
এম এ লতিফ :
যুবকেরা হলো একটি জাতির প্রধান কারিগর। সমাজ ও একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পদ হলো তরুণসমাজ। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি-সমৃদ্ধি নির্ভর করে যুবসমাজের ওপর। যেকোনো জাতির প্রাণশক্তি তাদের যুবসমাজ। যুবসমাজই জাতির আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক।
যুবসমাজ যেকোনো দেশ ও জাতির সোনালি স্বপ্ন। আজকের যুবকেরাই পরিচালনা করবে আগামী দিনের সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতিকে। যুবকদের প্রেমময় রূপ ও শক্তির কারণে দরিদ্র, নিঃসহায়, প্রবঞ্চিত ও নিগৃহীত জনতা লাভ করবে নতুন জীবন, প্রদীপ্ত হবে নব উদ্দীপনায়। কিন্তু সম্প্রতি সেই যুবসমাজের প্রতি তাকালে জাতিকে অবাক হতে হয়। কারণ, দেশ ও জাতির কর্ণধার সেই যুবসমাজ নৈতিক অবক্ষয়ের সাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তাদের অনেকেরই নৈতিক কিংবা সামাজিক মূল্যবোধ নেই। এই যুবকদের মধ্যে কেউ মাদকাসক্ত, কেউ অসামাজিক, কেউ ধর্ষক, কেউ চাঁদাবাজ, কেউ অস্ত্রবাজ আবার কেউ চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই প্রভৃতি অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত। নানাবিধ কারণ (যেমন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য, চাকরিক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা, অপসংস্কৃতি, ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাব, অভিভাবকদের আদর্শহীনতা, সমাজপতিদের অনৈতিকতা, অর্থ, অস্ত্র ও ক্ষমতার লোভ এবং বেকারত্ব) সেই যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে নিপতিত করছে। আমাদের যুবসমাজ আজকে শৃঙ্খলাহীন এক অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা এমন এক রীতিনীতিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে, যা তাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন বিকাশের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আমাদের যুবসমাজের মধ্যে যেসব নৈতিক অবক্ষয় অনুপ্রবেশ করেছে, তার মূলে রয়েছে অবাধ দুর্নীতি এবং ধর্মহীন নাস্তিক সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা। দুর্নীতি যে সমাজকে গিলে ফেলেছে, সে সমাজে আর নৈতিকতা থাকতে পারে না। দুর্নীতি যে রাষ্ট্রকে গিলে ফেলেছে, সেই রাষ্ট্রে সংস্কৃতি থাকতে পারে না।
যুবসমাজের অবক্ষয় রোধে আমাদের রাজনৈতিক নেতা ও সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অনবদ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু না, যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ হওয়ার কথা, দেখা যায়, সেই ব্যক্তিদের সহযোগিতায়, প্ররোচনায়ই যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রসার ঘটছে। সেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সমাজপতিরাই লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে ঢাকঢোল পিটিয়ে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রসার ঘটান। গান-বাজনা, বিভিন্ন অপসংস্কৃতি, খেলাধুলার নামে চলে নানা ধরনের অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও জুয়া খেলা এবং মদ্যপান। এভাবেই যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের ব্যাপক প্রসার ঘটে। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো, যেসব নেতার মাধ্যমে নৈতিক অবক্ষয় রোধ হওয়ার কথা, সেসব নেতার মাধ্যমেই যুবসমাজের অবক্ষয় বৃদ্ধি পায়। এটা শুধু দুঃখজনক নয়; বরং জাতির জন্য কলঙ্কও বটে। বড়দের থেকে নৈতিক অবক্ষয়ের প্রসার ঘটবেÑএটা কেমন কথা?
সম্প্রতি সত্য ও সুন্দরের পথ ত্যাগ করে যুবসমাজ উগ্র ও বিকৃত জীবনযাপনে উদ্্গ্রীব হয়ে উঠেছে এবং চরম অবক্ষয়ের মধ্যে জীবন খুঁজে বেড়াচ্ছে। টিভি, ফেসবুক, সিনেমা, ভিডিও, ডিশ অ্যান্টেনায় যেসব ছবি, নাচ, গান, কনসার্ট, রূপচর্চা, ফ্যাশন শো, সুন্দরী প্রতিযোগিতা, বিনোদনমূলক কুরুচিপূর্ণ ছবি, প্রোগ্রাম, নাটক ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে, তার অধিকাংশই জীবনধর্মী নয়; বরং তা আমাদের মনমানসিকতার সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসব অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ছবি আমাদের যুবসমাজকে দ্রুত অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এসব ছবিই যুবসমাজকে বেশি আনন্দদান করে বলে তাদের কাছে এগুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সমর্থ হয়। আমাদের যুবসমাজ আজ ভারতীয় অপসংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশের মেয়েরাও আজ এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই।
আধুনিক সোসাইটির নামে তারাও নাচ-গানের পার্টিতে যায়, মধ্যরাত পর্যন্ত পার্টিতে কাটায়, মদ্যপান করে, সিগারেট খায়, তাস খেলে। শরীর কসরতেও তারা যথেষ্ট এগিয়ে আছে। তারাও কুংফু, জু-ডু, কারাতে শিখছে। বক্সিংয়ে অংশগ্রহণ করে পুরুষের পাশাপাশি তারাও আজ অপসংস্কৃতির জোয়ারে গা ভাসিয়েছে। একশ্রেণির নাস্তিক সেক্যুলার ব্যবসায়ী লেখক-সাহিত্যিক নিজেদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ও স্বার্থ হাসিলের জন্য যৌন আবেদনময়ী কবিতা, গল্প, ঘটনা ও ছবি প্রকাশ করে যুবক-যুবতীদের বিপথগামী করে তুলছেন। এসব কাজে তারা শিক্ষিত সুন্দরী মেয়েদেরকে পর্যন্ত ব্যবহার করে এসব যুবক-যুবতীকে অপসংস্কৃতির অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন। আমাদের সমাজের জনগণের অসচেতনতা, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, আইন প্রয়োগে শিথিলতা ও দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে এই নৈতিক অবক্ষয়ের করালগ্রাসে নিপতিত হচ্ছে আমাদের তরুণ ও যুবসমাজ। তারা অন্ধ হয়ে গেছে, অমৃত ফেলে তারা গরল পান করে তাদের জীবনকে বিষময় করে তুলছে।
যুবসমাজের চরম অবক্ষয়ের জন্য প্রশাসন কম দায়ী নয়। প্রশাসনকে দলীয়করণ করায় দলীয় লোক ছাড়া আর কাউকে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয় না। যে দলই ক্ষমতায় যায়, সে দলের সেই সরকারই তার দলীয় লোককে চাকরি দেওয়ার জন্য হন্যে হয়ে পড়ে। দলীয় সেই লোকটি অযোগ্য ও অদক্ষ হলেও তাকে চাকরি দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
শুধু তা-ই নয়; দলীয় লোককে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণাও দেওয়া হয়ে থাকে। অযোগ্য ও অদক্ষ লোককে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার কারণে সুযোগ্য ও সুদক্ষ যুবক-যুবতীরা বেকারত্বের শিকার হয়ে যান। আর এই বেকারত্ব থেকেই নৈতিক অবক্ষয়ের সূচনা হয়ে থাকে। যেসব যুবক-যুবতী নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার, তাদের সিংহভাগই বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। অন্যদিকে দেশে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী বেকার থাকলেও প্রায় ২০ লাখ ভারতীয় প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে চাকরিরত সরকারের আশীর্বাদে। সরকার যদি নিরপেক্ষ হতো, তাহলে দলীয় লোক চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হতো না। ফলে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় অনেকাংশ হ্রাস পেয়ে যেত।
কলেজ-ভার্সিটিতে ছাত্রছাত্রীদের অবাধ চলাফেরা যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়কে চরমে পৌঁছে দিচ্ছে। ছাত্রছাত্রীর এরূপ অবাধ চলাফেরা অব্যাহত থাকলে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করা কখনো সম্ভব হবে না।
অনেক মাতা-পিতা, অভিভাবক, শিক্ষককেও দেখা যায় নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত। পিতা-মাতা, শিক্ষক, অভিভাবককে নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত দেখলে আমাদের অন্তর কেঁপে ওঠে। পিতা-মাতা, শিক্ষক ও অভিভাবক নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত থাকলে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করবে কারা? যুবসমাজ দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় দেশ ও জাতির জন্য চরম হুমকি। সেই যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধে ইসলামিক শিক্ষার আলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসা আমাদের সকলের উচিত।
লেখক : সাবেক অফিস সম্পাদক, চট্টগ্রাম সমিতি অব নর্থ আমেরিকা