ডা. শওকত আরা বেগম : বাংলা ভাষায় যদিও শব্দটি রক্তচাপ, তবুও জানি আমাদের দেশের আবাল, বৃদ্ধ বনিতা সকলেই একে প্রেশার বলেই জানে। আবার উচ্চরক্তচাপ না বলে, High pressure বলতে ভালবাসে। সে যাই হোক, এই উচ্চরক্তচাপ আবার অনেক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে, cerebral haemorrhage. অর্থাৎ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটায়। কখনও দেখা গেল, রোগী হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গেছেন, নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে অথবা রক্ত নাও ঝরতে পারে, ডাক্তার এসে দেখে বললেন, ‘স্ট্রোক’ হয়েছে, এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবেএবং দেখা গেল রোগী আর সজ্ঞান অবস্থায় বাড়ি ফিরতে পারলেন না।
অধিকাংশ সময় দেখা যায়, রোগী মধ্যবয়সী, অনেকদিন যাবৎ উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন, ইদানীং ওষুধপত্র আর নিয়মকানুন অনিয়মিত হয়ে উঠেছে, কাজের চাপে প্রেশারও চেক করানো হয়না। অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ, তার উপর পারিবারিক কোন দুর্ঘটনায় যদি আকস্মিক উত্তেজনা বেড়ে যায়, যার ফলে মস্তিষ্কের ধমনি ছিড়ে রক্তক্ষরণ অর্থাৎ স্ট্রোক হয় এবং অধিকাংশ সময় অনাকাঙ্খিত মৃত্যু ঘটে যায়।
অবশ্য আজকাল প্রেসার সম্পর্কে কিছুটা সচেতনতা ও উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে, প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখার ফলে এ জাতীয় স্ট্রোক কিছু কম দেখা যায়, তাই বলে সাবধানের মার নেই এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই সাবধানতা এবং প্রয়োজনীয়তা, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই বোধকরি।
আর একটি কথা একটু বলা দরকার তা হচ্ছে, প্রচলিত ভাষায় স্ট্রোক বলতে অনেকেই ভুলক্রমে যে রোগটিকে বুঝে থাকেন, সেটা হচ্ছে” করোনারী এ্যাটাক” বা হার্ট এ্যাটাক। এই রোগের কারণ হচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী উচ্চরক্তচাপের প্রভাব, ধমনীর স্থুলতা ও ভেতরের পরিসরের সংকির্ণতা। একটিতে Cerebral artery ছিড়ে গিয়ে রক্তপাত ঘটিয়ে Cerebral stroke হয়। আর অপর টিতে হার্ট এর Coronary artery’s এ রক্ত জমাট বেঁধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে “হার্ট এ্যাটাক” ঘটায়। বর্তমান যুগে জীবানু ও ভাইরাসের সংক্রমণ ছাড়াও ধমনি ও হৃদয়ের অবক্ষয়জনিত রোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছে। কারণ ওষুধে এইসব রোগ পুরোপুরি সারেনা। উন্নত ও ধনী দেশগুলোতে এই জাতীয় রোগেই মৃত্যুর হার বেশী তবে আমাদের দেশেও এর প্রাদুর্ভাব কম নয়।
আমাদের দেহের সর্বত্র রক্তচলাচল বজায় রাখার জন্য রক্তপ্রবাহের স্বাভাবিক একটা চাপ থাকে, যাকে বলা হয়, ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ। এই রক্তচাপ আবার দেশ, পরিবেশ, বয়স, স্ত্রী- পুরুষ, দেহের উচ্চতা, ওজন ইত্যাদি কারণভেদে কম বেশী হয়ে থাকে। কোন কারণে রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচুতে থেকে যাওয়ার নাম, ‘হাইপারটেনশন’ বা উচ্চরক্তচাপ। আবার প্রেশারের মাত্রা নিয়েও মতভেদ আছে। তবে পঞ্চাশ বছর বয়সের নিচে কারও রক্তচাপ, ১৫০/৯০ মিলিমিটার’র চেয়ে বেশী না হলে তাকে উচ্চরক্তচাপ বলা যায়না বলে অনেকেই মনে করেন। উন্নত দেশগুলোতে প্রেসার নিয়ে মাথা ব্যাথার অন্ত নেই। কারণ প্রেশারের জটিলতা নানা দিকে ধাবিত হয়। যার ভেতর প্রধান টার্গেট হচ্ছে হৃৎপিন্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি ও চক্ষু। অনেক সময় এইসব জটিলতা মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করে। তাই প্রেশারনিয়ে চলছে গবেষণা, বের হচ্ছে নতুন নতুন ওষুধ আর হরেক রকম তথ্য।
একথা বললে ভুল হবে না যে উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিন্তু বেড়েই চলেছে।
আগের আমলে এত বেশী প্রাদুর্ভাব ছিলনা। তাই বোধকরি বলা যায়, এই রোগ আধুনিক সভ্যতা ও সচ্ছলতার রোগ। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত প্রোটিন খাবার, দেহের ওজন বৃদ্ধি ও স্থুলতা, শরীরচর্চার অভাব, টেনশান এবং আরও অনেক কারণ এই রোগের সাথে জড়িত। তবে দুটো কারণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যেমন, বংশগত বৈশিষ্ট্য এবং টেনশান বা তাড়না।
দেখা গেছে, মা বাবা দুজনের প্রেসার থাকলে ছেলেমেয়ের প্রায়৭০ শতাংশের এই রোগ হতে পারে। আর মা বাবা যেকোন একজনের থাকলে ৩০ শতাংশ ছেলে মেয়ের এ রোগ দেখা দিতে পারে। এই সম্ভাবনার সাথে যদি টেনশান, অতি ওজন ইত্যাদি এসে যোগ দেয়, তাহলে তো কথাই নেই।
উচ্চরক্তচাপ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে আমাদের শরীরের ছোট ছোট ধমনীর সংকোচনের ফলাফল। দীর্ঘস্থায়ী চাপের প্রভাবে ধমনীর প্রাচীর মোটা হয়ে যায় ও তার ভরতের পরিসর ক্রমেই সংকীর্ণ হতে থাকে। এমনিভাবে ধমনীতে স্থায়ী পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রেসারও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এবং একসময় স্থায়ী উচ্চরক্তচাপে পরিণত হয়। অবশ্য প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধ পত্র ও নিয়মকানুন মেনে চলতে পারলে অবস্থা অনেকটা আয়ত্তে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীকে ডাক্তারের কাছে যেতে খুব একটা দেখা যায়না। কারণ শুরুতে সবসময় গুরুতর কোন অসুবিধা দেখা দেয়না। তাই রোগী যখন ডাক্তারের কাছে যান, ততদিনে রোগ অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে প্রায়ই দেখা যায়, বিশেষ কোন প্রয়োজনে শরীরের কোন রুটিন পরীক্ষার সময় প্রেসার ধরা পড়ে।
প্রেশারের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে, মাথাধরা, মাথাঘোরা, বুক ধড়পড় করা, দুর্বলতা, ক্লান্তি, হঠাৎ রেগে যাওয়া, অনিদ্রা ইত্যাদি। এই লক্ষণগুলির কোন একটিও দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বর্তমানে আমাদের দেশেও উচ্চরক্তচাপের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে আগের চেয়ে বহুল পরিমাণে। চিকিৎসকগণ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ ছাড়াও খাদ্য ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে থাকেন।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে বলা যায়, উচ্চরক্তচাপ চিকিৎসায় সারাজীবন চিকিৎসা চালাবার প্রয়োজন হয়ে থাকে এবং রোগীর আরও জানা দরকার যে এক্ষেত্রে এই প্রেসার চিরস্থায়ীভাবে সেরে যায়না। ঠিকমত ওষুধ খাওয়া ও অন্যান্য নিয়মকানুন মেনে চলার ফলে নিয়ন্ত্রণে থাকে মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই প্রেশারের চিকিৎসায়, চিকিৎসা না বলে সধহধমবসবহঃ কথাটাই বেশী প্রযোজ্য। সেই সংগে কিছু পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রেশারের চিকিৎসা ওব্যবস্থাপনায় রয়েছে, পরিমিত শরীর চর্চা, খাদ্যের মাত্রা ও চর্বির পরিমাণ কমিয়ে দেহের ওজন আদর্শ মানদন্ডে স্থির রাখা, খাদ্যে লবনের মাত্রা কমানো, উদ্বেগ, উত্তেজনা এড়িয়ে চলা, ভাল ঘুম হবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, দিনে এক গ্রামের কম লবন গ্রহন করা নিয়মিত প্রেশার চেক করা ইত্যাদি। সেইসাথে প্রেশার কম করার ওষুধ (Hypotensive drug), প্রয়োজনবোধে ডাই ইউরেটিক ওষুধ এবং প্রশান্তিদায়ক ওষুধ (Tranquilizer) দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে, কখনও এককভাবে আবার কখনও সম্মিলিতভাবে।
আর এইসব ব্যবস্থার সুফল পাওয়া যায়, নির্দেশগুলো সঠিকভাবে পালন করার মাধ্যমে। কারণ উচ্চরক্তচাপ নিয়মের শাসনে স্থির থাকে। নইলে কখন অস্থির হয়ে স্ট্রোক’ এর মত দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। একারণে কোন প্রকার অস্বস্তিকর লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এবং মাঝে মধ্যেই রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হবে। একটি রক্তচাপ মাপার যন্ত্র কিনে ঘরে বসেও সেটা সম্ভব।
আর একটি ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তা হচ্ছে, রুগীকে ডাক্তার দেখান হোল, প্রেসক্রিপশান মত ওষুধ খাওয়ান হোল, রোগীও ভাল বোধ করলেন, এই পর্যায়ে ভাবেন যে, প্রেশার ভাল হয়ে গেছে। এটি ভাবলে চলবেনা। অবক্ষয়ধর্মী রোগ শুধু ওষুধপত্রে শেষ হয়না। তাই প্রেশারও পুরোপুরি ভাল হয়না। শাসনে ভাল থাকে, নিয়ন্ত্রণে থাকে মাত্র। তাই একে নিয়ন্ত্রণে রেখেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের বর্তমান অগ্রগতির ভিত্তিতে একথা বলা যায়, একজন প্রেশারের রোগী সঠিক চিকিৎসা ও নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন পালনের মাধ্যমে দীর্ঘ, কর্মময় জীবন যাপন করতে পারেন। শুধু প্রয়োজন রোগীর সদিচ্ছা ও মনের জোর। কারণ অনেকসময় দীর্ঘদিন যাবৎ ওষুধ খাওয়া ও নিয়ম পালনের কারণে রোগী একঘেয়েমী বোধ করে ও অধৈর্য্য হয়ে ওঠে। অনিয়ম শুরু হয়ে যায়। যেটি খুবই মারাত্মক। এটি করা চলবেনা। কারণ পৃথিবীতে সকলেই দীর্ঘজীবন চায়। তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয়তা আজ সময়ের দাবি।