ঠিকানা রিপোর্ট : ‘সত্যিটা হলো আমি আন্তোনেলার সবকিছুই পছন্দ করি। ওর মধ্যে অনেক গুণাবলী আছে; ওর ব্যক্তিত্ব, দৈনন্দিন জীবনে ওর কাজকর্ম, সবসময়ই সুন্দর মনমানসিকতার অধিকারী, সমস্যা সমাধানের চমৎকার ক্ষমতা… এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ওর বুদ্ধিমত্তা…।’ ২০১৯ সালে স্প্যানিশ ক্রীড়া দৈনিক মার্কার এক সাক্ষাৎকারে স্ত্রীর এমনই প্রশংসা করেছেন লিওনেল মেসি। মেসি এবং আন্তোনেলা রোকুজ্জোর দীর্ঘ প্রেমের কাহিনী শুরু হয়েছিল তাদের নিজ শহর রোজারিওতে। সেসময় তারা ছিলেন আট-নয় বছরের শিশু। আর্জেন্টিনার এই শহরটিতে তাদের সম্পর্ক বছরের পর বছর ধরে বিকশিত হয়েছে।
মেসি যখন ফুটবল ক্যারিয়ারের জন্য ইউরোপে চলে যান, তখন দুজনেই ভেবেছিলেন যে তাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ। অতীত শুধু মধুর স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আন্তোনেলার ব্যক্তিগত জীবনের একটি ট্র্যাজেডি তাদের আবার একত্রিত করে। আন্তোনেলাকে শান্তনা দিতে ও তার সঙ্গে দেখা করতে মেসিকে আর্জেন্টিনায় ফিরে আসতে হয়। তারপর থেকেই তারা জোড়মানিক, আর আলাদা হননি। কাতার বিশ^কাপ-২০২২ বিজয়ের মাধ্যমে আর্জেন্টিনা তৃতীয় শিরোপা পাওয়ায় এখন এই দম্পতি উদ্যাপনের আরেকটি দুর্দান্ত কেন্দ্রবিন্দু। মেসির জন্য এটি পঞ্চম বিশ্বকাপ। ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে অর্থাৎ ২০০৬ সালে জার্মানি থেকে শুরু করে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০১৪ সালে ব্রাজিল, ২০১৮ সালে রাশিয়া এবং এবার কাতার ২০২২ সর্বত্রই তাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে এসেছেন আন্তোনেলা। আর এবার বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়ে মেসি তাকে এবং সমগ্র জাতিকে করেছেন আনন্দিত ও গর্বিত।
কে ভেবেছিল যে শিশু মেসি ও আন্তোনেলা ২০ বছরেরও বেশি সময় পরে একসাথে থাকবেন এবং কাতারে আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিশ্বকাপ জয় উদ্যাপন করবেন। ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আন্তোনেলা তড়িগড়ি স্বামীর সাথে লুসাইল স্টেডিয়ামের মাঠে তার সর্বকালের সেরা কৃতিত্ব উদ্যাপনে যোগ দেন। সাথে ছিল এই দম্পতির তিন ছেলে থিয়াগো, মাতেও এবং সিরো। বাবা এবং আর্জেন্টিনা দলকে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে কাপ জিততে দেখে তারাও আবেগাপ্লুত।
ছোটবেলায় নেয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবে শিশু ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন লুকাস স্কাগলিয়া ও লিওনেল মেসি। এই সুবাদে তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। লুকাস ছিলেন আন্তোনেলার চাচাতো ভাই। ১৯৯৬ সালের গ্রীষ্মে লুকাস মেসিকে তার পরিবারের সাথে ছুটি কাটানোর আমন্ত্রণ জানান। মেসিও রাজি। তখন মেসির বয়স সবেমাত্র ৯ বছর। আর আন্তোনেলার বয়স ৮।
লুকাসের বাড়ি গিয়েই আন্তোনেলার সঙ্গে দেখা মেসির। প্রথম দেখাতেই ভালো লাগা। সেই শুরু। এরপর সময় পেলেই তারা হই-হুল্লোড় করে বেড়াতেন। সমবয়সী বন্ধুদের সাথে রাস্তায় নেমে খেলতেন।
মেসির ১১ বছর বয়সে গ্রোথ হরমোন ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার এক হতাশাজনক খবর পাওয়া যায়। এই খবর তার পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু তার বাবা হোর্হে মেসি সন্তানের চিকিৎসার ব্যয় মিটাতে এবং কোনো একটি ফুটবল টিমে ছেলেকে স্থান করে দিতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেন।
অবশেষে এফসি বার্সেলোনার শিশু বিভাগে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ১৩ বছর বয়সে ২০০০ সালে মেসি তার স্বপ্ন পূরণ করতে স্পেনে চলে যান। বছরের পর বছর ধরে মেসি ক্লাবে মর্যাদা ও সুনাম অর্জন করেন, দ্রুত ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। এর মধ্যেও তিনি রোজারিওতে থাকা আন্তোনেলার কথা ভাবতেন। কিন্তু তাকে কোনো সাহায্য করতে পারতেন না।
আন্তোনেলা তার নিজ শহরে ‘দাঁতের চিকিৎসা’ নিয়ে পড়াশোনা করেন। ২০০৭ সালে আন্তোনেলার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। ভেঙে পড়েন আন্তোনেলা। ক্রমশই তার ওজন কমে যাচ্ছিল। এই খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আর্জেন্টিনার ফ্লাইট বুক করেন মেসি। বার্সেলোনা থেকে চলে যান রোজারিওতে। পুনরায় মিলিত হন দুজন এবং ভবিষ্যতে তারা একসাথে থাকার পরিকল্পনা করেন। অবশেষে পুরানো জীবনকে পিছনে ফেলে মেসির সাথে বসবাস করার জন্য ২০১০ সালে আন্তোনেলা চলে যান স্পেনে। আন্তোনেলা বার্সেলোনার কাস্টেলডেফেলস-এ মেসির বাড়িতে চলে আসেন, দম্পতি হিসেবে তাদের জীবন শুরু করেন। ২০১২ সালের ২ নভেম্বর তাদের প্রথম সন্তান থিয়াগো মেসি জন্মগ্রহণ করেন।
মেসির ক্যারিয়ার যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে তার পরিবারও। ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাদের দ্বিতীয় পুত্র মাতেও জন্মগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের ১১ মার্চ তাদের তৃতীয় পুত্র সিরো জন্মগ্রহণ করে।
২০১৭ সালের ৩০ জুন এ দম্পতি বিয়ে করেন। নিজ শহর রোজারিওর সিটি সেন্টার হোটেলে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। দানি আলভেস, জেরার্ড পিকে, নেইমার, সার্জিও আগুয়েরো, স্যামুয়েল ইতো, কার্লেস পুয়োল, জাভি হার্নান্দেজসহ আরও অনেক ফুটবল তারকা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
আন্তোনেলা শুধুই মেসির স্ত্রী বা তার সন্তানদের মা নন, তিনি লিওনেল আন্দ্রেস মেসির শৈশব থেকে কিংবদন্তি ফুটবলার হয়ে ওঠার সাক্ষী। একজন বিশ্বখ্যাত তারকা হয়েও মেসি শুধুমাত্র আন্তোনেলাতেই আসক্ত, তাদের দুজনকে নিয়ে নেই কোনো বিতর্ক। ব্যক্তিগত সম্পর্কে বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মেসি-আন্তোনেলা।
গত ১৮ ডিসেম্বর এই ক্ষুদে জাদুকর বিশ্বকাপ জিতেছেন এবং নিজেকে প্রমাণ করেছেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে। আর মেসির জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় এই দিনটিতেও তার পাশে ছিলেন স্ত্রী আন্তোনেলা রোকুজ্জো। তিনি মেসির হাজারো অর্জনের, সুখ-দুঃখের মুহূর্তের সাক্ষী।
ক্যারিয়ারের পাশাপাশি মেসিকে বলা যায় পুরোদস্তুর ‘ফ্যামিলি ম্যান’, ব্যক্তিগত সম্পর্কে বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মেসি ও আন্তোনেলা।
বার্সেলোনার হয়ে ট্রেবলসহ অসংখ্যা শিরোপা জেতার সৌভাগ্য হয়েছে মেসির। প্রতিটি ইভেন্টেই তার পাশে থেকে সমর্থন দিয়েছেন আন্তোনেলা।
বার্সেলোনার মেসি ‘আর্জেন্টিনার মেসি’ হয়ে উঠতে পারেননি, এই অপবাদের বোঝা বহু বছর বয়ে বেড়াতে হয়েছে মেসিকে। জাতীয় দলের হয়ে ট্রফি জিততে না পারায় দেশের মানুষের অবজ্ঞার পাত্র হয়েছেন। কিন্তু তবুও হাল ছাড়েননি মেসি, স্বপ্ন দেখেছেন সবসময়; আর এই পুরো সময়টা তার পাশে ছিলেন আন্তোনেলা।
গত বছর কোপা আমেরিকা ও ফাইনালিসিমা জিতে অপবাদ ঘুচিয়েছেন মেসি। আর কাতার বিশ্বকাপে মেসি ম্যাজিকই ছিল টুর্নামেন্টের মূল আলোচনার বিষয়। নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন মেসি। জিতেছেন বিশ্বকাপ, গোল্ডেন বল, ৫টি ম্যাচসেরার পুরস্কার। আর এই কাতার বিশ্বকাপেও প্রতিটি ম্যাচে সন্তানদের নিয়ে স্টেডিয়ামে ছিলেন আন্তোনেলা।
বিশ্বকাপ জয়ের পর ইনস্টাগ্রামে স্বামীকে নিয়ে আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন আন্তোনেলা রোকুজ্জো। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা এই পোস্টে আন্তোনেলা বলেন, ‘আমি ঠিক জানিনা কীভাবে শুরু করবো। আমরা তোমার জন্য প্রচণ্ড গর্ব অনুভব করি। তুমি (মেসি) শেষ পর্যন্ত লড়েছ, তুমি আমাদের শিখিয়েছো জীবনে হাল ছাড়তে নেই।’ এছাড়াও বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের দীর্ঘ যাত্রায় মেসির সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে আন্তোনেলা বলেন, ‘অবশেষে তুমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আমরা জানি তুমি এই বিশ্বকাপ ট্রফির জন্য বহু বছর সংগ্রাম করেছো।’