যে বিপ্লব মানুষের ভিতরটা বদলে দেয়

সেই সব নানা রঙের দিনগুলি (পর্ব-৩৩)

শামসুল আরেফিন খান


পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে পৃথিবীর তাবদ সবুজকে কালো আগ্রাসন থেকে বাঁচানো দরকার। সবুজই হ’ল পৃথিবীর প্রাণ। একদা, সবুজ ঘাস, সবুজ ফসল, সবুজ পাতায় ভরা ছিল পৃথিবীর আনাচ কানাচ। লতা গুল্ম বৃক্ষ, সবুজ অরণ্যের প্রবল টানে আকাশ থেকে তখন বাদল নামতো ঝম ঝম করে। আমাদের শিশুরা ছড়া কাটে, “আইকম বাইকম তাড়াড়াড়ি, যদু মাস্টার যায় শ্বশুর বাড়ি, রেন কাম ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম”। আমরাও ছোঠবেলায় এই ছড়া কেটেছি। এখন আমার ছোট্ট নাতি আদিত্য “পা পিছলে আলুর দম” বলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। আমি বলি,“ বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর”, আদিত্য বলে, “নদে এলো বান”। সেই বানের জলে ভিজে লক্ষ লক্ষ বছর আগেও পরিশ্রমী মানুষের সমতল শস্যভূমিতে সবুজের বন্যা বয়ে যেত। অনাদরে অযতেœ হেলাফেলায়ও তখন শস্যকণায় ভরপুর হত বিস্তীর্ণ সমতল। অথচ এ সময় বিশ্বউষ্ণায়নের প্রভাবে অনাবৃষ্টি ও ক্ষরায় যুক্তরাষ্ট্রের শষ্য ভান্ডার ক্যালিফোর্নিয়ায় ফসলের জমি চৌচির হয়ে যায়। সভ্যতার আদি কালে আদিগস্ত বিস্তৃত শস্যভূমির মালিক ছিলনা কেউ। চৌকিদার ছিল না। জমিদার মহাজন ছিলনা। কিন্তু একসময় বলবানরা পেশীবলে সেই বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি কব্জা করে ভূস্বামী হ’ল। নৃপতি হয়ে নরাধমে রূপাস্তরিত হ’ল। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে অনাবৃষ্টি ও ক্ষরায় নানা দেশের শষ্য ভান্ডারে ছুচো কেত্তন করে। তবু নব্য নৃপতি বলেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন একেবারে বাজে কথা। গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া বলে কিছু নেই। তালেবানের মৌলবাদী উত্থানকেও এভাবে মিথ্যা বলা হয়। বাংলা ভাইয়ের উত্থানকে মিডিআর সৃষ্টি এবং হোলিআর্টিজানের নৃশংসতাকে শত্রুতার জের দাবী করা হয়। অথচ মৌলবাদ পুঁজিবাদেরও রড় শত্রু।
সমাজ বিবর্তনের আদিকালের নানা কথা মাথায় রেখেই পুঁজিবাদী ফরাসী দার্শনিক ও সমাজতত্ত্ববিদ জাঁ জ্যাক রুশো বললেন,“জন্মগতভাবে মানুষ স্বাধীন ছিল”। মানুষই মানুষের পায়ে শিকল পরিয়েছে। সমাজব্যবস্থা মানুষকে মানুষের গোলাম বানিয়েছে। মানুষ মানুষের প্রভু হয়েছে। মানুষ মানুষের ক্রীতদাস হয়েছে। যে নারী ছিল আজন্ম অরণ্যের নরপতি, সেই নারী বন্দী হ’ল পুরুষের প্রাসাদের অস্তঃপুরে। সস্তান প্রসবিনী নারী শৃঙ্খলিত হ’ল সম্পদের মালিকানার উত্তরাধিকার নির্ভেজাল ও নিরঙ্কুশ করতে।
রুশোই বললেন,“ আগে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীন ছিল। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানার ধারণা সৃষ্টি হলে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রতারণা ও অতৃপ্ত বাসনা মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে বিঘিœত করে। তাই মানুষের অধিকার রয়েছে বিপ্লেবের দ্বারা রাজতন্ত্রের পতন ঘটাবার”। “রুশোকে ফরাসী বিপ্লেবের মূল কারিগর মনে করা হয়। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ফরাসী মননে বিপ্লবের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ জাগ্রত করতে সক্ষম হন”। ৫ মে ১৭৮৯ -৯ নভেম্বর ১৭৯৯ ফরাসী বিপ্লব হ’ল। তারই মধ্যে ১১ আগস্ট ১৭৯৮ সামস্তবাদ বিলুপ্ত করা হয়। পুঁজিবাদী দার্শনিক রুশো বিপ্লবের মন্ত্র দিলেন। কিন্তু বিপ্লব রক্ষার কোন তত্ত্ব দিলেন না। ফরাসী বিপ্লব তাই দম হারিয়ে ফেলে বিশ্বজয়ী নেপোলিয়ানের অশ্ব দাবড়ানো চাবুকে পরিণত হ’ল। পরবর্তী শতাব্দীতে জার্মান দার্শনিক মার্ক্স ও এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব দিলেন। কিন্তু তাঁরাও বিপ্লব সংরক্ষণের মূলমন্ত্র দিলেন না। তার ফলে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব পার্টির একনায়কত্বে পরিণত হ’ল। পার্টির একনায়কত্ব কতিপয় নেতার একনায়ত্ব থেকে এক ব্যক্তির একনায়কত্বে পর্যবসিত হ’ল। চঙডঊজ ঈঙজজটচঞঝ -অইঝঙখটঞঊ চঙডঊজ ঈঙজজটচঞঝ অইঝঙখটঞঊখণ কথাটা ছিল নেহায়েত তত্ত্ব। কিন্তু সেটা নিরেট বাস্তবে নেমে এসে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে গিলে খেলো। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের প্রয়াণ হল গরভাচেভ- রিগানের প্রেমালিঙ্গনে। পেরেসট্রয়কা -গ্লাসনস্ট ইতিহাসের শিক্ষার একটা বড় আধার।
১৮৪৬ সালে মার্কস – এঙ্গেলস লিখেছিলেন, ‘পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ, দুটোই বিশ্বব্যবস্থা। পুঁজিবাদ যতদিন বহাল থাকবে বিশ্ব ব্যবস্থা হিসেবে, ততোদিন ‘কম্যুনিজম’ তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারবেনা। কিন্তু তাঁরা স্থানীয়ভাবে এলাকাভিত্তিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নাকচ করেন নি। সেই যুক্তিতেই পৃথিবীর একাংশে এবং কোন কোন অংশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় কঠিন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সামস্তবাদী যুগে মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করেছে।“শিয়ালের গা ঢাকা দেয়ার জন্যে গর্ত ছিল, পাখির কূজনের জন্য ছিল নীড়, শ্বাপদেরও নিরাপদ ঠাঁই ছিল অন্তহীন অরণ্য। কিন্তু মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না।” তখন হিমালয় বা আল্পস পর্বত শীর্ষে বরফ গলেনি। মেরুদেশে তুষার গলেনি। সাগর উথাল পাথাল হলেও পানির উচ্চতা বেড়ে বিশ্বময় মানুষের ঘরবাড়ি গ্রাস করেনি। কারণ তখন পণ্য উৎপাদনের যান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিলনা। চিমনি ছিলনা। কালো ধোঁয়ার লাগামহীন উদ্গীরণ ছিলনা। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অপরিণামদর্শী আয়োজনও ছিল না। পিকিঙ, লন্ডন, রোম, সিডনি, বার্লিন নিউইয়র্কে লক্ষ লক্ষ গাড়ি থেকে কালো ধোঁযা নির্গত হ’তনা। বুড়িগঙ্গার ছিল ভরা যৌবন। শীতলক্ষা ছিল অকলঙ্কিত নিষ্কলুষ জলাধার। বাঁশ ছিল না তাই বাঁশিও ছিলনা। কারখানা ছিল না। তাই কারখানার দুষিত বর্জ আবর্জনাও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের ছিল ক্রীতদাস কর্ষিত আদিগন্ত ফসলের ক্ষেত। রাশিয়ায় ছিল বিস্তীর্ণ শস্যভূমি। রাশিয়ায় একদা যিনি ভূস্বামী ছিলেন, কাউন্ট নিকোলাই ইলিচ তলস্তয়ের পুত্র, সেই অভিজাত লেভ নিকোলাইভিচ তলস্তয় একদিন সৈনিক থেকে মহান লেখক হয়ে উঠলেন। তিনি দেখলেন মানুষ উদয়াস্ত ছুটছে সম্পদের অধিকার বিস্তীর্ণ থেকে বিস্তীর্ণতর করতে। কিন্তু দিবা শেষে একদিন সে মাত্র সাড়ে তিন হাত ভূমিতে শেষ শয্যাই রচনা করছে। তিনি লিখলেন, হে মানুষ অন্তিম শয়ানের জন্যে সাড়ে তিন হাতের বেশি তোমার আর কত জমি দরকার? একথা ঠিক যে তাঁর সেই অমিয় বাণী তাবদ মানুষের বিবেক ছুতে পারেনি। কিন্তু বিবেকবান মানুষের নরম মনে রেখাপাত করেছিল।
পার্ল এস বাক চীনের লাখো বছরের সামস্তবাদের অন্তিম সময়ের নিপুণ ছবি এঁকে নোবেল পেয়েছেন। তার গুড আর্থ গ্রন্থের নায়িকা চাষী ওয়াঙ লাঙের স্ত্রী ওলান আজীবন সামস্তবাদের কাদাজলে হাবুডুবু খেয়ে যখন পুঁজিবাদের ঝড়ে সামস্তবাদের বিরাণ প্রাসাদে সুখের শয্যা পেলেন তখন তার নিদ্রা হারিয়ে গেলো। তিনি আফিঙের নেশায় বুঁদ হয়ে জীবন সন্ধ্যায় ঝিঝি পোকার গান শুনলেন। জীবন শুরুর সাঁঝের মত। সুখের সোনার হরিণ মায়া মরীচিকা হয়ে রইলো। তিনি আসলে বুঝলেনই না পৃথিবীর কোন পরিবর্তন তাকে ভাসিযে নিয়ে গেলো। পরিবর্তনটা সবাই বুঝেনা। বুঝতে চায়না।
আমেরিকান লেখিকা পার্ল এস. বাক এর অমূল্য সৃজন “দি গুড আর্থ” কে চিরায়ত গ্রন্থ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কেননা এই লেখাটি কালের গন্ডি পেরিয়ে মহাকালের গন্ডিতে প্রবেশ করেছে। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে চীনের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসটির কেন্দ্রে রয়েছেন ওয়াঙ লাঙ নামের একজন দরিদ্র চাষী এবং তার স্ত্রী ওলান। প্রকৃতির বৈরিতার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি যেন তারা। অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ কিংবা অতিবৃষ্টি-এসকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে জীবনের ছন্দ-পতন। প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে জমিদার প্রথা, কৃতদাস প্রথা, শ্রেণী বৈষম্য। নিরলস পরিশ্রমের ফলে একদিন ওয়াঙ লাঙ একজন সাধারণ কৃষক থেকে হয়ে ওঠেন জমিদার। আর তার এই উত্থানের সাথে সাথে বদলে যায় তার জীবনধারা। এই উত্থানে সমান ভাবে অংশগ্রহণ করেন তার স্ত্রী। বস্তুতঃ তার অক্লান্ত কঠোর শ্রমই ওয়াঙ লাঙ কে একজন সাধারণ চাষী থেকে তুলে এনে ধনাঢ্য ব্যক্তিতে রূপাস্তরিত করে। কিন্তু ধনী ওয়াঙ লাঙ তাকেই করেন অবজ্ঞা-অবহেলা। “ যে সমাজ একজন নারীকে কেবলই গৃহস্থালীর কাজ আর সস্তান উৎপাদনের যন্ত্র মনে করে, যে সমাজে নারী গৃহপালিত পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট, সেই সমাজে ওলান এমন এক নারীর মূর্ত প্রতিচ্ছবি যে কিনা স্বল্পবাক কিন্তু তার স্বপ্ন সীমাহীন”। অদৃষ্টের পরিহাস। জীবন সায়াহ্নে ইতিহাসের ঝড়ে তার সে স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে।
{২): “ফুলবাড়িয়া কাঁদেরে /লাশ নিয়ে কাঁধেরে,/আর হাসপাতাল আছে শুয়ে/ রবে না তারা নুয়ে/ শ’খানেক লোক।..ফুলবাড়ির যে বিপ্লব মানুষের ভিতরটা বদলে দেয়
লোকেরা নয় যেন মানুষ ! তাই বিডিআরে করে গুলি ‘ঠুশ ঠাশ ঠুশ!’
দুর্বল এই গণকবিতাটা ২৬ আগস্ট, ২০০৬ এ ফুলবাড়ি আন্দোলনে গুলি চালানোর রাতে লেখা। ঐদিন চারদলীয় জোট সরকার ও এশিয়া এনার্জির আঁতাতের বহিঃপ্রকাশ রূপে আন্দোলনে গুলি চালানো হয়। আল-আমিন, সালেকিন ও তরিকুল নামের তিনজন নিহত হয়। গুলবিদ্ধ হয় কুড়িজন, আর প্রায় দু’শ লোক আহত হয়। রক্তাক্ত আন্দোলনের মুখে চারদলীয় জোট সরকার আপাতভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সারের দাবি জানাতে এসে ১৮ কৃষক গুলি খেয়ে লাশে পরিণত হয়। রাজাকার মন্ত্রীরা ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা পতাকা উড়িয়ে হিন্দু দমন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশের লক্ষ্যে “রাজাকার রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়। জঙ্গীশক্তি ও ভারতের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে প্রমাণ করে দেয় যে, রাষ্ট্র যখন যার দখলে থাকে তখন তারই সেবাদাসে পরিণত হয়। দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। জামাত -বিএনপির হাতে পড়ে একাত্তওে উৎপন্ন ধর্ম নিরপেক্ষ বাঙালি রাষ্ট্র বাঙালি দমনের যন্ত্রে পরিণত হ’ল্। কৃষক দমনের হাতিয়ার হ’ল। শ্রমিক দলনের হাতিয়ার হ’ল। নারী নিপীড়ন, নারী উচ্ছোষণকে ধমের অনুষঙ্গ করে নিলো।
পরিবর্তন আসে ইতহাসের ঝড়ে বিবর্তনের অবিরাম গতিধারায়। সে ঝড়ে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান। মিশরের ফেরাউন, চীনের মিং সম্রাট, ভারতের শাজাহান কিছু বুঝতে পারেনা। কিন্তু ‘হীরা মুক্তা মাণিক্যের ঘটা, ইন্দ্রজাল ইন্দ্র ধনুচ্ছটা’, সবই অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। মিশরের পিরামিড দেখিনি। কিন্তু চীনের ভূগর্ভে নিমজ্জিত তিনতালা রাজপ্রাসাদ দেখেছি। সেখানে মিঙ রাজা-রাণী এবং তাদের দাস দাসীদের কঙ্কাল সব শ্রেণী বৈষম্য ও ধনীদরিদ্র ভেদাভেদ হারিয়ে ফেলেছে। যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। কিন্তু তারাই দ্রুত বিকশমান সভ্যতার চালিকা শক্তি। তারা ইতিহাসের নতুন আত্মজকে শুধু প্রসবিত হতেই দেখেন না। তারা ইতিহাসের প্রসবযন্ত্রণাও শুনতে পান। মাটিতে কান পেতে শুনতে পান ধাবমান অশ্বের পদধ্বনি। যারা অন্ধবধির ও অবচেতনার জগদ্দল পাথর তারা হাজার বছরে কোনদিনও ইতিহাসের কান্না শুনতে পাননি। ইতিাসের কন্ঠস্বর শুনতে পাননি। ইতিহাসের গর্জনও শুনতে পাননি। আইয়ুব যুগের বটতলার উকিল মোনায়েম খান এবং এ যুগের সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি জযনাল আবেদিনের খোঁড়া যুক্তির ভিতর তাই কোন প্রভেদ দেখলাম না। আইয়ুব খান বলতে দুজনই অজ্ঞান।
(৩): ঝঞঅঞঊ ওঝ ঞঐঊ ঙজএঅঘ ঙঋ ঝটচচজঊঝঝওঙঘ” কথাটা মার্ক্সবাদীদের। “রাষ্ট্রমাত্রই দমনের যন্ত্র”। কথাটায় দম আছে। ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই এবং রাশিয়ার জার নিকোলাসের সামস্তবাদী রাষ্ট্র নির্মমভাবে দমন করতো ভূমিহীন দরিদ্র প্রজাদের। ফরাসী বিপ্লবী ম্যাক্সিমিলিয়ান – জ্যাকোবিন গং এবং রুশ বিপ্লবী লেনিন -স্তালিন মেহনতি মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। তাদের রাষ্ট্র শোষক শ্রেণীকে দমন করার প্রয়াস পেলো। প্রথমটা ১ বছর টিকলো। ২য় টা ৭৩ বছর। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র সাম্যবাদ অবধি পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু মানুষের ৫ মৌলিক চাহিদা- অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান এবং কর্ম সংস্থান, -পূরণ করার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সার্বজনীন রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে। কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাকেও বিশ্বব্যবস্থায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। ইউরোপ আমেরিকা কানাডা অস্ট্রেলিয়া সবই বলতে গেলে এখন কল্যাণ রাষ্ট্রের ন্যূনতম শর্তগলো পূরণ করছে।
আমার মনে হয় পুঁজিবাদ বেঁচে আছে সমাজতন্ত্রের অন্তস্বারকে অবলম্বন করে। সমাজতন্ত্রের মানবতাকে আঁকড়ে ধরে। সমাজতন্ত্রের ভালোবাসাকে আত্মস্থ করে। পুঁজিবাদ কৃষক শ্রমিকের কোমর থেকে দাসত্বের শিকল খুলে দিয়েছে। অস্তঃপুরবাসী সস্তানপ্রসবিনী অসূর্যস্পশ্যা নারীকে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ঘর করার স্বাধীনতা দিয়েছে। শিশু ও বৃদ্ধের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা পুঁজিবাদের ধর্মে পরিণত হয়েছে। এ সবই সমাজতন্ত্রের দান। পুঁজিবাদের ভিতরটা খানিক বদলে দিয়ে সমাজতন্ত্র রিট্রিট করেছে, াইতিহাসের কোন মহেন্দ্রক্ষণে বিশ্ব ব্যবস্থা হিসেবে ফিরে আসবে বলে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২১১ নম্বরে ফোন করলে খাদ্য-বস্ত্র ছুটে আসে অসহায় মানুষের কাছে। মাথাগোঁজার ব্যবস্থাও মেলে ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে। দৃশ্যমান হোমলেসদের গল্পের ভিতর রয়েছে আবার অন্য গল্প। ৯১১ তে ফোন করে আমি ১৯১০ সালে ১০ মিনিটের মধ্যে মিনি হাসপাতাল সজ্জিত অ্যাম্বুলেন্স চড়ে ভার্জিনিয়ায় রেস্টন হাসপাতালের অপেক্ষমান ডাক্তারসহ ইনটেনসিভ কেয়ার ব্যবস্থায় নিবিড় সেবা পেলাম। তিন দিন ধরে ১৪ ডাক্তারের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গভীর অনুসন্ধানে আমার রোগ নির্ণিত হ’ল। ভার্টিগো,- মানে মাথা ঘোরা। চোখের ছানি অপসারণ ও কৃত্রিম মনি সংস্থাপনের একটা পার্শ প্রতিক্রিয়া। ১০০ বছর সংগ্রাম করে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টি সার্বিক স্বাস্থ্য সেবার এক সুলভ সম্ভার দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এসেই তার নিকুচি করে রক্তাক্ত করে ফেলে। ক্ষমতার ভারসাম্যের কল্যাণে অবশ্য ব্যবস্থাটা টিকে যায়।
আমি ১৯৬১ সালের ১ ডিসেম্বর, এপেন্ডিসাইটিসের প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভোর ৪টা থেকে ৮ টা অবধি নানা জনের হাতে ‘পেট টেপাটিপি’ ছাড়া কোন স্বাস্থ্যসেবা পাইনি। ভাগ্যক্রমে, ৮টা সাড়ে আটটার দিকে আমার স্কুলের সহপাঠী , তখন ৩য় বর্ষের ছাত্র, ফজলে রহিম (অধুনা ডা. ব্রিগেডিয়ার-অবঃ) ইমার্জেন্সির দরজার কাছে এসে আমার চেঁচামেচি শুনে জোরেসোরে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার ? একজন এপ্রোণধারী পেট টেপা লোক তেমনি জোর গলায় বললে, “আরে একটা চিড়িয়া”। আমার বন্ধু কাছে এসে বললে, আরে তুই ? আমি তখন দৈনিক সংবাদে কাজ করি। আমার বন্ধু তার সহকর্মীকে বললে, “ ইনি আমার বন্ধু শুধুনা, ইনি একজন জাঁদরেল সাংবাদিক বটে। তার এই দুরবস্থার জন্যে আমাদের হেনস্থা হতে পারে”। রেসটন হাসপাতালের দুগ্ধ ফেনিভ শুভ্র শয্যায় শুয়ে সেই স্মৃতি রোমন্থন করেছিলাম। ২০০০ সালে বুকের ব্যথা নিয়ে গেলাম ঢাকার হৃদরোগ হাসপাতালে। ভর্তির পর অনেক কাকুতি মিনতি করেও সাধারণ বেডের বেশি কিছু জুটলো না। আমার পরম শুভাকাঙ্খী লেখিকা আফরোজা পারভীন (যুগ্ম সচিব- অবঃ) তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রলায়ের সহকারি সচিব। খবর পেয়ে তিন-চারজন সহকর্মীকে নিয়ে ছুটে আসলো। সবাই তারা আমাকে লেখক- সাংবাদিক বলে চেনে। আমি তাৎক্ষণিকভাবেই একটা সিঙ্গেল কেবিন পেয়ে গেলাম। একমাস ছিলাম। সেকথা আমি ভুলিনি। সেদিন আমি পাওয়া-না পাওয়ার ব্যাপারটা তেমন গভীরভাবে বুঝিনি। কিন্তু এখন সেই হাসপাতালের তলার দিকের একজন খুবই নগণ্য কাজের লোকের কাছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা মজুদ আছে শুনে ব্যাপারটা সম্যক বুঝতে কষ্ট হচ্ছেনা।
স্বাস্থ্য সেবা খাতে যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশে একটা ব্যাপারে মিল দেখতে পাচ্ছি। যেমন ধরুন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯৬-২০০১ মেয়াদে হাজার হাজার কম্যুনিটি ক্লিনিক বানিয়ে দরিদ্র পল্লীবাসীর দোর গোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার উদার ব্যবস্থা নিলেন। রিপাবলিকানদের মত জামায়াত-বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে সিংহাসনে বসে সেগুলোর দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। বড় বড় ডাক্তারদের গ্রাম-দর্শন বন্ধ হ’ল্ এরকম আরও অনেক মিল অমিলের ব্যাপার আছে। যা বলতে গেলে পরিসরে মহাভারত হবে।
সব রাষ্ট্রই যে কারও না কারও দমন ও দলনের হাতিয়ার সে কথা আমি বিশ্বাস করি। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র দমন করে ৯০ ভাগ শোষিত মানুষকে। কারণ তারা নিñিদ্রভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গগনবিদারি গর্জন করায় ফ্রান্সের শোষক রাজার বাস্তিল দুর্গ ধসে পড়লো। সেন্ট পিটার্সবার্গের শীতকালীন প্রাসাদের সেলারে রক্ষিত বিশ্ব সেরা সুরার ভান্ডার তাদের তান্ডবে বিদীর্ণ হ’ল। মদের বন্যায় শহর ভেসে গেলো। আজীবন তৃষ্ণার্ত আম জনতা সেই অমৃত পান করে রাজতন্ত্রকে ঝেটিয়ে বিদায় করলো ইতিহাস থেকে।
১. কাজে কাজেই ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র দলন করবে ৯০ ভাগ শোষিত মানুষকে। তাতে আর গলদ কোথায়? শোষিত মানুষের আছে সংখ্যায় বড় জনবল। আমরা দেখলাম ১৯৬৯ সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সেই জনবল নিয়ে সস্তান প্রতীম শিষ্য আসাদের রক্তে ভাসিয়ে দিলেন আইয়ুবের তখতেতাউস। জেলের তালা ভাঙলো জনগণ। জনতার মুজিব বেরিয়ে এলেন। গণমানুষের চোখের মনি শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধি পেয়ে নবরূপে উদ্ভাসিত হলেন।
২. একইভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র দমন করবে শোষকদের। যাদের সংখ্যা কোন জনগোষ্ঠীর ১০ ভাগের অতিরিক্ত না। তাদের আছে অর্থবল। আছে পেশীবল। ভাড়াটে লোকবল আছে। উজির নাজির মন্ত্রী শান্ত্রী, কামান বিমান আছে। রাজাকার, আল বদর আল শামস্ আছে। অধুনা তালেবান, আইএস, আলশাবাব সংযুক্ত হয়েছে তাদের শক্তির বহরে। আছে কতোনা তল্পীবাহক, লাঠিয়াল, চামচা, স্তাবক ও পদলেহী সুবিধাবাদী আইনের অধ্যাপক, বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক, উকিল ব্যারিস্টার। সপ্তম নৌবহরও তাদের গোলাম। স্তালিন, মাওসেতং, টিটো, ক্যাস্ট্রো স্বদেশে তাদের কঠোরভাবে দমন করেছিলেন বলেই বিপ্লবকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। কিন্তু যাঁরা বিপ্লবের তত্ত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা বিপ্লবকে রক্ষা করার কোন তত্ব দেননি। সে তত্ত্ব বা পন্থা সংশ্লিষ্টদের নিজ বাস্তবতায় উদ্ভাবন করতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সে তত্ত্ব প্রয়োগে ভুল হয়েছে। সিআইএ এখন বলছে, রাশিয়া ও চীনে প্রতিবিপ্লব দমন করতে “হলোকাস্টের” সমান লোকক্ষয় হয়েছে। তারা অবশ্য এও স্বীকার করছে যে, ইন্দোনেশিয়ায় সমাজতান্ত্র দমন করতে যে লোকক্ষয় হয়েছে তাও হলোকাস্টের সমান। জার্মানিতে ইহুদি নিধনকেই বলা হয় ‘হলোকাস্ট’। কম করে ৬০ লক্ষ মানুষের নির্মম হত্যাকান্ড।
(৩) বাংলাদেশ বিপ্লব পৃথিবীতে আর একটি দৃষ্টান্ত রেখেছে। ১ .তেইশ বছরের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ছিল তার প্রথম ধাপ। ভারতের মহাত্মা গান্ধী “ অহিংসার” সবক নিয়েছিলেন রুশ সাহিত্যিক-দার্শনিক লেভ তলস্তয়ের চিস্তাধারা থেকে। তিনি বিশ্বাস করতেন, “একটামাত্র বিপ্লবই চিরস্থায়ী হয়। সেটা হ’ল নৈতিক বিপ্লব যা মানুষকে ভিতর থেকে বদলে দেয়”। ১৯০৮ সালে ভারতে জনৈক বন্ধুর কাছে লেখা তলস্তয়ের একটা চিঠি পরবর্তী সময় মহাত্মা গান্ধী পড়ে শুনিয়েছিলেন প্রকাশ্য সভায়। তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিশ্বাসের কথা। তলস্তয় বিশ্বাস করতেন, “অহিংসাই একমাত্র পন্থা যার মাধ্যমে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসন থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে।
বাংলাদেশ বিপ্লবের প্রাণ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ বছর কখনও হিংসার পথে এক পাও অগ্রসর হতে দেননি তাঁর ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে’। ৭ মার্চ সর্বপ্রথম তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের ধারণা ও তা অর্জনের রোডম্যাপ তুলে ধরেন্। ৭২ সালে বহুমুখী চাপের মুখেও তিনি গণতান্ত্রিক ধারাকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন। ন্যূনতম সময়ে সংবিধান রচনা করে ৭ মার্চ ‘৭৩ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধানিক চার মূলনীতি-১. ধর্মনিরপেক্ষতা ২. . বাঙালি জাতীয়তাবাদ ৩. সমাজতন্ত্র ৪. গণতন্ত্রের পক্ষ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি মানুষের জীবনের মূল্যকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিলেন। ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। আর কারও প্রাণ যাক উলুখগড়ার মত, সেটা চাইলেন না। সম্ভাব্য প্রতিবিপ্লব দমনের জন্যে রাষ্ট্রকে প্রস্তুত করলেন না। পরিণামে তাঁর স্বপ্নে লালিত “কৃষক শ্রমিক রাষ্ট্রের “ ধারণা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হ’ল। প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে তাঁর অত্যন্ত কাছের মানুষরা তাঁর প্রাণই শুধু কেড়ে নিলো না, তাঁর স্বপ্নকেও ধূলায় মিশিয়ে দিলো।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দৃঢ়চিত্ত হয়ে একাত্তরের রাজনৈতিক শত্রদের ঘায়েল করেছেন পিতার প্রেরণা প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতাকে অবলম্বন করে। অবাক করা তাঁর নিজ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের গুণে। এদিনে তিনি জনগণের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। লড়াই শুরু করেছেন অর্থনৈতিক মুক্তির চিহ্নিত শত্রু ভূমিদস্যু, ব্যাংক ডাকাত, অর্থ পাচারকারী, জনগণের অর্থ আত্মসাৎকারী, মাদক ব্যবসায়ী ও ঘুষ দুর্নীতির হাঙ্গরদের বিরুদ্ধে। তিনি যে কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপ রেখা বাস্তবায়ন করছেন ৩০ বছরের সাধনায় পাওয়া অভিজ্ঞান দিয়ে, সেই স্যেক্যুলার রাষ্ট্রই বাঙালির স্বাধীনতা ও অর্থনেতিক মুক্তির প্রকাশ্য ও গোপন শত্রু, কালো টাকার ওরাঙ ওটাঙ ও গরিলা- শিম্পাঞ্জিদের দমনের প্রকৃষ্ট হাতিয়ার হবে বলে বিশ্বাস করতে চাই। ৯০ ভাগ মানুষের স্বপ্ন বাঁচাবার জন্যে ১০ ভাগ রক্তশোষককে দমন করতে নির্মম হওয়ার কোন বিকল্প তাঁর হাতে আছে বলে আমি মনে করিনা।
ক্যালিফোর্নিয়া।