যদি জিন্নাহর রোগের কথা জানা যেত

বিশ্বচরাচর ডেস্ক : পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। পরে তিনি ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেলও হয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় আরো এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ, যাকে বলা হয় কায়েদ-এ-আজম। ভারত বিভাজনের প্রক্রিয়া নিয়ে যখন আলোচনা চলছিল তখন জিন্নাহর দূরারোগ্য একটি ব্যধি হয়েছিল। অথচ অজ্ঞাত কারণে সেই কথাটি গোপন রাখা হয়েছিল। যদি এই রোগের কথা জানাজানি হয়ে যেত তাহলে কি দেশভাগ আটকানো যেত? বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে বিবিসি।
গত ১৪ অক্টোবর ব্রিটিশ এই গণমাধ্যমটি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে লেখা হয়, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ২ জুন লন্ডন থেকে দিল্লি আসেন। ‘নর্থ কোর্ট’ ভবনে ভারতীয় রাজনীতির রথী-মহারথীদের সঙ্গে এক বৈঠক ডাকলেন দেশভাগের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য। মাউন্টব্যাটেন নেতাদের জানিয়েছিলেন, তারা যেন মধ্যরাতের আগেই নিজের মতামত তাকে জানিয়ে দেন। বৈঠক থেকে জিন্নাহ বেরিয়ে যাওয়ার পরে লর্ড মাউন্টব্যাটেন খেয়াল করেছিলেন যে মিটিং চলার সময়ে সামনে রাখা একটা কাগজে কিছু আঁকিবুঁকি কেটেছেন তিনি। সেখানে বড় অক্ষরে লেখা ছিল দুটো শব্দ গভর্নর জেনারেল। তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে তিনি নিজের জন্য কোন পদের কথা ভাবছিলেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে আরো লেখা হয়, জিন্নাহ নিজে বিশ্বাস করতেন যে তিনিই পাকিস্তান তৈরি করেছেন। ‘ফ্রম প্ল্যাসি টু পাকিস্তান’ গ্রন্থে হুমায়ূন মির্জা লিখেছেন, পাকিস্তানের এক সময়কার প্রতিরক্ষা সচিব ইসকান্দার মির্জা (যিনি পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন) জিন্নাহকে বলেছিলেনযে মুসিলম লীগ পাকিস্তান দিল, সেই দলটাকে যেন অবহেলা করা না হয়। সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘কে বলল মুসলিম লীগ আমাদের পাকিস্তান দিয়েছে? আমি পাকিস্তান বানিয়েছি, আমার স্টেনোগ্রাফারের সাহায্যে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, খুব কম লোকেই জানতেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই জিন্নাহর শরীরে বাসা বেঁধেছিল এক মারণ রোগ। তার চিকিৎসক ডা. জাল প্যাটেল এক্সরে প্লেটে চোখ রেখেই দেখতে পেয়েছিলেন ফুসফুসে ছোপছোপ দাগ। কিন্তু তিনি সবার কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন ব্যাপারটা। এখন অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, যদি এটা জানাজানি হয়ে যেত যে জিন্নাহর আয়ু আর খুব বেশি দিন নেই, তাহলে কি দেশভাগ আটকানো যেত? এ ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেছেন, ডাক্তার প্যাটেল খুবই পেশাদার চিকিৎসক ছিলেন। সেজন্যই কারও কানেই তোলেননি জিন্নাহর অসুস্থতার কথাটা। তবে সম্ভবত লর্ড মাউন্টব্যাটেন জানতেন। সেজন্যই স্বাধীনতার তারিখটা ১৯৪৮ এর ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় মাসের মতো এগিয়ে এনেছিলেন তিনি। হয়তো তার ভয় ছিল অতদিন দেরী করলে যদি জিন্নাহ মারা যান যদি গান্ধীজি, নেহেরু বা সন্দার প্যাটেলদের কাছে জিন্নাহর অসুস্থতার খবর পৌঁছাত, ওঁরাও হয়তো নিজেদের নীতি বদলে ফেলতেন। কারণ পাকিস্তান আন্দোলন আর পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা একজন মাত্র ব্যক্তির ওপরেই নির্ভরশীল ছিল। তিনি হলেন জিন্নাহ।
১৯৪৮ এর মার্চ মাস থেকেই জিন্নাহর স্বাস্থ্য বেশ খারাপ হতে শুরু করেছিল। বোম্বে থেকে তার এক পুরনো বন্ধু জামশেদ করাচি গিয়েছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। সরকারি আবাসের বাগানে একটা চেয়ারে বসে ঢুলছিলেন জিন্নাহ। চোখ খুলে পুরনো বন্ধুকে দেখতে পেয়ে তিনি ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘জামশেদ, আমি খুব ক্লান্ত। ভীষণ ক্লান্ত।’ তখন তার বয়স ৭২ বছর। জীবনের শেষ দিনগুলোতে খুব কষ্ট পেতে হয়েছে তাকে। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বরকোয়েটা থেকে ভাইকিং বিমানে চাপিয়ে করাচী নিয়ে আসা হয় জিন্নাহকে। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত জিন্নাহর ওজন তখন মাত্র ৪০ কিলোগ্রাম।
করাচীর মৌরিপুর বিমানবন্দরে তার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তার সামরিক সচিব। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি। সামরিক সচিব ছাড়া অন্য কেউ বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন না। যে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে গভর্নর হাউজে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, মাঝপথে সেটার জ্বালানি শেষ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টার পর ঘণ্টাখানেক পর আরেকটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় হয়। অ্যাম্বুলেন্সেই তার পালস কমে আসছিল। সেই রাতেই তিনি মারা যান।