যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি রহস্য

আব্দুল কাইউম আনোয়ার :

আমাদের এই গ্রহে অর্থাৎ পৃথিবীতে ১৭০টির মতো রাষ্ট্রে, তা গণতান্ত্রিক কিংবা অগণতান্ত্রিক সরকার হোক, সবার সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বহু লিখিত নথি সংরক্ষণ করতে হয়। সেগুলোর কোন কোনটি অতিব গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয়। সুতরাং সব রাষ্ট্রই সেসব নথিকে অধিক হেফাজতে সংরক্ষণ করে থাকে বৈকি।

পরাশক্তি হিসেবে বর্তমান বিশ্বে আছে কেবল যুক্তরাষ্ট্রই। এইতো মাত্র দু’তিন দশক আগেও পরাশক্তিধর আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো সোভিয়েত রাশিয়া। বর্তমানে যদিও সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার দৌরাত্ম্য আগেকার ধাপে বিরাজ করছে না, কিন্তু নীরবে পরাশক্তির প্রতিযোগিতা চালু আছে। আর প্রতিযোগিতা যেখানে সচল, সেখানে দুই শক্তিই সরকারি নথি চুরি করার প্রয়াস পায়। স্পাইং করতে গিয়ে স্পাইরা প্রায়ই ধরা পড়ে এবং ভীন দেশের কারাগারে নিকৃষ্ট জীবের জীবনযাপন করে। তাইতো স্পাইদের খপ্পর থেকে সেইসব গোপন দলিলপত্র অতি সাবধানে রাষ্ট্রীয় আমানত-খানায় প্রহরীবেষ্টিত রাখতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে সেই আমানতখানাকে ‘আরকাইভ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এসব গোপন নথি দায়িত্বে থাকাকালীন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টদের জিম্মাদারিতে থাকে। তাদের শাসনামল সম্পন্ন হলে সেসব নথিসমূহ জাতীয় সংগ্রহশালায় (National Archive) সংরক্ষিত হয়, অন্য কোথাও নয়।

জানি না, বর্তমান ও পূর্বতন দুই প্রেসিডেন্ট- জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়া অন্য কোন প্রেসিডেন্টের বেলায় রাষ্ট্রীয় গোপন নথি অরক্ষিত রাখার ব্যতয় হয়েছিলো কি-না। তবে বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিমন্ডলে প্রেসিডেন্টদ্বয়ের অবহেলিত কর্মকাণ্ডের লেলিহান শিখা অধিক প্রজ্বলিত হচ্ছে। পূবর্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চার বছরের মেয়াদ শেষে তাঁর আমলের সব রাষ্ট্রীয় গোপন নথি বাক্সবন্দী করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বর্তমান বাসস্থান ফ্লোরিডায় মার-এ-লাগো রিসোর্টে। যা ছিলো রাষ্ট্রীয় আইনে সম্পূর্ণ অবৈধ্য। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (FBI) ফ্লোরিডার সেই বাসস্থানে তল্লাশি চালিয়ে দুই দফায় একাধিক বাক্সভর্তি গোপন ও অতি গোপনীয় নথিগুলো উদ্বার করে জাতীয় সংগ্রহশালায় নিয়ে আসে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ব্যক্তিগত ও সরকারি কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদী ও ঘোর সমালোচক যেখানে ট্রাম্প ও তার দল রিপাবলিকান পার্টি, সেখানে প্রতিপক্ষকে হেয় ও অভিযুক্ত করার শক্ত হাতিয়ার কবলে এসেছিলো ডেমোক্র্যাট পার্টির। অবসরপ্রাপ্ত ট্রাম্প ২০২০ সালে ভোটাভুটিতে হেরে গিয়েও পরাজয় মেনে নেননি বরং ২০২৪ সালে ফের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। অথচ ট্র্যাম্পের মিথ্যাচার ও ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলে আক্রমণকারীদের উস্কানিদাতা হিসেবে রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ তাঁকে নিন্দা জানিয়ে আসছে। এই পরিস্থিতিতে বাইডেন ও তার সমর্থকদের হয়েছিলো পোয়াবারো। ট্রাম্পকে সর্বক্ষেত্রে, এমন কি ট্যাক্স ফাঁকি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করা ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত করে বাইডেনপন্থীরা আগামী ২০২৪ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের জয়ের পতাকা উড্ডয়ন করতে পারবে বলে স্বস্তি লাভ করছিলো। সেই সূর্যালোকিত আকাশে অকস্মাৎ মেঘের ঘনঘটা শুরু হলো। এটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড প্রেসিডেন্ট বাইডেনেরই মনোনীত এবং নিয়োগপ্রাপ্ত, কিন্তু কর্মপরিমণ্ডলে তাকে সততার খাতিরে নিরপেক্ষ থাকতেই হবে। নয়তো সমালোচকদের তোপের মুখে পড়তে হবে। তাইতো নিজের দায়িত্বকে স্বচ্ছতা দিতে গিয়ে ট্রাম্পের বেআইনী কার্যকলাপের অসঙ্গতি তদন্তের লক্ষ্যে জ্যাক স্মিথ নামের একজনকে বিশেষ পরামর্শদাতা নিয়োগ করেছেন।

অন্যদিকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বেলায় পূর্বতন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমতুল্য না হলেও একই ধারার অভিযোগ বাজারে রটে গেছে। ২০২২ সালের ২ নভেম্বর বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ওয়াশিংটন ডিসির তাঁর অফিসে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় গোপন নথি আবিস্কৃত হয়। আর CBS News-এর বদৌলতে ২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি তা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। এই তথ্যের জের ধরে FBI প্রেসিডেন্টের ডেলাওয়ারস্থ নিজ বাসভবনে হানা দিয়ে দুই দফায় আরো নথি উদ্ধার করে এনেছে। এতে প্রেসিডেন্টকে, বিশেষ করে সাংবাদিকদেও, তীর্যক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়েছে। এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্ট বিব্রত ও বিরক্ত হয়েই বলেছেন যে, আমার মূল্যবান কর্ভেট গাড়ি যে গ্যারাজে তালাবদ্ধ, সেখানে অন্যসব জিনিসপত্রও ভালোভাবে সংরক্ষিত। সুতরাং যেসব নথিপত্র পাওয়া গেছে, সেসব যে খোলা রাস্তায় ছড়িয়ে রাখা ছিলো, তা নয়। তার অর্থ দাঁড়ায় যে, প্রেসিডেন্ট স্বজ্ঞাতে সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বাসভবনে। এই প্রক্রিয়ায় দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। ব্যবধান কেবল, ট্রাম্প প্রথমদিকে অবৈধ অপসারণ করার কথা স্বীকার করেননি এবং স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দেননি সেইসব নথিসমূহ। অন্যদিকে বাইডেনকে নথি প্রাপ্তির সংবাদ অবহতি করার সঙ্গে সঙ্গে সেসব যাতে দ্রুত আরকাইভে জমা দেয়া হয়, তার আদেশ দিতে সময় নষ্ট করেননি।

সাম্প্রতিক এই ঘটনায় কেবল যে প্রেসিডেন্ট বাইডেনই বিব্রত হয়েছেন তা নয়। এটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ডও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই রবার্ট হুর নামের আরেকজন চৌকস কাউন্সিলার নিয়োগ দিয়েছেন প্রেসিডেন্টের বিষয়টি তদন্ত করার জন্যে রিপোর্ট বের হলে জনসাধারণ তা জানতে পারবে।

তবে এটা এখন ধ্রুবতারার মতো স্পষ্ট যে, প্রেসিডেন্টের অদম্য খাঁটুনির প্রতিফল হিসেবে বিগত বছরের সরকার যেসব কঠিন ঝুঁকি, যেমন- দু’বছরের কোভিড মহামারী থেকে উত্তরণ, দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি রোধ, তদুপরি গেলো মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচনে বিরোধীদলের অপপ্রচার এবং সর্বশেষ বাজেট পাশ করা সম্ভব হয়েছিলো, তাতে ডেমোক্র্যাট সদস্য হিসেবে আমার ধারণা হয়েছিলো যে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দ্বিতীয় দফা (২০২৪ সালে) নির্বাচনে জয়ের পথ সুগম হবে। এখনও বেশ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে প্রেসিডেন্ট ও তার সরকারকে। তবে দু’বছর সময়ের ব্যবধানে জাতীয় নির্বাচনের সম্মুখীন হবার আগে এই সরকারকে কর্ম-যাদু দেখিয়ে জনগণের সন্তুষ্টি লাভ করতে হবে। নতুবা এই গোপন নথি রহস্যই প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্র্যান্টিক পার্টিও জন্য কাল হবে বৈকি!

-জানুয়ারি ২৩, ২০২৩।