মুমিন বান্দার পরিচয় ও গুণাবলী

মমতাজ সবুর চৌধুরী

মুমিন ব্যক্তিকে চেনা যায় সাতটা গুণ দিয়ে। যেমন- ঈমানদার হওয়া এবং পবিত্র কুরআন ও হাদিসের নির্দেশাবলী কথা ও কাজে পালন করা। যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে পুরোপুরি রুজু হয়ে অত্যন্ত একাগ্রচিত্তে দুরাকাত নামাজ আদায় করবে সে পাপ হতে এমনভাবে মুক্ত হবে যেন সে একটি সদ্য জাতক শিশু। কেয়ামত দিবসে আল্লাহ সবকিছুর আগে নামাজের হিসাব নেবেন। জাকাত দেয়া মুমীনের অন্যতম শর্ত। জাকাতের অর্থ আত্মশুদ্ধি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন তিনি মুমিনদের জানমাল বেহেশতের বিনিময়ে খরিদ করেছেন। মুমিন বান্দারা জাকাত আদায় করে আল্লাহকে শুকরিয়া জানায়। লজ্জাস্থানের হেফাজত করা, জেনা ও ব্যভিচার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা মুমিন হওয়ার অন্যতম শর্ত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে তারা সফলকাম হয়ে গেছে (মুমিনুল) (আল কুরআন)। আল্লাহ বলেছেন তোমরা নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না। লজ্জা হলো ঈমানের অংশ, যার লজ্জা নেই, তার শরম নেই, তার ঈমানও নেই। এ জন্য আল্লাহ বলেছেন তোমরা নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না। আমানতদারীও মুমিনের শর্ত। কারও গোপন কথা ফাঁস করা, কাজে ফাঁকি দেয়া আমানতের খেয়ানত করা। মুমিন যে কোন মূল্যে প্রদত্ত ওয়াদা পালন করে। আমাদের নবীজি ওয়াদা পূর্ণ করার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। মু’মিনের সপ্তম গুণ হলো নামাজের প্রতি যতœবান হওয়া। নামাজ শুধু পড়লে হবে না নামাজের ফরজ, ওয়াজিব মেনে পড়তে হবে। নতুবা নামাজ শুদ্ধ হবে না। মু’মিন বান্দারা একে অপরের বন্ধু। তারা সব সময় সৎ কাজের আদেশ দেয় অসৎ কাজে নিষেধ করে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে। এদের প্রতি আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ খুব প্রভাবশালী। (সূরা তওবাহ) কুরআন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন তোমাদের মধ্যে কেউ দুনিয়া চায় কেউ আখেরাত চায়। তা ভোগ সামগ্রী মাত্র। আল্লাহর কাছে রয়েছে শুভ পরিণাম (সূরা আল ইমরান) মু’মিন বান্দা যারা, তারা দুনিয়া চায় না তারা আখেরাত চায় কারণ তারা জানে দুনিয়ার ভোগসামগ্রী হলো দু’দিনের আখেরাতের ভোগ সামগ্রী হলো স্থায়ী অর্থাৎ আখেরাতের শুভ পরিণাম হলো স্থায়ী। যারা শুধু দুনিয়ার ভোগ সামগ্রী চায় এদের পরিণাম জাহান্নাম। মু’মিন বান্দারা আল্লাহর সীমা রেখা লঙ্ঘন করে না। মু’মিন বান্দারা রিজিকে বিশ্বাস করে। রিজিক সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন আমাদের নবীকে। হে মোহাম্মদ রিজিকের জন্য তুমি চিন্তা কর না তুমি নামাজ পড় তোমার পরিবারকে নামাজ পড়তে বল রিজিকও আমিই দিই। (আল কুরআন), তারা তকদিরে বিশ্বাস করেন এবং বিপদে আপদে বিচলিত হয়ে ধৈর্যের সাথে বিপদ মোকাবেলা করেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পবিত্র কুরআনে পুঙ্খানুপুঙ্খ বলে দিয়েছেন, কিভাবে পৃথিবীতে সঠিকভাবে জীবন অতিবাহিত করবে এবং কোন পথে পুরষ্কৃত হবে এবং কোন পথে গেলে তিরস্কৃত হবে। মু’মিন বান্দারা যে কোন মূল্যে আল্লাহর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। আল্লাহ তার বান্দাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বলেছেন তোমরা মৃত জীব, রক্ত শুকরের মাংস এবং যে জীব আমার নামে জবেহ করা না হয় তা খাবে না। তিনি আরও বলেছেন আল্লাহ যে খাদ্য হালাল করেছেন সে খাদ্য যদি হারাম ভেবে না খাওয়া হয় তার জন্যও আল্লাহ শাস্তি দেবেন। মুমিনরা সবসময় হালাল দ্রব্য খায় ও হালাল উপার্জন করে। তারা জানে রুজি রোজগার আয় উপার্জন যদি হালাল না হয় তাহলে নামাজ, রোজা, কোনো ইবাদতও কবুল হবে না। মু’মিন বান্দারা ভালো করেই জানে আল্লাহ আমাদের রিজিকদাতা এবং জন্মমৃত্যুর মালিক, তিনি চাইলে মারেন তিনি চাইলে বাঁচান তিনিই আমাদের পালনকর্তা। তিনি এই পৃথিবীর সব কিছুর মালিক ও সৃষ্টা মহান আল্লাহ। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তার কোনো শরিক নেয়। তার সমকক্ষ বলতে এই পৃথিবীতে কেউ নেয়। এই জন্য তিনি ছাড়া কেউ ইবাদতের যোগ্য হতে পারে না। তারা একগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে রাতদিন মশগুল থাকে। রাতের বেশির ভাগ তারা তাহাজ্জদ নামাজ আল্লাহর জিকির নফল নামাজ পড়তে থাকে। রাতে আল্লাহ তার বান্দাদের ফরিয়াদ কবুল করার জন্য সাত আসমানের নিচে নেমে আসেন। তখন তিনি তার বান্দাদের বলেন, ‘তোমরা আমার কাছে কি চাও আমি দিবো’। মুমিনরা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাকওয়া অর্জনের লক্ষেই রমজানের রোজা পালন করে। মুমিনরা পবিত্র শবে কদর রাত একুশে রমজান থেকে ঊনত্রিশে রমজান তালাশ করে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা কি মনে করেছ, আমি কি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি? তোমরা কি আমার কাছে ফিরে আসবে না’? (সূরা মু’মিন আয়াত ১১৫)। তিনি আরও বলেছেন মানুষ কি মনে করে তাকে এমনি ছেড়ে দেবো (সূরা কিয়ামাহ আয়াত ৩৬)। তিনি তার বান্দাদের আবার এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তারা জান্নাতের বাগানে যা চাইবে তাই পাবে। সেটাই তাদের নেক আমলের প্রতিদান (সূরা আশশূরা আয়াত ২২ রুকু)।
পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরলে মুসলমানদের পথভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকেনা। আমাদের নবী (স) বারবার বলেছেন, আমার উম্মত যারা দুনিয়াকে বেশি প্রাধান্য দেবে তখন তাদের অন্তর থেকে ইসলামের মর্যাদা উঠে যাবে। তারা সৎ কাজে আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধকে পরিত্যাগ করবে। তখন তারা অহির বরকত হতে বঞ্চিত হয়ে যাবে, তখন আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হয়ে যাবে, তখন আল্লাহর নেক নজর হতে বঞ্চিত হয়ে যাবে (তিরমিজি)। কিয়ামতের দিবসে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করা হবে: (১) পৃথিবীতে তোমার জীবন কিভাবে কাটিয়েছ? (২) ধন দৌলত কিভাবে উপার্জন করেছে? (৩) সেই ধন দৌলত কিভাবে ব্যয় করেছ? (৪) যৌবনকাল কিভাবে কাটিয়েছ? (৫) যে পরিমাণ এলেম শিখেছ, তা কিভাবে কোথায় কাজে লাগিয়েছ? মুমিন বান্দারা সেদিন আল্লাহর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে। আল্লাহ তাদের উত্তরে খুশি হয়ে যাবে। মু’মিন বান্দারা রাতদিন আল্লাহকে স্মরণ করেন। মু’মিন বান্দারা এই পৃথিবীর বিভিন্ন রকম সৃষ্টি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে এবং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন। আল্লাহর রাহমানুর রহিম বলেন যাদের জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক আছে, চিন্তা শক্তি আছে তারা বিশ্ব সংসারের চতুর্দিকে আমার সৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে আমার কুদরতের কথা আমার শক্তির কথা (আল কুরআন) মুমিন বান্দারা আল্লাহর সৃষ্টি দেখে অবাক হয়। রাতদিন তাকে স্মরণ করে সারা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করে। জিকিরে আজকারে রাত কাটিয়ে দেয়। তারা জানে পৃথিবীর চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্ররাজি, পর্বতমালা, অতলস্পর্সী সমৃদ্ধ আর পৃথিবীজুড়ে আরো বিভিন্ন রকম আশ্চর্য্যজনক সৃষ্টি বিশষ করে জন্ম মৃত্যুর পেছনে যিনি আছেন তিনি হলেন আমাদের রব। তারা সব সময় আল্লাহর কুদরতের কথাও চিন্তা করেন। এসব চিন্তা করাও নাকি ইবাদত। মুমিনরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে পৃথিবীতে মানুষের স্থায়িত্ব একেবারে কয়েকদিনের, চোখের পলকে শেষ হয়ে যাবে। মানুষের মৃত্যুর পরে শুরু হবে আসল জীবন। এই জন্য তারা পরকালীন সম্বল কুড়িয়ে নিতে সদা সচেষ্ট। তারা আল্লাহকে খুব ভয় পান। আল্লাহ নারীদেরকে পর্দার ভেতর চলাফেরা করতে বলেছেন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘হে নারী, তোমরা মাথার কাপড় বুকে টেনে দাও, নারীরা যদি পর্দা না করে তাহলে আল্লাহর একটি আদেশ অমান্য করা হলো। বলা হয়েছে বেপর্দা নারী কোনোদিন বেহেস্তে যেতে পারবে না। যারা পার্থিব জীবনকেই সব কিছু মনে করে, তারা এই কয়েকদিনের জীবন এবং ভোগসামগ্রিকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে অথচ তারা জানে না আখেরাত হলো আসল, উত্তম এবং স্থায়ী। (সূরা আলা ১৭)। তাদেরকে পার্থিব জীবন ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে। (সূরা আরাফ ৫২)। মু’মিন বান্দারা কোন অবস্থাতেই আল্লাহর সীমারেখা লঙ্ঘন করে না। তারা জানে এই পার্থিব জীবন শুধু খেল তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। মু’মিন মুত্তাকি যারা আল্লাহ তোমাদের কে প্রতিদান দেবেন (সূরা মুহাম্মদ আয়াত ৩৬)। যারা মু’মিন নর-নারী আল্লাহ তাদেরকে এমন জান্নাতে দাখিল করবেন যার তলদেশ দিয়ে ঝরণা ধারা প্রবাহিত হবে। সেখানে যারা অনন্তকাল অবস্থান করবেন এবং তাদের পাপগুলো ক্ষমা করবেন (সূরা ফতেহ ৫)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পাক কুরআনে বলেছেন তোমরা আমাকে ছাড়া আর কারও ইবাদত কর না কোনো কিছুকে আমার অংশীদার কর না তিনি আরো বলেছেন আমরা যেন আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে মাবুদ না বানায় (সূরা আল ইমরান রুকু ৭)। তিনি আরো বলেছেন, তোমাদের প্রতি প্রভুর তরফ থেকে যা নাজিল হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে অনুসরণ কর না। (সূরা আরাফ রুকু ১)। মু’মিন বান্দারা আত্মহত্যা, খুন-খারাবিসহ সকল ধরনের অন্যায় থেকে সর্বদা দূরে থাকেন। তারা এতিমসহ অন্যের হক আত্মসাৎ করার কল্পনাও করেন না। কারণ কিয়ামতের দিবসে অন্যের হক তছরূপকারীকে আল্লাহও ক্ষমা করবেন না। অন্যের হক আদায় করার পূর্বে বেহেশতেও প্রবেশ করা যাবেনা। মুমিন বান্দারা ভালো আমলনামার জন্য রাতদিন আল্লাহকে স্মরণ করে। তাহাজ্জদসহ যথাসাধ্য নফল এবাদতে মশগুল থাকেন। তারা ওয়াদা ভঙ্গ করেন না এবং চুপি চুপি দান খয়রাত করেন। মু’মিন বান্দারা নিজের জন্য পছন্দ যা করেন অন্যের জন্যও তা-ই পছন্দ করেন। মু’মিন বান্দারা সবসময় আমানত রক্ষা করেন। আল্লাহ দিনের ইবাদতের চেয়ে রাতের ইবাদতকে বেশি ভালোবাসেন। আর ফরজ নামাজের পরে নফল ইবাদতকে বেশি পছন্দ করে। রাতের শেষ ভাগে আল্লাহ সাত আসমানের নিচে নেমে আসেন এবং বান্দার ডাকে সাড়া দেন। মুমিনরা রাত জেগে পবিত্র কুরআন পাঠ করেন। পবিত্র কুরআন সম্পর্কে আল্লাহ বলেছন, অবিলম্বে আমি তাদের আশপাশ তাদের মধ্যে নিদর্শন দেখাব এমনকি এর ফলে তাদের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে কুরআন সত্য আপনার সর্ব বিষয়ে যে সাক্ষী থাকি তাকি যথেষ্ট নয় (সূরা হামীম সেজদাহ আয়াত ৫৩)। মু’মিন বান্দারা জাহান্নামকে ভয় পায়। তাদের প্রতিটা কাজকর্ম কুরআন হাদিস নির্ভরশীল, তারা এর বাইরে চলেন না।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে বেদাতের ছড়াছড়ি লক্ষ করা যাচ্ছে। অতি ধূমধামের সাথে হজরত আবদুর কাদের জিলানী (র.) জন্ম দিবস পালন করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে ইয়া আবদুল কাদের জিলানী আমাকে সাহায্য করুন। মূলত আল্লাহ ছাড়া কোন সাহায্যকারী বিশ্ব মুসলমানদের জন্য নেই।। নবীজি (স) এর জন্মবার্ষিকী পালন করার নিদর্শনও পবিত্র কুরআন-হাদিসে কোথাও মিলেনা। মাজারে গিয়ে তুলকী তালে তালে নাচানাচি করা গরু-ছাগল জবাই করে পীরের নামে মানত পুণ্য করা উদ্দেশ্য এবং আশা পূর্ণের জন্য মাজারে গিয়ে বলা সবই বেদাত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, মু’মিন বান্দাদের জন্য আল্লাহ পরকালে বেহেস্ত সাজিয়ে রেখেছেন (সূরা ফাহাত আয়াত ৫)। হে আল্লাহ হে পরওয়ারদিগার হে বিশ্বের অধিপতি তুমি এক ও অদ্বিতীয়। তোমার কোনো শরিক নেই তুমি চিরজীব, চির সত্য, চিরস্থায়ী, চির সুন্দর। হে অন্তর্যামি তুমি আমাকে এবং সমস্ত মুসলিম ভাই-বোনকে তোমার সুশীতল ছায়াতলে স্থান দাও এবং মু’মিন বান্দা বানাও। আমিন!
হিউস্টন।