আলী রীয়াজ
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ গত ৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি’ শীর্ষক এক গণবক্তৃতায় বলেছেন, ‘অতীতে বাংলাদেশ যত ধরনের রাজনৈতিক সংকট বা অনিশ্চয়তা মোকাবেলা করেছে, এখনকার সংকট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন এবং আরও গভীর’।
এ প্রসঙ্গে গত ৮ জুলাই এক আলাপচারিতায় অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এখন কথা হচ্ছে আমি কেন মনে করছি যে, এখনকার সংকট ভিন্ন ও গভীর? এখন আমরা আলোচনা করছি নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না বা বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না, অথবা খালেদা জিয়া কারাগারে আটক থাকলে তার দল ভোটে যাবে কি না এসব নিয়ে। এগুলোর গুরুত্বকে আমি খাটো করে দেখছি না। কিন্তু এর চেয়েও বড় সংকট আমাদের সামনে উপস্থিত। এ কথাগুলো স্পষ্ট করে বলা দরকার। এখনকার সংকটকে আমার কাছে গভীর বলে মনে হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশের নাগরিকেরা নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন কি না, এ নিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছি না। কাকে ভোট দেবে সেটা বিষয় নয়। নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে কি না, সমাজে এখন সেই নিশ্চয়তা অনুপস্থিত। দেশে এখন শক্তি প্রয়োগের ধারা শুরু হয়েছে। এই যেমন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত তরুণ শিক্ষার্থীদের ওপর যেভাবে হামলা হলো, তাদের বিরুদ্ধে যেভাবে মামলা দেওয়া হলো, তাদের পরিবারগুলোও এখন আতঙ্কে। যে কথাগুলো শিক্ষার্থীদের পরিবার সংবাদ সম্মেলন করে বলছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এই নিপীড়ন রোধের কোনো ব্যবস্থা নেই। বরং যারা অপরাধ করছে তারা যেন এক ধরনের দায়মুক্তি পাচ্ছে।
দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে মন্তব্য করে আলী রীয়াজ বলেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহান কিছুদিন আগে বলেছেন, ‘আমি এখন কথা বলতে খুব ভেবেচিন্তে বলি’। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘আমি যা ভাবি তা লিখতে পারি না’। আমি তো দেখছি গোটা সিভিল সোসাইটির বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ চলছে। সিভিল সোসাইটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। সিভিল সোসাইটিকে শত্রু ভাবা হচ্ছে। সংবাদপত্রে চলছে সেলফ সেনসরশিপ। সংবাদমাধ্যম ভুল করতে পারে; কিন্তু সেই ভুলটা তো বলতে হবে। ইচ্ছামাফিক তো কিছু হতে পারে না।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দেশে ভিন্নমতের কারো সমাবেশ করার অধিকার নেই। এই যেমন কোটা সংস্কার দাবি করা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের রাস্তায় দাঁড়াতেই দেওয়া হলো না। তাহলে কি দেশে অন্য কেউ সভা-সমাবেশ করতে পারবে না? সমাবেশ করার অধিকার থাকবে না? তিনি বলেন, এই সংবিধান লেখার অধিকার আমরা রক্ত দিয়ে অর্জন করেছি। সেই সংবিধানে অপরাধীরও বিচার পাওয়ার অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- তো থামছে না। কাজেই যেই সমাজে চিন্তার ক্ষেত্রে ও সমাবেশ করায় বাধা, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বাধাপ্রাপ্ত সেখানে নির্বাচন দিয়ে কী হবে
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক বলেন, সম্প্রতি আমরা দুটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেখলাম। নির্বাচন কী হয়েছে আমরা মোটামুটি সবাই জানি। এর মধ্য দিয়ে আমরা কার্যত এই ধরনের নির্বাচনকেই উৎসাহিত করছি। এখানেও নির্বাচন কমিশন যেন দায়মুক্তি ভোগ করছে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর ওপর হামলা করা হলো। তিন দিন পর প্রক্টর বললেন আমি কিছু জানি না। এখনকার এত টিভি চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে প্রক্টরের এটা না জানা সম্ভব নয়। তার মানে কী? সবকিছু জেনেও প্রক্টর বলছেন কিছু জানেন না। দায়মুক্তির সংস্কৃতি এভাবে সমাজে ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, আমি বলছি না সংকট আগে ছিল না কিংবা সংকট নতুন। আগেও সংকট ছিল, তবে ছোট আকারে ছিল। এখনকার মতো পরিস্থিতিতে আমরা অতীতে কখনও পড়িনি। ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যায়নি। তার পরেও ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি যায়নি। সেগুলো ছিল নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট। ওই পরিস্থিতিতেও সমাজে কিন্তু কথা বলা যেত। কিন্তু এখনকার যে পরিস্থিতি তা একেবারেই ভিন্ন। সমাজে এখন অসহিষ্ণুতা, ভয় ও দায়মুক্তি তৈরি করা হয়েছে। যারা এসব করছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। আমি তো দেখছি, এই সংকটের কারণে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা রক্ষণশীল সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো শক্তি সঞ্চয় করছে। এর আগে আমরা একদলীয় ও সামরিক শাসন দেখেছি। সেই ধরনের পরিস্থিতি থেকে আমরা বের হয়ে আসবো বলেই তো ’৯০-এর আন্দোলন। গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা থেকেই তো ’৮২ থেকে ’৯০ পর্যন্ত বারবার আমরা রাজপথে নেমে এসেছিলাম।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তা আসলে হাইব্রিড রেজিম বাদোআঁশলা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দৃশ্যত গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদান থাকলেও সেগুলো প্রধানত শক্তি প্রয়োগের ওপরে নির্ভর করে। ফলে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাদের এক ধরনের দায়মুক্তি দেয়া হয়। যেহেতু নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেহেতু আর সব ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা চূর্ণ করে ফেলাই হচ্ছে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার উপায়।
আলী রীয়াজ বলেন, তাই বলে কি এই সংকট থেকে বের হবার সুযোগ নেই? অবশ্যই আছে। যেকোনো সংকট থেকে বের হওয়ার মানেই হচ্ছে অগ্রযাত্রার লক্ষণ। ’৯১ সালেও আমরা সংকটে পড়েছিলাম। সবার আন্তরিকতা ছিল বলেই সেখান থেকে বের হতে পেরেছি। প্রথমে সবাইকে স্বীকার করতে হবে যে, এই সংকট মোটেই সাংবিধানিক নয়, এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সংকট। সংবিধানের দিকে তাকিয়ে সমাধান খুঁজলে তো হবে না। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের দায়িত্বটা বেশি।
আলী রীয়াজের সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে লেখাটি তৈরি করেছেন সাংবাদিক শামসুদ্দীন আহমেদ