নূরুল ইসলাম : জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে অনেকটা একাই বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। জীবনের শেষ বেলায় এসে তিনি পরিবার, স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের সান্নিধ্য থেকেও বঞ্চিত। সরকারের রোষানলে পড়ে কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবাও পাচ্ছেন না। দীর্ঘ সময় কারাবাসের পর এখনো তিনি সরকারের নজরবন্দী।
বাংলাদেশের বড় দুই দলের একটি বিএনপি। অতীতে সামান্য ইস্যু হলেও বৃহৎ আন্দোলন ও ভূমিকা দেখাত দলটি। কিন্তু দলীয় চেয়ারপারসন বন্দী হওয়ার পর আন্দোলন হয়নি, সাজা হওয়ার পরও আন্দোলন হয়নি, এখন মৃত্যুপথযাত্রী খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিশ্চিতেও কার্যত কোনো আন্দোলন হচ্ছে না। মাঠপর্যায়ের নেতারা খালেদার মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য আন্দোলনের অপেক্ষায় থাকলেও দলীয় হাইকমান্ডের রহস্যজনক নীরবতায় তারাও মাঠে নেই। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্বাচিত বিএনপির এমপি-মন্ত্রীরাও খালেদা ইস্যুতে একেবারে চুপ। শুধু শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব কিংবা এমপি-মন্ত্রী নন, দলটির নানা অঙ্গসংগঠন, আইনজীবী, চিকিৎসক, রাজনৈতিক সহযোদ্ধারাও অদৃশ্য কারণে আপসহীন এই নেত্রীর ব্যাপারে নিশ্চুপ। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো মায়ের মুক্তির জন্য কোনো বার্তা দেননি লন্ডনে থাকা পুত্র তারেক রহমানও।
পরিবারের দু-একজন সদস্যই দৃশ্যত রয়েছেন সরকারের কাছে খালেদার মুক্তির আবদার নিয়ে। অন্যদিকে দলের পক্ষ থেকে দোয়া, মিলাদ মাহফিল, অনশন, স্মারকলিপি ও মানববন্ধন করে নরম অবস্থানে থেকে সরকারকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে দলীয় প্রধানকে মুক্তি দিতে। কিন্তু তার মুক্তি আদায়ে সরকারকে চাপ কিংবা বাধ্য করার মতো কোনো কর্মসূচি এখনো দেয়নি দলটি। দলীয় হাইকমান্ডের এমন নীরবতায় ক্ষুব্ধ দলটির মাঠপর্যায়ের নেতারা। তারা বলছেন, খালেদা জিয়ার অঘটন হলে সরকারের আগে বিএনপির এমপি-মন্ত্রী ও হাইকমান্ডকেই আগে জনতা ও নেতাকর্মীদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ছবি ও নাম ব্যবহার করে অনেকেই এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন কিংবা সরকারি বা রাষ্ট্রীয় নানা পদবি পেয়ে সুবিধা নিয়েছেন। শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এখন তারা সামান্য দাঁতব্যথা, পেটব্যথা হলেই ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, নিউইয়র্কের হাসপাতালে চিকিৎসা করছেন। বাড়ি-গাড়ি, মৌজ-ফুর্তি, ভোগ-উপভোগ সবই করছেন। ১৯৯১ সালের আগে তাদের কী সম্পদ ও অর্থ ছিল, তা কমবেশি দেশের মানুষ ভালোভাবেই জানে। যে নেত্রীর অছিলায় তারা সবকিছু ভোগ করছেন, আজ তার কঠিন মুহূর্তে তারা কেন নীরব, এমন রহস্যের ভেদ করতে পারছেন না দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীরা। মৃত্যুপথযাত্রী খালেদা জিয়াকে এ পরিস্থিতিতে রেখেও দলটির অনেক সিনিয়র নেতা এখনো বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা অনেককেই ভাবাচ্ছে। দলের একটি অংশ থেকে প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপির হাইকমান্ডের কারণে আন্দোলন হচ্ছে না, নাকি বিএনপি আন্দোলন করতে ব্যর্থ।
নিজ দলের ওপরই ক্ষুব্ধ দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মী। তারা বলছেন, সম্প্রতি নরম, ঠান্ডা, হালকা গরম কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছেÑসেটা বেগম খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী করার আগে-পরে কতটুকু আন্তরিকতার সাথে দেওয়া হয়েছে, তা ইতিহাস একদিন বিচার করবে। যারা বিএনপি ও খালেদা জিয়ার নাম ব্যবহার করে ইজ্জত-সম্মান কিনেছেন, বড় বড় নেতা হয়েছেন, কেন তারা চেয়ারপারসনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারেননি বা এখনো করছেন না, তার জবাব একদিন তাদের দিতেই হবে।
খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাওয়া, শেখ হাসিনার সাথে একসঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসা কিংবা পাঁচ সংসদ সদস্যকে সংসদে পাঠানো-সবকিছুই দলের প্রেসক্রিপশন ও অনুমতিক্রমে হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির অনেক নেতাকর্মী। এসব কিছু খালেদা জিয়াকে মাইনাসের ইঙ্গিত বলেও মনে করছেন তারা। তাদের ভাষ্য, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা তারেক রহমান যদি একটা আন্দোলনের ঘোষণা দেন, তাহলে তারা অবশ্যই খালেদা জিয়ার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত।
দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন, সচেতন নাগরিক সবাই বলছেন, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হোক। তার যে রোগ হয়েছে, এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে তিনি বেশি দিন বাঁচবেন না। বাংলাদেশে তার চিকিৎসার তেমন সুযোগ নেই। লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে সবচেয়ে ভালো। কিন্তু বিএনপির নীরব ভূমিকার কারণে সরকার খালেদা জিয়ার বিষয়ে একের পর এক কঠিন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।
এ বিষয়ে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হলে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। তার মুক্তির জন্য রাজপথে রক্ত দিতে আমরা প্রস্তুত। নেতাদের বলব, আপনারা কর্মসূচি দিন।’ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল বিএনপির নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা নেত্রীর মুক্তির জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করুন। আমরা বাস্তবায়ন করব।’