যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি গঠন : টানেলের শেষ প্রান্তে আশার আলো

ঠিকানা রিপোর্ট : দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় পর যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি গঠনে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এতে ঝিমিয়ে পড়া ও হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীরা নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছেন। কমিটি গঠনের সম্ভাবনা উঁকি দেওয়ায় এখানকার নেতাকর্মীরা দারুণ উচ্ছ্বসিত। তাদের বিশ্বাস, শিগগিরই গঠিত হতে যাচ্ছে বহুল কাক্সিক্ষত যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি।
প্রায় ১৩ বছর আগে আবদুল লতিফ সম্রাট ও জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি ভেঙে দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। এরপর আর নতুন কমিটি গঠন করা হয়নি। বারবার দাবি জানানোর পরও কমিটি গঠিত না হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা। অনেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। দলে দেখা দেয় কোন্দল-বিভক্তি। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন নেতাকর্মীরা। কমিটি না থাকায় দলীয় নানা কর্মসূচি পৃথকভাবে পালন করতেও দেখা যায়। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ডে নেমে আসে স্থবিরতা। এ অবস্থায় ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট গঠন করা হয় নিউইয়র্ক স্টেট, নিউইয়র্ক উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। তারা আশায় বুক বাঁধেন, এবার হয়তো গঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি। কিন্তু এই তিন কমিটি গঠনের পরও ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু মূল কমিটি গঠিত হয়নি। সর্বশেষ গত ২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সহসভাপতি গিয়াস আহমেদ ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা মিজানুর রহমান ভুইয়া মিল্টন দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। এর এক সপ্তাহ আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আবু সাইদ আহমদ কেন্দ্রীয় যুবদলের অনুমোদিত কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদমর্যাদায় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এবং ইলিয়াস খান সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে মনোনীত হন। দীর্ঘ এক যুগ পর কেন্দ্রীয় বিএনপি ও যুবদলের কমিটিতে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির পাঁচ নেতার স্থান পাওয়াকে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি গঠনের পূর্বাভাস বলে মনে করছেন এখানকার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নেতাকর্মীরা।

লন্ডন সফররত যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতৃবৃন্দের সাথে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতৃবৃন্দ।


প্রবাসে বিএনপির যত সংগঠন আছে, এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির গুরুত্ব সর্বাধিক। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে দেশের জেলা কমিটির সমমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। দেশের রাজনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখে এটি। কেন্দ্রীয় বিএনপির ঘোষিত সকল কর্মসূচি এখানে পালিত হয়। যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি রাখে অগ্রণী ভূমিকা। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক অথবা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্দোলন; গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন; যুক্তরাষ্ট্রের মেইন স্ট্রিমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা; জাতিসংঘের কাছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরা; বর্তমান সরকারের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এখানে জনমত সংগঠিত করা; প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে এলে তাকে কালো পতাকা প্রদর্শনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ ও পুলিশি নির্যাতনের ভয়ে দেশে কেন্দ্রীয়, মহানগর, জেলা, উপজেলা কমিটি যেসব কর্মসূচি পালন করতে পারে না, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নির্বিঘ্নে তা পালন করতে পারে। তাই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারাও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে মর্যাদার চোখে দেখেন।

লন্ডন সফররত যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতৃবৃন্দের সাথে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতৃবৃন্দ।


দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে প্রবাসে দলকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সূত্র জানায়, তারেক রহমানের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ছয় নেতা লন্ডনে যান। তারা হলেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক জিল্লুর রহমান জিল্লু, বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও সাবেক কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াস আহমেদ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির সদস্যসচিব মিল্টন ভুইয়া, বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ
জসিম ভূঁইয়া, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি আলহাজ বাবর উদ্দীন ও বিএনপি নেতা মোশাররফ হোসেন সবুজ। ১ মার্চ লন্ডনের স্থানীয় একটি হোটেলে তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। লন্ডনের ওই বৈঠকের পরদিনই সফরকারী তিন নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পান।
সূত্র জানায়, তারেক রহমানের সঙ্গে ছয় নেতার আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি গঠনই ছিল প্রধান ইস্যু। তারা তারেক রহমানকে বলেন, দলকে শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রয়োজন। সরকারবিরোধী আন্দোলন ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে একক প্ল্যাটফর্ম থেকে কাজ করতে হবে। তারা তারেক রহমানকে আরো বলেন, আপনি যে কমিটি দেবেন, তা আমরা মাথা পেতে নেব। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতাকর্মীরা আপনার সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবে। তারেক রহমান তাদের বক্তব্য মনোযোগের সঙ্গে শোনেন। তিনি নেতাদের বলেন, সবাইকে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। ঢাকার নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি গঠন করা হবে।
এ বিষয়ে বৈঠকে অংশ নেওয়া মিল্টন ভুইয়া বলেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে দলকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করতে কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা তাকে বলেছি। আমরা পদ-পদবি নিয়ে লবিং করিনি। আমরা সবাই একবাক্যে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি দেওয়ার অনুরোধ করেছি। তিনি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে আমাদের কথা শুনেছেন এবং শিগগিরই কমিটি দেবেন বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর গিয়াস আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক অথবা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রেও করার নির্দেশনা দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপিকে আরো সুসংগঠিত করার উদ্যোগ নিতে। আমরা তার নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করব।
দলীয় সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র কমিটির বিষয়ে শিগগিরই চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আন্তর্জাতিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকনসহ সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন তারেক রহমান। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চাইছেন, তড়িঘড়ি নয়, কিছুটা সময় নিয়ে সবার সঙ্গে পরামর্শ করে কার্যকর একটি কমিটি উপহার দিতে, যারা প্রবাস ও দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এদিকে লন্ডন সফরে গিয়ে ছয় নেতার তারেক রহমানের সাক্ষাৎ লাভ এবং তাদের মধ্যে তিনজন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনীত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির বেশির ভাগ নেতাকর্মী ভীষণ উচ্ছ্বসিত। তারা মনোনীত নেতাদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এ ঘটনায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া নেতাকর্মীরাও ফের উজ্জীবিত হয়েছেন। দীর্ঘ বছর পর এবার যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি গঠিত হবে বলে তারা প্রত্যাশা করছেন। অনেকে দলীয় পদ-পদবি পেতে লবিংও শুরু করেছেন। এককথায় এখানকার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে।
জেএফকেতে ফুলেল সংবর্ধনা : লন্ডন থেকে গত ৬ মার্চ সোমবার মধ্যরাতে নিউইয়র্কে ফিরে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতৃবৃন্দ। জেএফকে বিমানবন্দরে পৌঁছলে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা তাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এসময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন যুক্তরাজ্য সফরকারী দলের নেতৃবৃন্দ। পরে জেএফকে বিমানবন্দর থেকে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের নবান্ন পার্টি সেন্টারে তাৎক্ষণিক এক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেখানে তারেক রহমানের ১৭তম কারাবন্দি দিবস উপলক্ষে তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে বিশেষ মোনাজাত পরিচালিত হয়। এসময় যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ৩ নেতাকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য স্থানীয় বিএনপি এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে ছয় নেতার লন্ডন সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জ্যাকসন হাইটসের নবান্ন রেস্টুরেন্টে লন্ডনের এই সফর নিয়ে তারা তাৎক্ষণিক ক্ষোভ প্রকাশ করে সভা করেছেন। তারা বলেন, ওই ছয় নেতা যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে লন্ডনে যাননি, তারা ব্যক্তিগত কাজে গিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের স্থায়ী কমিটি ও নীতিনির্ধারণী নেতাদের কাছে তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোভাব ও মতামত বিবেচনা করা হোক। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট জামাল আহমেদ জনি। সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী আজমের পরিচালনায় সভায় বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল পাশা বাবুল, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সহসভাপতি এমদাদুল হক কামাল, নূর মোহাম্মদ, আবুল কাশেম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ারুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ, শাহ আলম প্রমুখ। সভায় টেলিফোনে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. মজিবুর রহমান মজুমদার ও সাবেক সভাপতি আব্দুল লতিফ সম্রাট ছয় নেতার লন্ডন গমনে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।