মুয়াজ্জিন

জর্জেস মোহাম্মদ :

মনে পড়ে না কোন সালে, মনে পড়ে না কেন আটকা পড়েছিলাম বংশালে। বংশাল ঢাকার পুরোনো বালাখানার সমাহার। কারও দেয়ালে চুনকাম করা অসম্ভব প্রায়। কারণ পুরোনো আরও পুরোনো। উঁচু-নিচু ফাটা দেয়ালের অবস্থা শোচনীয়। অনেকের ছাদে কবুতরের খোপ দেখা যায়। গোল গোল মুখ। আর টেলিভিশনের অ্যান্টেনার মতো কবুতরের বসার স্থান। তারই ওপর সুন্দর বিশ্রাম নেয়, ঢাকার কৌশলী কাক।

কাক যে চতুর পাখি, তা সবাই জানে। আমিও জানি। কীভাবে জানি তা না হয় শিকেয় তোলা থাক। ভাঙা দেয়ালে, কাক আর কবুতরের ঐতিহ্য নিয়ে সুখে-দুঃখে ঢাকার বংশাল। বংশালের বেওয়ারিশ কুকুর, স্বাধীন দেশের স্বাধীন শহরের মাস্তান। গিয়েই দেখেন না একবার, কোন চিপির ভেতর কীভাবে ধরে। একহাত দেখিয়ে দেবে। যদিও স্বাধীন দেশ, বংশালের কুকুর সম্প্রদায়ের মাঝে রাজতন্ত্র এখনো বিদ্যমান। যেমন ছিল রাজার আমলে জোর যার মুলুক তার। আর বংশবিস্তারে প্রসার।

বন্ধু নজরুলের নানাবাড়ি। মাঝে মাঝেই যেতাম, পুরি ভাজা খেতাম। নিহারি, তেহারি আরও কত কী। খাওয়া নিয়ে কথা নেই। ঘরে ঘরে হিন্দি গান-মেরা লাল দোপাট্টা…। আর ওই বয়সে একটু গান শুনতেই মন গুনগুন করে ওঠে, পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া…। নজরুলের নানাবাড়ির বিশেষ আকর্ষণ হালিমণি বেগম আর সকিনা খাতুন। ওরা দুই বোন। হালিমণি বেগম আজীবন দশম শ্রেণীর ছাত্রী, ফেটিং-সেটিংয়ে পটু। সকিনা খাতুন লেখাপড়ায় একটু ভালো। অর্থাৎ চুল পরিমাণ ভালো। তবে এখানে বড় একটা কিন্তু আছে। সে একটু মোটাতাজা, মাশাআল্লাহ একটু বেশিই মোটা। এই যখন সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে, অর্থাৎ ছাদে ওঠে, আসতে আসতে আকাশ থেকে গিরিবাজ নামার পালা। হালিমণি বেগমের আরেকটা শখ ছিল, সিনেমা দেখা। হলে গিয়ে ম্যাটিনি শো দেখতেই হবে। ভাগ্য ভালো, ভিসিআর বাজারে আসেনি।

আমাদের দেখলেই দৌড়ে দোতলায় গিয়ে ফেটিং সেটিং করে আসে। আর ভাবখানা দেখায় ইট ইজ কোওয়াইট নরমাল। আসলে তো মাইঞ্জা মাইরা আইছে। চাপাবাজি আর মাইঞ্জা মারা শুনলে আর দেখলেই বোঝা যায়। এ জন্য পগোজ স্কুলে যেতে হয় না। হালিমণি, সকিনার বাবার অনেক পয়সা। বড়ই আশা পুরান টাউন ছাইড়া নতুন শহরে মেয়ে বিয়ে দেবে। চেষ্টা চালাইতাছে মাগর কাম হইতাছে না। হালিমণিকে মনে ঢেকে রেখে মনের বিরুদ্ধে হলেও বাসার গতিপথ সাব্যস্ত করলাম। রাত ১০টায় কারফিউ। স্বাধীন বাংলায় বুটের বাহাদুরি। গুলিস্তান আসতেই চারদিকে আর্মিবোঝাই ট্রাক ছোটাছুটি করছে। আউটার স্টেডিয়াম ধরে বঙ্গভবন, ফুলবাড়িয়া ধরে রমনা ভবন, বাইতুল মোকাররম ধরে টয়েনবি রোড। সে এক রণক্ষেত্র। আসলেই বিপদ। জিপিও ধরে পল্টন যেতেই বাধা, মিলিটারির। হাউস বিল্ডিং পার হতে না হতেই বাঁশির শব্দ। জিপের গায়ে সাইরেন। ভেতর গলি দিয়ে হেঁটে যেতে পারলে ১২টার মধ্যে বাসাবো। ধারণা ছিল ছোট রাস্তায় মামুরা নামবে না। যে মোড়ে যাই সেখানেই বালুর বস্তা আর মেশিনগান। রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা গান নয়, একেবারে ইস্পাতের মেশিনগান। উপায় নেই, রাত কাটাব মসজিদে, তাও আবার বারান্দায়। বাংলার আবহাওয়া সহায়ক ছিল, কিন্তু মশারা রক্ত শোষণে প্রস্তুত। মশার গুনগুন সুর অতি ভয়ংকর। রক্ত চুষে নেওয়ার দাবি। তাদের দাবি শুধু এক দফা রক্ত দাও। কাওয়ালির সারগীতের ন্যায় হাতে-পায়ে-গালে থাপ্পড় মারতে মারতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

সুবেহ সাদেক। আহা কী অপূর্ব সময়। হাজারো কষ্টের মাঝে নিরাময়। সেই আলো-আঁধারি ক্ষণ। নির্মল বাতাস। শব্দশূন্য সেই মায়াবী শহর ঢাকা। পুরানা পল্টন, সাক্ষী আমার চোখ আর আপ্লুত মন। দু-একটা শহুরে পাখির সুর। হয়তো রমনা রেসকোর্সের কাছে থাকলে আরও বেশি শোনা যেত। চড়ুই আর শহুরে কাকের ডাকও যেন আরও মধুর। ঢাকার অতি সকাল, সেই মধুমাখা ক্ষণ কখনোই উপভোগ করা হতো না, যদি বাংলার সৈনিক ভাইয়েরা বাংলার মানুষের ওপর কারফিউ জারি না করত। কারফিউ শব্দের সঙ্গে আমাদের অনেক আগেই পরিচয় হয়েছে। অনেকের জন্মের আগ থেকেই কারফিউ আমাদের সাথি। ধরুন সেই ৫২ সাল থেকে।

চারদিকে একই সুর। নানা স্বরে সুমধুর শব্দগুলো মধুমাখা, উচ্চাঙ্গের ভায়রো ভৈরবীর আদলে। আর কিছু নয়, ফজরের আজান। সবাই যখন নিদ্রায়, মুয়াজ্জিন জেগে আছে নামাজের দাওয়াত দেওয়ার আশায়। মগবাজারের বড় মসজিদ, কাকরাইল মসজিদ, বাইতুল মোকাররম, গলিতে গলিতে ভাসে মধুর সেই সুর।

বিনা মাশুলে আনন্দ। কোনো পয়সাই খরচ হয় না। ছোট জীবনে মাশুল ছাড়া আনন্দ পেয়েছি প্রকৃতির পাখির সুরে আর মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনিতে। সকালের পাখির সুর আর মুয়াজ্জিনের আজান দুটোই মন ভরিয়েছে। আগের দিনে সুরেলা গান শুনতে মাশুল দিতে হতো। শুনে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, রেডিওতে শুনলে মাশুল কেন দেব? ওই যে ব্যাটারি পুড়েছ বা ইলেকট্রনিক বিল? মুফতে কিছু নেই। কোকিলকে কখনো ভরণপোষণ করিনি, সুরেলা কণ্ঠে মন ভরিয়েছি। মুয়াজ্জিনও তার সুরেলা কণ্ঠে মন ভরিয়ে দেয়।

একজন মুয়াজ্জিন মসজিদের ইমাম নয়। ইমাম সব ধরনের ডাক পায়, মুয়াজ্জিন নয়। সব ধরনের ডাক! সে আবার কী? কোরআন খতম, ছোট-বড় মাহফিলের, আরও কত কী! সবই বড় অঙ্কের মাশুল দিয়ে ইমাম সাহেবকে ডাকে। অতি গোপনে শুল্কবিহীন হাদিয়া বলা যেতে পারে। অঘোষিত লেনদেন। গুনে লেনদেন নয়, শুধু হাত আর পকেট বদল।

একজন মুয়াজ্জিনের ঘর-সংসার কীভাবে চলে, তার সুখ-দুঃখ সাধারণে খোঁজ নেয় না। জানে না তার মনের খবর। জানে শুধু তার কণ্ঠ সুমধুর। তারই ডাকে ঘুম থেকে উঠে ধায় বেহেশতের আশায়। করে নামাজ আদায়। আজান দেওয়া তার পেশা নয়, নেশাও নয়, গভীর ভালোবাসা। সবার আগে মসজিদে যায়, সবার পরে বেরোয়। কারও বাড়ির ছোটখাটো কাজ যদি থাকে, তবেই ডাকে মুয়াজ্জিনকে। অতি ভালো মানুষ, সবাই ভালোবাসে। জানে না কটি সন্তান, কী খায়, শিক্ষার ব্যবস্থা কোথায়? ভালোবাসার জোয়ারে অবহেলিত মুয়াজ্জিন। জুমার নামাজের বিরতিতে মুসল্লিদের কাছে দুটি বাক্স আসেÑএকটিতে মসজিদের তহবিল লেখা, অপরটি ইমাম সাহেব। কেউ মসজিদের বাক্সে, কেউ ইমাম সাহেবের বাক্সে দেন। কেউ উভয় বাক্সে দান করেন। মুয়াজ্জিনের কিছু নেই। শুধু ভালোবাসা, ভালো মানুষ, আর কিছু নয়, এটুকুই আশা।

যেজন করিছে মুগ্ধ মন, দিয়েছে খাদ্য প্রাণে, অবহেলায় করিছে জীবন যাপন। সুরের মূর্ছনায় মুসল্লির প্রাণ জোড়ায়। এ মধুর কণ্ঠে যদি গান গাঁথা যেত, অবহেলিত জীবন নয় অর্থ শত শত। ঐ দেখ ঐ শুকতারা, বনভূমি মন মাতোয়ারা। চাঁদ ভেসে ওঠে, চাঁদ ডুবে যায়, ঝড়ো হাওয়া বাদল ঘনায়। এমনও হয়নি কখনো, আজান নাহি ভাসে আকাশে-বাতাসে কোনায় কোনায়। সেই মধুক্ষণ, আসমানী শ্রবণ, মুয়াজ্জিনের সুর। কে সেই জন, দিয়ে যায় মধুক্ষণ, ওরে আর কেহ নয় আমাদের স্বজন, অবহেলিত সেই জন মুয়াজ্জিন।