যুদ্ধ প্রস্তুতি, না চাচা আপন বাঁচা

মোহাম্মদ আনোয়ার মিঞা

মনিকা লুইনিস্কির সঙ্গে বালসুলভ যৌনাচারে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন যখন নাজেহাল হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন দেশবাসীর চিন্তাভাবনা ভিন্ন পথে ফেরানোর প্রচেষ্টায় সাদ্দাম হোসেনের নো ফ্লাই জোনের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের দোহাই দিয়ে ইরাকে বোমাবর্ষণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল তাঁর এই গোপন উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠে। প্রয়াত অভিনেতা পল নিউম্যান তাঁর সঙ্গে মুখামুখি বিরূপ মতামত প্রকাশ করেন। এমন কি জন ট্রভোল্টাকে নায়ক করে ‘টেইল ওয়াগ্্স দ্য ডগ’ বলে একটা ছবিও তৈরি হয়। দ্বিতীয় বুশের জনপ্রিয়তা যখন এতো নিচে পৌঁছায় যে, তাঁর পুনর্নির্বাচনের প্রত্যাশায় ছাই পড়ার আলামত দেখা যাচ্ছিল, তখন তিনি ৯/১১-এর পেছনে সাদ্দামের হাত আছে- এ ধরনের ষড়যন্ত্র দেখতে পেলেন! তার সঙ্গে ডব্লুএমডির রূপকাহিনী সংযোজিত করে জাতিসংঘের পরিদর্শকদের ফাইন্যাল রিপোর্টের অপেক্ষা না করে টনি ব্লেয়ারের সমর্থন আদায় করলেন। অবশেষে সৌদি আরবের শাসকদের সুপ্ত সম্মতিকে নিশ্চিত করে মুসলিম বিশ্বে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে ‘অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম’ নামকরণে ইরাক আক্রমণ করেন বুশ। এ যুদ্ধ চলাকালীন ‘নদীর মাঝখানে ঘোড়া পরিবর্তন না করার’ দোহাই দিয়ে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই যদি বিখ্যাত লেখক গোর ভিদালের মন্তব্যে বিশ্বাস করতে হয়, তবে ধরে নিতে হবে, আমেরিকার ইতিহাসে প্রেসিডেন্টরা প্রায়শ নিজেদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য যুদ্ধে জড়ায়।
এসব তত্ত্বের প্রেক্ষিতে ট্রাম্পের ক্যাবিনেটে বর্তমানে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তা খতিয়ে দেখতে হয়। উগ্র যুদ্ধবাদী মি. বোল্টকে সেক্রেটারি অব ইেট পদে নিযুক্ত করে মি. ট্রাম্প তাঁর যুদ্ধবাজ নীতিকে প্রমাণ করবেন এরূপ জল্পনা-কল্পনা প্রবল হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের পরপরই তিনি প্রথম বিদেশ ভ্রমণে যান সৌদি আরবে। সেখানে তিনি তলোয়ার নৃত্যে অংশ গ্রহণ করেন। ফিরে এসে তাঁর সাফল্যজনক পররাষ্ট্রনীতি সগর্বে প্রচার করেন। জামাতা কুশনারকে প্রধান পরামর্শকের পদে নির্যুক্ত করেন এবং প্যালেস্টাইন, ইসরাইল এবং সৌদি আরবসহ অন্যান্য কতিপয় মধ্যপ্রাচ্যের রাজধানীতে পাঠান। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর নির্বাচনকালীন ইরানবিরোধী বাকযুদ্ধকে আরো ধারালো করে প্রায় সর্বক্ষণ প্রচারণায় যেতে উঠলেন। জাতিসংঘের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে সৌদি আরবের ধ্বংসলীলায় অংশীদার হয়ে ইয়েমেন আক্রমণে মদদ দেয়ার জন্য অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছেন। অবশ্য এসব অস্ত্র বিক্রি করে নগদ ডলারও পাওয়া যাচ্ছে, সে দিকটাও ভুলে যাওয়া যায় না! বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও সৌদি প্রিন্স বিন সালমান বারবার সময়োপযোগী ইরান বিরোধী রণহুংকার দিয়ে ট্রাম্পের নীতিকে জোরদার করতে উঠে পড়ে লেগে গেলেন।
উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী নীতি এখন অবশ্য স্তিমিত হয়ে পড়েছে। তবে ইরানের প্রতি বৈরিভাবের তীব্রতায় আরো ইন্ধন যোগানো হচ্ছে।
বিগত নির্বাচনে ট্রাম্পের সহযোগীদের সঙ্গে রাশিয়ার যোগসাজস ছিলো কিনা, তা তলিয়ে দেখার জন্য বিশেষ কাউন্সেল মুলার তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রাখছেন। ট্রাম্পের সঙ্গে মুলারের বিরোধ চরমে উঠেছে। তদুপরি তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নথিপত্রও খতিয়ে দেখার জন্য সমন জারি করা হয়েছে। স্টর্মি ড্যানিয়েল ও এক প্লেবয় বানীও ট্রাম্পের সঙ্গে অভিসারে লিপ্ত হয়েছিলেন বলে প্রকাশ্যে দাবি করেছেন। তাদের নিশ্চুপ করনোর প্রয়াসে অর্থ ও হুমকি দেয়ার অভিযোগ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফলাও করে প্রতিদিন বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে।
এতোগুলো সমস্যায় জর্জরিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করবার পাঁয়তারা করছেন। ইতোমধ্যে রাসায়নিক মারণাস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে গ্রেটব্রিটেন ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় ট্রাম্প দামেস্কে আঘাত হেনেছে।
যাহোক, অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর থেকে চটজলদি অনেকগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
ইরাক যুদ্ধের প্রতি প্রথম সমর্থন দিয়ে পরে তার সমালোচনা করেছেন। রিপাবলিকানরা জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করলে, তিনি তার প্রত্যুত্তরে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য মনোভাবও প্রকাশ করে ডেমোক্রেটদের সমর্থন আদায় করার প্রয়াসী হয়েছিলেন। ট্রাম্পের হঠকারি সিদ্ধান্তের ফলে ক্যাবিনেট থেকে অনেকেই পদত্যাগ করেছেন। আবার কাউকে তিনি বহিষ্কার করেছেন। এখন ট্রাম্প নিজের পছন্দসই ক্যাবিনেট গড়ে তুলছেনÑ এ যুক্তিও দেয়া যায়।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তিনি হয়তো সমঝোতায় আসবেন। সে উদ্দেশ্যে সেই দেশের কিম আনের সঙ্গে বৈঠকে বসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ইরানের সঙ্গে চুক্তি নাকচ কওে এবং সরসারি যুদ্ধ ঘোষণা করে তাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে যাচ্ছেন। যাহোক বোল্টন, পম্পিও ও জিনা এসফালের মতো জঙ্গিবাদ ও কট্টর রক্ষণশীলদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করার প্রয়োজনীয়তা মি. ট্রাম্প এককভাবে উপলব্ধি করছেন। বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট অর্থনৈতিক যুদ্ধের সূচনা করেন। নানা পণ্যের ওপর ট্যারিফ বসিয়ে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছেন। নিজের মন মতো ক্যাবিনেটের মারফত তিনি এ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার আশা নিশ্চয়ই পোষণ করেন। শেষোক্ত উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রেসিডেন্ট তাঁর পলিসি ও আদর্শের সাফল্যার্থে জনসাধারণের সমর্থন আদায়ের জন্যও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সতর্কতার প্রয়োজনও আছে। কারণ সাজ সাজ রব তুলে তিনি হয়তো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারেন, যা থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় হবে যুদ্ধ আরম্ভ করা। আপাত দৃষ্টিতেও মনে হয়, কংগ্রেসের সদস্যরা এ সম্বন্ধে সজাগ রয়েছেন। ট্রাম্পের একগুঁয়েমির অন্যতম নির্দশন মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ। বাজেটে কিন্তু এ জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। ভেটো দেয়ার জন্য লম্ফঝম্ফ করে তিনি বাজেটে সই করতে বাধ্য হয়েছেন। বিশেষ কাউন্সেলর মুলারকে অব্যাহতি দেয়ার গুজবও অস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। একতরফাভাবে ইরান চুক্তি নাকচ করা যায় না। এ চুক্তির পেছনে জার্মানিসহ আমেরিকার আরো কয়েকটি শত্রু ও মিত্র যুক্ত আছে। এরা কেউ ট্রাম্পের সঙ্গে একমত নয়। তাঁর অসংলগ্ন উক্তি ও বক্তব্যগুলো অনেকের পক্ষে নীতিনির্ধারণে সঠিক পন্থা অবলম্বন করা সম্ভব হচ্ছে না। শেয়ার বাজারের মধ্যেও অনিশ্চয়তা এসে গেছে। এর ফলাফল কিন্তু আরো বিপজ্জনক। ওয়াল স্ট্রিট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পছন্দ করে না। অনেকের ধারণা, বুশের ইরাক আক্রমণের পেছনে শেয়ার বাজারের মন্দাবস্থাও অনেকাংশে দায়ি ছিলো। এর প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও জঙ্গিবাদের আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে পারেন। ইসরায়েল ও সৌদিদের উস্কানী তো আছেই। তথাকথিত মুসলিম বাহিনীতে পাকিস্তান প্রথমত যোগ না দেয়ার সংকল্প ঘোষণা করলেও তার সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অধিনায়ককে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিলেন। এখন ট্রেনিংদানের অজুহাত দিয়ে আরো সৈন্য পাঠাচ্ছে। গভীরভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবেÑ সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের ভূমিকা বর্তমান মুসলিম বিশ্বে প্রায় সব ধরনের সমস্যার জন্য দায়ি। কাজেই এ সম্বন্ধে সজাগ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে উঠেছে। আশা করা যায়, মি. ট্রাম্প ওয়্যার ক্যাবিনেট গঠন করলেও এতো প্রতিকূল আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত না হয়ে, ভয় দেখিয়ে তার পছন্দ মাফিক চুক্তিতে রাজি হওয়ার জন্য ইরানকে বাধ্য করবেন।
মি. ট্রাম্পের এতো অসংলগ্ন নীতি সত্ত্বেও তিনি যে ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত আছেন তাঁর প্রমাণ হলো, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের অনেক ক্ষমতা আছে। এ ক্ষমতার সুষ্ঠু প্রয়োগের ফলে জর্জ ওয়াশিংটন, লিংকন, দুই রুজভেল্ট এবং কেনেডি বিশ্ববরেণ্য রাজনীতিক এবং নেতা হতে পেরেছিলেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতারূপে লিংকনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এফডিআর শুধু দেশকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার করেননি; পৃথিবীকে ফ্যাসিবাদ থেকেও রক্ষা করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে চার্চিলের মতো কট্টর সা¤্রাজ্যবাদীকে আটলান্টিক চার্টারে সই করতে বাধ্য করে ঔপনিবেশিকতাবাদের সমাপ্তির সূচনা করেছিলেন। যদিও স্বল্পকালীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তবুও কেনেডির আদর্শ পৃথিবীর প্রত্যেক আদর্শবাদীকে আজও উদ্দীপনা দিয়ে থাকে। তাই আশা করা যাচ্ছে মি. ট্রাম্পের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও রক্ষণশীলতা দুঃস্বপ্নের মতো কাটিয়ে উঠে এই দেশ, যেই দেশ ঘোষণা করে দিয়েছিল, অল ম্যান আর ক্রিয়েটেউ ইক্যুয়েলÑ তার সঠিক পথ বেছে নিয়ে সমগ্র বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়ে যাবে।
নিউজার্সী।