বিশেষ প্রতিনিধি : দেশের অর্থনৈতিক বাস্তব চিত্র আর লুকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। তা চাপা দেওয়ার মতো ধামাও আর অবশিষ্ট নেই। গোঁজামিল করা যাচ্ছে না কূটনৈতিক হাল-হকিকতও। একেক সময় একেক কথা ও অতিচাতুরীতে গোমরটা ফাঁস হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অতিচাতুরীর ‘বাংলা খেলা’ বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে বারবার। এবার হয়েছে নোংরাভাবে।
বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা এখন আর চাপা দেওয়ার ধামা দৃশ্যত নেই। দুই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৫৫ কোটি ডলারে। সঞ্চয় ভেঙে সংসার চলছে অনেকের। প্রবাসী আয়ের ক্ষরার তীব্রতা লুকানোর মতো নয়। গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে সেপ্টেম্বর মাসে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ কমে এই মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর গত আগস্টের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ২৪.৪ শতাংশ। রপ্তানি অবিরাম নিম্নমুখী। গর্ব করে জানান দেওয়া উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থবিরতা।
বাস্তবের চেয়ে বাড়িয়ে, সামর্থ্যরে থেকে বেশি ফাঁপিয়ে বলে পরিস্থিতি সামলানোর জেরে যেসব সমস্যায় পড়তে হয় বাংলাদেশ এখন তারই শিকার। ডলার সংকট ও রিজার্ভের চাপে চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৪৫৫ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। আমদানি ব্যয়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কম হওয়ায় অর্থবছরের শুরুতেই বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর পরও হাল ছাড়ছে না সরকার। নানান উটকো ইস্যুতে মূল ও বাস্তব সত্যকে ছাইচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
অর্থনীতির পাশাপাশি কূটচাতুরীও মার খেতে বসেছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র ইস্যুতে। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দাঁড়িয়েই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেশীয় স্টাইলে মারমুখী বক্তব্য দিয়ে মিডিয়া কাভারেজ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের কথা বলে, আবার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়ও দেয় বলে দেশটির তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। আবার সেখানে লবি ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করে দিতে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতা ও ব্যবসায়ীদের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন, ‘মার্কিন রাজনীতিকদের সঙ্গে খাতির গড়ে তুলতে। সিনেটর-কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে সরকারের কল্যাণে তা ব্যবহার করতে। একই সঙ্গে মার্কিন বিদ্বেষ এবং মার্কিনিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার পারস্পরিক অ্যাজেন্ডায় বিব্রত দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
আওয়ামী লীগ বরাবরই বিশ্বের সেরা বিদ্যা, বুদ্ধি ও শক্তিতে বলীয়ান যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে এগোয়। রহস্যজনক ব্যতিক্রম হয়েছে কেবল মার্কিন প্রভাবিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রকে নয়, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন শক্তিকে গোলকধাঁধায় ফেলে টানা ক্ষমতা কব্জা করে নিয়েছে সরকার। যার সুফল চলমান এখনো। তবে সামনের দিনগুলোতে তা আর করা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের মতিগতিতেও তা স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে একেক দিন একেক কথা বলছেন, ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও তখন মুখ চালান সমানে। নির্বাচন কমিশন, দুদক কার্যালয়, মন্দিরসহ নানান জায়গায় চলে যাচ্ছেন। সরকারকে টার্গেট করে ব্যবসা চাইলে গণতন্ত্র দিতে হবে, মানুষকে মতপ্রকাশ ও স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে ধরনের কথা বলেই চলছেন তার পূর্বসূরিদের মতো। যা করতে গিয়ে অপমানিত এমনকি লাঞ্ছিতও হয়েছেন তারা।
হাসের পূর্বসূরি ড্যান মজিনাকে কটাক্ষ করা হয়েছে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ নামে। মার্শা বার্নিকাটের গাড়িতে হয়েছে হামলা। এমনকি বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে। এ অবস্থার মাঝেও হাল ছাড়ছেন না মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
ঢাকায় কর্মরত বিদেশি অন্য কূটনীতিকরাও বসে নেই। রীতিমতো সংলাপের দায়িত্বে নেমেছেন তারা। চলে যাচ্ছেন বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে। অন্যান্য দেশের কূটনীতিকেরাও থেমে নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস উইটলি তো জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সাথে মিটিং শেষে সেই মিটিংয়ের একটি ছবিই টুইট করে দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে বিভিন্ন দলের সঙ্গে তাদের নিয়মিত সংলাপ চলবে। আরো ইন্টারেস্টিং ঘটনা হচ্ছে, এই টুইটটি আবার অন্যান্য মিশনপ্রধানরা রিটুইট করেছেন। সরকার রাজনৈতিক দলেগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসছে না। কিন্তু ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের এ দেশের দলগুলোর সঙ্গে ‘নিয়মিত’ সংলাপ-রাজনীতি-কূটনীতিতে এক নতুন সংযোজন। সব রাজনৈতিক দল তাদের সাথে কথা বলে স্বস্তি পায়।
বিদেশি কূটনীতিকরাও বিষয়টি বেশ এনজয় করছেন। এটি ইসির সঙ্গে সংলাপ করে রাতের ভোটের শঙ্কার বদলে দূতাবাসে সংলাপ করে দিনের ভোটের গ্যারান্টির চেষ্টা বলে ধারণা রাজনীতি বিশ্লেষকদের। কয়েকটি দূতাবাস থেকে ‘সহিংসতা ও ভয়ভীতিমুক্ত অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ নির্বাচনের ভরসাও পাচ্ছেন বিরোধী মতের রাজনীতিকেরা। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এর জেরেই তুলনামূলক জোর পাচ্ছে বিরোধী দলগুলো। তাদের আন্দোলন নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে। তাদের কর্মসূচিতে জনসমাগম বাড়ছে। নেতাদের বক্তৃতার ভাষা বদলাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে ডাবল অ্যাজেন্ডা
রাজনীতির অন্দরমহলে কূটনৈতিক রোমান্টিকতা