকিস্তান বাহিনীর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি (এ কে নিয়াজী) এর মধ্যে কথোপকথন রেকর্ড করে বাংলাদেশের গৌরবজ্জল মুক্তিযুদ্ধের বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হয়ে আছেন।

ঘনশ্যাম চেজারা তখন ভারতীয় সেনা বাহিনীতে সিগন্যালম্যান হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সে সময় তার কর্মস্থল ছিল বালীগঞ্জ। জে এফ আর জ্যাকব ও এ কে নিয়াজীর কথোপকথন তিনি রেকর্ড করেন পূর্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম সেনানিবাসে। ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় কথোপকথনটি রেকর্ড করা হয়। সে সময় আধুনিক রেকডিং ব্যবস্থা ছিল না। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের প্রাক্কালে ঢাকায় জেনারেল নিয়াজি ও জেএফআর জ্যাকবের আত্মসমর্পণের কথোপকথন ওয়ারলেস মারফত ফোর্ট উইলিয়াম সেনানিবাসে রেকর্ড করা হয়।
আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানে সর্বশেষ গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক এবং পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক হাই কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। গভর্নর হিসাবে তাঁর মেয়াদকাল ছিল ১৪ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর। মাত্র তিন দিন। জেনারেল নিয়াজী ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবে একটি গিলজাই পশতু পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৩২ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে জুনিয়র নন-কমিশন্ড অফিসার হিসাবে যোগ দেন। ২০০৪ সালে তিনি লাহোরে মৃত্যুবরণ করেন।

জেনারেল জ্যাকব ফারজ রাফায়েল ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হিসাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন। জ্যাকব ১৯২৩ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষের কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ১৮শতকে বাগদাদ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি ছিলেন ইহুদি ধর্মের অনুসারী। ১৯৪২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত জ্যাকব মোট ৩৬ বছর ভরতীয় সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে চাকরি করেন। তিনি ছিলেন অপরিসীম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। জেনারেল নিয়াজি ও তাঁর ঊর্ধ্বতন কমান্ডারদেরকে ২০ ডিসেম্বর বিমানে করে কলকাতায় আনা হয় এবং ফোর্ট উইলিয়ামে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। জেনোরেল জ্যাকব আত্মসমর্পনের দলিল নতুন করে টাইপ করিয়ে সেটাতে আবারও নিয়াজির সই করিয়ে নেন। নিয়াজি সাগ্রহে কাজটি করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ ভুমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদন করে। ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী জেনারেল জ্যাকব পরোলোক গমন করেন।
ঘনশ্যাম চেজারা ১৯৪৭ সালে ২৫ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শিউরী মহকুমার বক্রেশ্বরের কাছে দুবরাজপুরে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতৃপুরুষের আদি নিবাস রাজস্থান। তাঁর ঠাকুরদা রাজস্থান থেকে দুবরাজপুরে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পিতার নাম রামপ্রতাপ চেজারা, মাতার নাম বিদামী চেজারা। ৬ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। স্থানীয় রামকৃষ্ণ আশ্রমে শিক্ষায় হাতে খড়ি। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন সারদা বিদ্যাপীঠ, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেনি পর্যন্ত হেমায়েতপুর রাজ হাইস্কুলে।
ঘনশ্যাম চেজারা ১৯৬৫ সনে ভারতীয় সেনাবহিনীতে কোর অব সিগন্যালস এ ওয়ারলেস অপারেটর পদে হেতামপুর যোগদান করেন।
১৯৭০ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা অবস্থান করেন। সে সময় বিভিন্ন ধরনের জটিল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির জ্ঞান অর্জন করেন। টেলিভিশন ইঞ্জিনিয়ারিং এ দক্ষতার কারণে ঘনশ্যাম চেজারাকে জেনারেল জ্যাকবের ব্যক্তিগত টেলিভিশন মেরামত করতে দেন। ১৯৮২ সসে তিনি একটি টিভি কারখানা স্থাপন করেন। সে সময় তিনি সনি, মিৎসুবিসি প্রভৃতি কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেন এবং হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন। এছাড়াও তিনি জাপান, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ভ্রমন করেন।

১৯৯৩ সনে ঘনশ্যাম চেজারা সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। যুক্তরাষ্ট্রের তিনি ৩৮টি স্টেট ভ্রমন করেন। ২০০৮ সন থেকে তিনি লস এঞ্জেলেসে বসবাস শুরু করেন এবং বাংলাদেশিদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। বাংলাদেশি যে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি ও তাঁর পরিবার সক্রিয় অংশ গ্রহন করেন। বিশেষ করে হিন্দুদের বিভিন্ন পূজায় ঘনশ্যাম চেজারার নির্মিত অস্থায়ী দৃষ্টি নন্দন মন্ডব সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
একুশে ফেব্রয়ারি উপলক্ষে ঘনশ্যাম চেজারা নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনার ও বিজয় দিবস উপলক্ষে অস্থায়ী জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এখানের সকলের দৃষ্টি আকর্ষ করে এবং লস এঞ্জেলেসে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে ব্যাপক সাড়া জাগায়। লস এঞ্জেলেসস্থ বাংলাদেশ কন্স্যুলেটেও তাঁর নির্মিত এই দৃষ্টি নন্দন সৃতিসৌধ ও শহীদ মিনার ব্যবহার করে।
ঘনশ্যাম চেজারা ও তার পরিবার সাবলীলভাবে বাংলা বলতে পারেন বলে সকল বাংলাদেশিরাও তাদের আপন করে নিয়েছে। ঘনশ্যাম চেজারার ২ ছেলে ২ মেয়ে। ছোটছেলে সন্দীপ হোাদখাসা, পুত্রবধূ আকাঙ্খা হোদখাসা ও সহধর্মিনী অঙ্গুরী চেজারা ঘনশ্যাম চেজারাকে তাঁর এ-সব সৃজনশীল কাজে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে থাকেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আপনি তো একটি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন- এখন আপনার অনভূতি কেমন? প্রশ্নের জবাবে ঘনশ্যাম চেজারা বলেন- তখন তো আমি জানতামই না আমি কি করছি। সে সাধারণ কাজটুকু যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এমন অনন্য দলিল হয়ে থাকবে তা কি আমি জানতাম? এখন জানলাম, খুব ভালো লাগছে।
আপনি তো বাংলাদেশিদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছেন এবং বাংলাদেশের সব খোঁজ খবর রাখেন। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ এবং ২০১৯-এর বাংলাদেশকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ঘণশ্যাম চেজারা বলেন- বাংলাদেশ বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। ইতোমধ্যে ক্ষেত্র বিশেষ বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। আমি বাংলাদেশের আরো সাফল্য কামনা করি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় নাগরিক ঘনশ্যাম চেজারার অবদানকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া যায় কিনা বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।