রওশন-বিদিশার লড়াই

নিজস্ব প্রতিনিধি : জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত হলেও দেশের মানুষের মধ্যে স্থান করে নিতে পারেনি জাতীয় পার্টি। এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টি ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতাও হারিয়েছে। সংসদের ভেতরে কি বাইরে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথাবার্তা, বক্তব্যে মানুষের মধ্যে এ ধারণাই বিশ্বাসে রূপ নিয়েছে যে জাতীয় পার্টি সরকারেরই একটি সংগঠন। এর নিজস্ব কোনো রাজনীতি, রাজনৈতিক আদর্শ, বিশ্বাস নেই, নেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের উপরিউক্ত পর্যবেক্ষণমূলক অভিমত অসত্য, অমূলকও বলা যাবে না। সেনাশাসক এরশাদ জীবদ্দশায় একাধিকবারই বলেছেন, তিনি একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি একজন সৈনিক। এই মনমানসিকতার মধ্যেও এরশাদের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার যে ক্রমবিকাশ হচ্ছিল, তা তার আচরণ, কথাবার্তায়ও বোঝা যাচ্ছিল। তার অবর্তমানে পারিবারিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা থেকেই এরশাদ তার স্ত্রী রওশন ও ছোট ভাই জি এম কাদেরকে দলে অত্যন্ত সম্মানজনক স্থানে নিয়ে আসেন। একটি বৃহৎ দলের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্যতা, দক্ষতা তাদের রয়েছে কি না জাতীয় পার্টি ও তার বাইরের রাজনৈতিক অঙ্গনে সে প্রশ্ন আজ বড় হয়ে এসেছে।
জাতীয় পার্টিতে রাজনীতিবিদ হিসেবে যারা পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত, তাদের প্রায় সবাই এই দল ছেড়ে ভিন্নতর অবস্থান নিয়েছেন। মিজানুর রহমান চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শামসুল হক, কোরবান আলী, অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিবিদদের ছুটিয়ে নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন এরশাদ। দলের মধ্যে রাজনীতিহীনতা, রাজনৈতিক নেতাদের জনবিচ্ছিন্ন করে তুলছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তারা শেষ জীবনে তাদের মূল দলে সাধারণ সদস্য হিসেবেই ফিরে যান বা এরশাদকে ত্যাগ করে ভিন্ন অবস্থান নেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে যাদের অবস্থান ছিল একজন কর্মীর, তারাই এখন জাতীয় পার্টির নেতা। দলটির শীর্ষ পদগুলোতে রয়েছেন এরশাদের আত্মীয়রা। অরাজনৈতিক, রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ এই ব্যক্তিরা পার্টির নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্বে থাকায় দ্বন্দ্ব-বিরোধও বাড়ছে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের সাথে।
এরশাদের মৃত্যুর পর কয়েকবারই নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কখনো তা চরম আকার নেয়। রওশন এরশাদ তার সংসদের বিরোধী দলের নেতা হওয়ার বাসনা পূরণ করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পর্যন্ত ধরনা দেন। একই সাথে তিনি পার্টির চেয়ারপারসনের পদটিও দাবি করেন। জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিয়ে আপসরফায় আসেন। মহাসচিবের পদটিতে তিনি একান্ত অনুগত একজনকে আনার জন্য নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে সফল হন। রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে বসানো হয় রংপুরেরই মশিউর রহমান রাঙ্গাকে। রাঙ্গাকে সরিয়ে আনা হয় জিয়াউদ্দিন বাবলুকে। বাবলু সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর চয়েস ছিলেন বলে কেউ মুখ খোলেনি। কাদেরসহ বিরুদ্ধবাদীরা নীরবে মেনে নিলেও বাবলুকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেননি। বাবলুও কিছু ক্ষেত্রে বেপরোয়াভাবে কাজ করতে শুরু করেন। জেলা-উপজেলা কমিটির সম্মেলন অনুষ্ঠানে জি এম কাদেরের নির্দেশনা অনুযায়ী তারিখ নির্ধারণ করছেন না বাবলু। কয়েকটি জেলায় নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য বলা হয়। অঙ্গ, সহযোগী সংগঠনসমূহের সম্মেলন অনুষ্ঠান ও তার পছন্দের নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য জি এম কাদেরের অনুরোধ বিবেচনায় নিচ্ছেন না জিয়াউদ্দিন। তিনি রওশন এরশাদের পরামর্শ ও নির্দেশনাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। অন্যদিকে জি এম কাদের সাংগঠনিক-রাজনৈতিক অনেক বিষয়েই মহাসচিব ও রওশনের সাথে আলোচনা না করে, তাদের পরামর্শ ছাড়াই সিদ্ধান্ত দেন। তার এ আচরণকে একগুঁয়েমি বলে চিহ্নিত করে রওশন, বাবলুসহ আরো কয়েকজন কাদেরের বিপক্ষে অভিন্ন অবস্থান নেন। জি এম কাদেরের রুক্ষ আচরণ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। কাদেরের বিরোধীরা তা পুঁজি করে এদেরও সংগঠিত করেন।